আমেরিকার পূর্ব থেকে পশ্চিমে
শুজা রশীদ
১৯৯৭ সাল। আগস্টের মাঝামাঝি। তখন পর্যন্ত সব কিছু বেশ ভালোই যাচ্ছিল। H1B তে বিদেশী কন্সাল্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করি আমেরিকাতে। তখন ফিডেলিটি ইনভেস্টমেন্ট আমার ক্লায়েন্ট। তাদের হেডকোয়ার্টার ম্যাসাচুসেটসের মার্লবোরো নামে একটা ছোট শহরে। এটা বোস্টন থেকে প্রায় বিশ মাইলের মত দূরে। তখনও ব্যাচেলর এবং অন্যান্য ব্যাচেলর ভারতীয়দের সাথে খুব একটা উড়ু উড়ু জীবন যাপন করছিলাম। টাকা পয়সা যে খুব একটা ভালো পাচ্ছিলাম তা নয়। যে কন্সাল্টিং কম্পানির হয়ে কাজ করছিলাম তারাই আয়ের সিংহ ভাগ রেখে দিচ্ছিল। কেউ কোন আপত্তি করি না কারণ ইচ্ছা তাদের মারফতে গ্রীণ কার্ডের জন্য আবেদন করব। একবার কার্ড পেয়ে গেলে আর ওদের ধার কে ধারবে। সব হতে হতে বছর তিন চার লেগে যায়। কটা বছর একটু চোখ কান বুজে কাটিয়ে দেয়া।

তারপর একদিন একটা ঝামেলা হল কাজে। এক শ্বেতাঙ্গ কর্মীর উগ্র ব্যবহারের প্রতিবাদ করায় সে তার প্রভাব খাটিয়ে আমার মহিলা ম্যানাজেরকে বাধ্য করল আমার কন্ট্রাক্ট ক্যান্সেল করতে। আমাকে দুই সপ্তাহের নোটিশ দেয়া হল। ম্যানেজারের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তের কারণটা আমি ঠিক ধরতে পারি নি। খুব সম্ভবত তার উপরের কারো কাছ থেকে চাপ এসে থাকবে।
যাইহোক, আমার কন্সাল্টিং কম্পানীকে আমি সব খুলে বললাম। মালিক ভারতীয়। মানুষ মন্দ নয়। তার হাতে তখন দুটি নতুন কন্ট্রাক্ট আছে। একটি স্থানীয় এক I.T. কম্পানিতে, অন্যটি আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে, স্পোকেনে, একটি বিদ্যুত কম্পানীতে। স্পোকেন ওয়াশিংটন স্টেটের একটি বড় শহর। পশ্চিম তীরের পরিচিত শহর সিয়াটল থেকে শ’ তিনেক মাইল পূর্বে। প্রায় দুই লাখ মানুষের বাস। সিদ্ধান্ত নিতে মুহূর্তের বেশী লাগে না। একটা পরিবর্তন চাইছিলাম। এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন করে অন্য কোথাও ঘর বাঁধতে চাইছিলাম। তাছাড়া একা মানুষ, ঘুরে বেড়ানোর এটাইতো সুযোগ।
আমার নতুন কাজ শুরু হবে এক সপ্তাহ পর। লং ড্রাইভ করতে সব সময়ই পছন্দ করি। এইরকম একটা সুযোগ হেলায় হারাতে মন চাইল না। ফ্লাই করে গেলে ঝট করে চলে যাওয়া যাবে, ঘন্টা ছয়েকের পথ, কিন্তু কিছুই তো দেখা হবে না। ম্যাপ বের করে একটু হিসাব কিতাব করলাম। বোস্টন থেকে স্পোকেন তিন হাজার মাইলের মত দূরত্ব। চারদিকে পাহাড় ঘেরা শহর। ওয়াশিংটন এবং আইডাহোর জাংশনে অবস্থিত শহর, অরেগন এবং কানাডা থেকে খুব দূরে নয়। আমার কম্পানীকে জানালাম ফ্লাই করে না গিয়ে আমি ড্রাইভ করে যাবো। আমার সেখানে যাবার খরচাদি তাদেরকে তো দিতেই হত। আমি ড্রাইভ করে গেলে খরচ বেশী হবার কোন কারণ নেই। তারা আমার যাবার সমস্ত খরচ – তেল, থাকা এবং খাওয়া – বহন করতে সম্মত হল। এবার আমি আমেরিকার ম্যাপ, ট্যুর বই ইত্যাদি নিয়ে বসে গেলাম প্ল্যান করতে। অচেনা পথ, আগে থেকে হোটেল/মোটেল ঠিক করে রাখাই ভালো। বিশেষ করে গ্রীষ্মকাল। সবাই বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে। দেখা যাবে কোথাও থাকার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। বিরাট ঝামেলায় পড়ে যাব। ম্যাপ দেখে প্রতিদিন কতখানি পথ যাবো তার একটা খসড়া হিসাব করলাম। ইচ্ছা পথে আকর্ষনীয় স্থানগুলো দেখতে দেখতে যাবো। সুতরাং এমনভাবে প্ল্যান করলাম যেন প্রতিদিন অর্ধেক দিন ড্রাইভ করব এবং বাকী অর্ধেক দিন যেখানে নোঙর ফেলব সেখানটা ঘুরে ঘুরে দেখব।
জিনিষপত্র বলতে তেমন কিছুই নেই। খাটও কখন কিনিনি। কাজের জন্য কখন কোথায় যেতে হয়। খাট-ফাট নিয়ে খামাখা ঝামেলা। মেঝেতে তোষক পেতেই আরামসে ঘুম দিতাম। কয়েকটা হাঁড়ি পাতিল অবশ্য ছিলাম। রান্না বান্নায় হাত ছিল জঘন্য কিন্তু বাইরের খাবার রোজ খাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। এমনিতেই হাই ক্যালোরি খাবার খেয়ে খেয়ে শরীরের চেকনাই বেড়ে গেছে। দেশ থেকে বছর পাঁচেক আগে যখন বেরিয়েছিলাম তখন ছিলাম মাত্র ১২৫ পাউন্ড। ইউনিভার্সিটিতে পড়াশূনার সময় দক্ষিণ ভারতীয় এক বয়েসী পি.এইচ.ডি স্টুডেন্ট আমার রুমমেট ছিল। তার নাম ছিল পিলাকা ভি মুর্তি, আমাদের সবার মুর্তি দা। তিনি ভয়ানক পরোটা বানাতে এবং আলু ভাজি করতে পারতেন। হররোজ তার হাতের খাবার খেয়ে খেয়ে কোরবাণির গরুর মত ফুলে গিয়েছিলাম। পড়া শেষ করে কাজ নিয়ে তার কাছ থেকে দূরে চলে আসার পর আবার একটু একটু করে চেকনাই কমছে। যাইহোক, হাঁড়ি পাতিল ছাড়াও আমার লেপ, তোষক, বালিশ, জামা-কাপড়, কম্পিউটার জাতীয় জিনিষপত্র সব মিলিয়ে একেবারে নগন্য ছিