আমেরিকার পূর্ব থেকে পশ্চিমে
শুজা রশীদ
প্রথম পর্ব পড়তে হলে ক্লিক করুন
পরদিন র্যাপিড সিটি থেকে খুব ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়লাম। পরবর্তি গন্তব্য ডেভিলস টাওয়ার ন্যাশানাল মনুমেন্ট। র্যাপিড সিটি থেকে এক শ’ দশ মাইলের মত দূরত্ব। এটি একটি খুব বিখ্যাত এবং দর্শণীয় স্থান। এই এলাকার আকর্ষণীয় স্থানের লিস্টে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। বোস্টনে বসে এই যাত্রার যখন পরিকল্পনা করছিলাম তখনই বিশেষ করে ঠিক করে রেখেছিলাম ডেভিলস টাওয়ারে যাবোই।
এক্সপ্রেসওয়ে ৯০ ধরে ছুটে চলেছি পশ্চিমে, ডেভিলস টাওয়ারের দিকে। একটু পরেই লক্ষ্য করলাম দল বেঁধে মটরসাইকেল নিয়ে একই দিকে চলেছে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। এতো পথ এসেছি সেই বোস্টন থেকে, কিছু মটরসাইকেল দেখেছি কিন্তু এই ধরণের ব্যাপক কিছু দেখিনি। চারদিকে নানা জাতের মটরসাইকেল আর তাদের নানা কিসিমের আরোহীতে একেবারে মেলা লেগে গেছে। আমি চলছি প্রায় এক শ’ মাইল বেগে, তারা আমাকেও স্বাচ্ছন্দ্যে পেরিয়ে চলে যাচ্ছে।

বাইকাররা স্টারজিস মহাসম্মেলনে যাচ্ছে দল বেঁধে
পথে একটা রেস্ট এরিয়াতে থেমে রেস্টুরেন্টে গিয়ে হোস্টেসকে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করতে সে রহস্য ফাঁস করল। প্রতি বছর সাউথ ডাকোটার স্টারজিস নামে একটি শহরে মোটরসাইক্লিস্টদের বিশাল সম্মেলন হয়। ১৯৯৭ সালের সম্মেলন তখন চলছে। রাস্তায় এতো যে বাইকার দেখেছি সবাই সেখানেই যাচ্ছে। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম সেখানে কিভাবে যাওয়া যায়। সে মৃদু হেসে বলল, যেকোন একটা বাইকার দলের পিছু নাও। জায়গামত পৌঁছে যাবে। এখান থেকে বেশী দূরে নয়।
তার উপদেশ মত একটা বড় সড় বাইকার দলের পিছু নিলাম। র্যাপিড সিটি থেকে স্টারজিস মাত্র ত্রিশ মাইলের মত। অল্পক্ষণ পরেই বাইকারদের পেছন পেছন এক্সপ্রেসওয়ে থেকে Exit নিয়ে স্টারজিসে ঢোকার পর আমার বিস্মিত হবার পালা।

শহরটা ছোট কিন্তু চারদিকে হাজার হাজার বাইকারদের ভীড়ে মনে হচ্ছে একটা অদ্ভুত কোন জায়গায় এসে পড়েছি। পরে জানলাম বাইকারদের এই সম্মেলন প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। তারপর থেকে প্রতি বছর পালিত হয়। প্রায় অর্ধ মিলিয়ন বাইকাররা সেখানে আসে এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে। নানা ধরণের প্রোগ্রাম হয় – বাইক রেসিং থেকে শুরু করে বাইক স্টান্ট।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বাইকারদের মধ্যে প্রচুর মহিলা বাইকারও রয়েছে। পুরুষ-নারী সকলেরই পোষাক-আষাক এবং শরীরের টাট্টুর সমারোহ দেখে অনভ্যস্ত চোখ বিস্ফোরিত হতে পারে। মনে মনে একটু শঙ্কাই হচ্ছে। চারদিকে হাজার হাজার বাইকের মাঝখানে আমার টয়োটা করল্লা একেবারেই বেমানান। মানুষরাও সবাই শ্বেতাঙ্গ। মাত্র একজন দেখলাম কৃষ্ণাঙ্গ, একটা মটর শপে কাজ করছে। বাইকারদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একটা গাড়ী নিয়ে একজন বাদামী বর্ণের মানুষকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে অনেকেই দেখলাম ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। নিশ্চয় ভাবছে বাইকারদের সম্মেলনে গাড়ি নিয়ে হাজিরা দেবার মত গর্দভটা কে।

এক পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম একটা হেলিকপ্টার ঐ এলাকার উপরের দৃশ্য দেখাবার জন্য ফ্লাইট অফার করছে। হেলকপ্টারে এর আগে কখন চড়িনি। বেশ আগ্রহ নিয়ে খোঁজ নিতে গেলাম। পাইলট বলল প্রতি আরোহীর কাছ থেকে সে ৫০ ডলার করে নিচ্ছে। সেই সময়ে ৫০ ডলার একেবারে কম টাকা নয়। আমি মনে মনে একটু ইতস্তত করতে লাগলাম। সেই সময় ভাগ্যচক্রে একটি টেলিভিশন ক্রু এসে হাজির হল। তারা দু’জন। তারা হেলিকপটারে উঠে ছবি নেবে। পাইলট আমাকে জানাল সে অর্ধেক মূল্যে আমাকে তাদের সাথে নিতে রাজী আছে। আমি ঝট করেই রাজী হয়ে গেলাম।

পাইলট আমাদেরকে নিয়ে শহরটার উপর বেশ কয়েকবার চক্কর দিল। বলার অপেক্ষা রাখে না উপর থেকে দেখলাম নীচে বাইকের সমুদ্র, যেদিকে তাকান যায় সেদিকেই হাজার হাজার বাইক, চারদিকে কিলবিল করছে। আমি নিজে বাইক মোদী নই, জীবনে কখন চালাইনি, কিন্তু মানুষের আগ্রহ উদ্দীপনা দেখে খুব মোহিত হলাম। পরে বুঝেছি এখানকার বাইকাররা শুধু বাইক চালায় না, এটাই হচ্ছে তাদের জীবন ধারা। অনেক বাইকাররা আবার নানা ধরণের অপরাধ চক্রের সাথে জড়িত। তারা ড্রাগ ব্যবসা এবং খুন খারাবীও করে থাকে। তবে অধিকাংশই হচ্ছে স্রেফ সখের বশে বাইক চালায় এবং বাইকার জীবন যাত্রা পছন্দ করে। তাদের চলন বলন, জামা-কাপড় সবই পৃথক। অনেককে দেখেই মনে হতে পারে যে তারা কোন হলিউডের ছবির ভিলেইন – যেমন দৈত্যের মত বিশাল তেমনি তাদের ভীতিকর চেহারা এবং লেবাস। সেখানে খুব বেশীক্ষন একা একা কাটাতে আমার সাহস হল না। হেলিকপ্টার রাইড থেকে নেমেই আমি গাড়ীতে উঠে স্টারজিস থেকে বেরিয়ে গেলাম। উঠলাম আবার এক্সপ্রেসওয়ে ৯০তে। স্টারজিস আমার প্ল্যানের মধ্যে ছিল না। কিন্তু অভিজ্ঞতা হিসাবে খুবই অভিনব বলতে হবে। চিন্তাই করি নি যাবার পথে এই জাতীয় সম্মেলন দেখার সৌভাগ্য হবে।
যাইহোক, এবার আমার মূল গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম। ডেভিলস টাওয়ার। এখান থেকে ৮০ মাইলের মত দূরে।

ঘন্টা দেড়েক পর পৌঁছালাম ডেভিলস টাওয়ার ন্যাশনাল মনুমেন্টে। সেখানে যেতে হলে এক্সপ্রেসওয়ে ৯০ ছেড়ে স্থানীয় হাইওয়ে নিতে হয়। প্রায় ছাব্বিশ মাইলের মত পথ। কিন্তু ব্ল্যাক হিলে অবস্থিত এই স্থানটির সৌন্দর্য মনমুগ্ধকর। চারদিকের টিলার উপর মাথা উঁচিয়ে একটা মহীরুহের মত দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাকৃতিক পাথরের টাওয়ার।
আসার আগেই অল্প বিস্তর পড়াশুনা করে এসেছি। এর নাম ডেভিলস টাওয়ার হবার পেছনে একটা ছোট ইতিহাস আছে। ১৮৭৫ সালে কর্নেল রিচার্ড আরভিং ডজের নেতৃত্বে একটি এক্সপেডিশন টিম টাওয়ারটির নেটিভ নাম ভুল অনুবাদ করে। তারা মনে করে এটার স্থানীয় নামের অর্থ ‘মন্দ দেবতার টাওয়ার’। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ নেটিভ ইন্ডিয়ানরাই এটাকে ডাকে ‘ভালুকের ঘর’ কিংবা সেই জাতীয় নামে।
ডেভিলস টাওয়ার সমুদ্র সীমা থেকে ৫০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। টাওয়ারটির উচ্চতা ১২০০ ফুটের মত। এটাই আমেরিকার প্রথম ন্যাশানাল মনুমেন্ট এবং খুবই জনপ্রিয় টুরিস্ট প্লেস। ক্লাইম্বারদের কাছেও এটি খুব জনপ্রিয় একটি স্থান। প্রতিবছর বহু মানুষ এই টাওয়ারের চূড়ায় ওঠে। ২০১৭ সালে ৮৬ বছরের একজন এই চুড়ায় উঠে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। টাওয়ারটা বেশ খাড়া হলেও তার শরীর ঘিরে পাথরের উপর পাঁচ দশ ফুট পর পর প্রচুর খাজ আছে, যে কারণে এটার উপরে উঠতে ক্লাইম্বারদের সুবিধা হয়। কিন্তু এখানে ইদানীং কালের মধ্যে ২০১৭ তেই একজন ক্লাইম্বার উপরে ওঠার সময় নীচে পড়ে মারা যায়।

দেখলাম অনেক মানুষ জন তাদের পুরো পরিবার নিয়ে এসে হাজির হয়েছে। পাথরের বড় বড় চাঙড় বেয়ে টাওয়ারের বেস পর্যন্ত ওঠা যায়। এই টুকুতেই সবাই খুব আনন্দ পাচ্ছে। আমিও কিছু বাচ্চার পেছন পেছন বেশ কিছুদূর উঠলাম।
সেখানে আরোও আধা ঘন্টা খানেক সময় কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার সামনে এখনও অনেক পথ বাকী, অনেক কিছু দেখার বাকী। পরের গন্তব্য ইয়েলো স্টোন ন্যাশানাল পার্ক, ওয়াইওমিং।

আমার পরবর্তি গন্তব্য ওয়াইওমিংয়ে অবস্থিত বিখ্যাত ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। সেখানে রকি পর্বতমালার মাঝে ওয়াইওমিং এবং মনটানার সীমান্তে অবস্থিত ছোট্ট শহর ওয়েস্ট ইয়েলোস্টোনে রাতে থাকার পরিকল্পনা। ডেভিলস টাওয়ার থেকে ইয়েলোস্টোন পার্ক ৫৫০ মাইল। কিন্তু গ্রীষ্মকালে সূর্য ডুবতে ডুবতে আটটা বাজে। সুতরাং আমি খুব একটা চিন্তিত নই। বড় জোর ঘন্টা সাতেকের ড্রাইভ। রাত হবার আগে সহজেই পৌঁছে যেতে পারব।
মনটানার ভেতর দিয়ে ইন্টারস্টেট ফ্রি ওয়ে ৯০ নিয়ে এগিয়ে যাই লিভিংস্টোন পর্যন্ত, যেখানে গিয়ে পেলাম হাইওয়ে ৮৯। এই রাস্তাই আমাকে নিয়ে গেল ওয়াইওমিংয়ের দক্ষিণে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত ইয়েলোস্টোন পার্কে। আমেরিকায় অনেক ন্যাশানাল পার্ক আছে কিন্তু তাদের মধ্যে এই পার্কটির একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একাধারে অপুর্ব এবং মনমুগ্ধকর। নানা ধরনের গাছ পালা এবং উদ্ভিদের যে সমারোহ এখানে চোখে পড়ে তা না দেখলে তার সম্পূর্ণ সৌন্দর্যটা অনুভব করা কষ্টকর। কিন্তু এই স্থানটিকে ১৮৭২ সালে আমেরিকার প্রথম ন্যাশানাল পার্ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবার পেছনে প্রধান কারণ ছিল গেইসার (এক ধরনের বিশেষ জল্প্রবাহ যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর উদ্গীরিত হয়)।

ওল্ড ফেইথফুল গেইসার
এখানে অবস্থিত একটি গেইসার – ওল্ড ফেইথফুল যা সমুদ্র সীমার এক মাইল উঁচুতে অবস্থিত এবং গড়ে প্রতি ৯১ মিনিট পর পর পানি উদ্গীরন করে – পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভৌগলিক ফিচার হিসাবে পরিগণিত। এই গেইসারটির উদ্গীরনের উচ্চতা হচ্ছে ১৮৫ ফুট। পৃথিবীর অধিকাংশ গেইসার এই পার্কে অবস্থিত। আমার মনে আছে ছোটবেলায় স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম গেইসাররা একটা ধরাবাঁধা সময় পর পর উদ্গীরিত হয়। কিন্তু এখানে এসে ভিন্ন তথ্য পেলাম। গেইসাররা আসলে কোন ধরাবাঁধা সময় পর পর উদ্গীরিত হয় না, বরং একটা সময়সীমার মধ্যে হয়। ওল্ড ফেইথফুল উদ্গীরিত হয় প্রতি ৪৫ থেকে ১২৫ মিনিটের মধ্যে। ওল্ড ফেইথফুলে আমি যখন পৌঁছালাম তার কিছুক্ষন আগেই একটা উদ্গীরন হয়ে গেছে। ফলে আমাকে প্রায় এক ঘন্টার মত অপেক্ষা করতে হল। কিন্তু যা দেখলাম তাতে আমার অপেক্ষা করাটা ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা স্বার্থক।

এই পার্কে প্রচুর হট স্প্রিংগস আছে, যেখানে পানি সারাক্ষণ ফুটছে । কিছু বেশ বড় আবার কিছু খুব ছোট ছোট। দেখার মত দৃশ্য। দেখলাম সবাই খুব উপভোগ করছে প্রকৃতির এই অভিনব উপহার।
এই পার্কের ভেতরে অনেক কিছু করার আছে। অনেকেই হাইকিং, ক্যাম্পিং করে, আবার অনেকে আমার মত ভেতর দিয়ে ড্রাইভ করে ঘোরে। আমি ড্রাইভ করে যাবার সময় বেশ কিছু জীব জন্তু দেখলাম। তার মধ্যে বিশেষভাবে যাদের কথা উল্লেখ করতে হয় তারা হচ্ছে – এল্ক, বাইসন এবং গ্রিজলি বিয়ার।





সারাদিন ইয়েলোস্টোন পার্কে কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে ওয়েস্ট ইয়েলোস্টোনে এলাম। এটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত ছোট একটা শহর। রকি পর্বতমালায় ৭০০০ ফুট উপরে এর অবস্থান। মোটেল আগেই বুক করে এসেছি। ভাগ্য ভালো যে করেছিলাম। কারণ এসে দেখলাম সব হোটেল মোটেলে ভীষণ ভীড়।

ওয়েস্ট ইয়েলোস্টোন টাউন
এখানে থেকে পে ফোন ব্যবহার করে বাংলাদেশে বাবা-মাকে ফোন করলাম। তারা দু’ জনাই আমার খবর পাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। আমার বাবা নিজেই আমেরিকার বিশাল এক ম্যাপ কিনে কোথায় কি সব মুখস্ত করে ফেলেছেন। তার সাথে কথা বলে মনে হল এই সব পথ ঘাট তার মুখস্ত।
(পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে এক অজানা অচেনা ছোট পাহাড়ী শহরের এক ক্ষুদে মোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পে ফোনে বাবা- মায়ের সাথে কথা বলছি, সে দৃশ্য আজ যখন ভাবি আমার সমস্ত হৃদয় এক অসম্ভব ভালো লাগায় ভরে ওঠে। আমার বাবা চলে গেছেন কিন্তু তার সেই আগ্রহ উদ্দীপনা আজীবন আমার সঙ্গী হয়ে থাকবে।)
ইয়েলোস্টোন ন্যাশানাল পার্কের নিকটবর্তি পাহাড়ী শহর ওয়েস্ট ইয়েলোস্টোনে এক রাত থেকে পর দিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম। আমার পরবর্তি গন্তব্য স্পোকেন, যেখানে আমার চাকরী। সুতরাং আপাতত আমার যাত্রা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সিয়াটল হচ্ছে একেবারে পশ্চিম প্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগরের পাশে অবস্থিত ওয়াশিংটন স্টেটের সবচেয়ে বড় শহর। স্পোকেন থেকে সেটা প্রায় তিন শ’ মাইল দূরে। সুতরাং সিয়াটল না যাওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না যে আমি আমেরিকার পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত গেছি। ইচ্ছা আছে পরবর্তিতে সময় পেলেই গিয়ে ঘুরে আসব। সৌভাগ্যের ব্যাপার, সেখানে আমাকে একলা যেতে হয় নি। ততদিনে আমার নিঃসঙ্গতার পরিসমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু সেই কাহিনী পরে কখন।
ইয়েলোস্টোন পার্কে আরোও অনেক কিছু করবার এবং দেখবার থাকলেও আমার হাতে সময় খুব একটা নেই। এখান থেকে স্পোকেন প্রায় সাড়ে চার শ’ মাইল। দুপুরের দিকে রওনা দিলে সন্ধ্যার আগে পৌঁছে যাওয়া যাবে। সুতরাং হাতে কয়েক ঘন্টা সময় আছে। এই এলাকা থেকে চলে যাবার আগে আরেকটা স্থানে ঘুরে যাবার ইচ্ছা আমার।
মনটানার প্রথম স্টেট পার্ক হচ্ছে লুইস এন্ড ক্লার্ক ক্যাভার্নস স্টেট পার্ক। আমেরিকার উত্তর পশ্চিমের সবচেয়ে বিশাল লাইমস্টোন গুহাগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে লুইস এন্ড ক্লার্ক ক্যাভার্ন। ইন্টারস্টেট ৯০ তে উঠবার জন্য আমাকে বেশ খানিকটা উত্তরে যেতে হবে। পথেই পড়বে ক্যাভার্নটা। সুতরাং সময় নষ্ট হবে না। সেখানে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় সকাল দশটা। পার্কে ঢোকার পর সাড়ে তিন মাইলের মত যেতে হয় গুহার মুখ পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য। প্রতি আধা ঘন্টায় একটা করে ট্যুর যায়। ২ মাইল পথের ট্রেইল, ঘন্টা দুয়েক লাগে ঘুরে আসতে। যাদের এই ধরণের গুহায় যাবার অভিজ্ঞতা নেই তাদের অবশ্যই সুযোগ হলে একবার যাওয়া উচিৎ। ভেতরে নানা ধরণের এবং নানা রঙের পাথরের যে সমারোহ তা শিল্পীর কল্পনাকেও হার মানায়। ছবিতে দেখা আর বাস্তবে দেখায় অনেক ফারাক। সব মিলিয়ে এটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা।




সেখান থেকে বের হতে হতে দুপর পেরিয়ে গেল। দেখা দেখির পর্ব শেষ। এবার এই লম্বা যাত্রার পরিসমাপ্তি করা প্রয়োজন যদিও মনে হচ্ছিল আরোও কয়েক দিন এভাবে ঘুরতে খারাপ লাগত না। রুট ২ ধরে কিছুদূর গিয়ে ইন্টারস্টেট ৯০ ওয়েস্ট নিলাম। এখান থেকে সাড়ে তিন শ মাইল গেলে স্পোকেন। এর মধ্যে আর কোথাও থামার কোন পরিকল্পনা নেই কিন্তু যদি সুন্দর কিছু চোখে পরে তাহলে থামব।
এই পথটুকু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে অতুলনীয়। লোলো ন্যাশানাল ফরেস্টের ভেতর দিয়ে ড্রাইভ করে যাই। পথে খাবার জন্য এবং তেল নেবার জন্য থামলাম শুধু। এই এলাকা আইডাহো স্টেটের সীমানার মধ্যে পড়ে। আইডাহো এবং ওয়াশিংটন স্টেটের সীমান্তে অবস্থিত কোর দ্য এলেন একটি ভীষণ সুন্দর ছোট্ট শহর। সেখানে যখন পৌঁছালাম তখন বিকাল। উঁচু রাস্তার উপর থেকে শহরটা দেখেই হৃদয় উদবেলিত হয়ে উঠল। লেক কোর দ্য এলেন এবং স্পোকেন রিভারের সঙ্গমে অবস্থিত এই শহরটি ছবির মত সুন্দর। মনে হল স্পোকেনে না গিয়ে এখানে এলেই বুঝি ভালো হত। তবে মনে মনে হিসাব করে দেখলাম স্পোকেন থেকে এর দূরত্ব মাত্র পঁচিশ ত্রিশ মাইলের মত। যার অর্থ এখানে প্রায়ই ঘুরতে চলে আসা যাবে। কোর দ্য এলেনের নানা ধরণের আকর্ষনের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নিঃসন্দেহে কোর দ্য এলেন রিসোর্টে অবস্থিত ভাসমান বোর্ড ওয়াক।


কোর দ্য এলেন বোর্ড ওয়াক
এই ভাসমান বোর্ডওয়াকটি পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম। এটি লম্বায় ৩৩০০ ফুট এবং চওড়ায় ১২ ফুট এবং লেক কোর দ্য এলেনের মেরিনাটাকে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত করে আছে। বোর্ডওয়াকের মাঝে ৬০ ফুট লম্বা একটা অর্ধবৃত্তাকার ব্রিজের নীচ দিয়ে মেরিনাতে বোট যাতায়াত করে। রিসোর্টের অন্তর্ভুক্ত হলেও সাধারণ মানুষের এই বোর্ডওয়াকে যাবার ফ্রি এক্সেস আছে।

স্পোকেন, ওয়াশিংটন
বিকালের দিকে সেখান থেকে রওনা দিয়ে স্পোকেনে পৌঁছালাম, আধা ঘন্টার পথ। আগেই একটা হোটেল ঠিক করে রেখেছিলাম। ইচ্ছা কাজের জায়গার কাছে কোথাও একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করব। আসার আগেই কিছু খোঁজ খবর নিয়ে এসেছি শহরটা সম্বন্ধে। চারদিকে পাহাড় ঘেরা স্পোকেন রিভারের তীরে অবস্থিত এই শহরটা উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে সফল মাইনিং ডিসট্রিক্ট হিসাবে পরিগণিত। ফাদার’স ডে-র জন্মও এই শহর থেকে। শহরের জন সংখ্যা দুই লাখের মত।

মাউন্ট স্পোকেন
পরবর্তি কয়েক দিন ঘুরে অফিসের কাছাকাছি একটা এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙয়ের দোতলায় একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করলাম। আমার বাসার ঠিক সামনেই একটা খামার বাড়ী, সেখানে এক পাল ইমু পালা হয়। খুব ধীর স্থির গোবেচারা প্রাণী। দূরে দিগন্তে সেল্কার্ক পর্বতমালার অপুর্ব সুন্দর দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখার মত। কাছেই রয়েছে মাউন্ট স্পোকেন, উচ্চতা ৬০০০ ফুট (এক মাইলের মত)। এই পাহাড়ের চুড়ায় গাড়ী নিয়ে উঠে যাওয়া যায়। দু’ পাশে জন বসতি আছে যদিও খুব সামান্যই।
শুরু হল আমার নতুন জীবন এক নতুন শহরে, নতুন মানুষদের মাঝে। দিনে অফিস করি আর রাতে এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের জিমনেসিয়ামে গিয়ে ব্যায়াম করি। ব্যাচেলর জীবনের অনিয়মে উল্টো পালটা খেয়ে শরীরের চেকনাই কিছু বেড়েছে। পাঁচ বছর হয়ে গেছে, দেশে যাই নি। বাবা-মা যাবার জন্য জোর করছে। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এই অপুর্ব পরিবেশে কালো চুল আর কালো চোখের মায়াবী চেহারার এক বঙ্গললনা যোগ হলে জীবন হয়ে উঠবে স্বপ্ন। আমি স্বপ্নচারী হয়ে পড়ি।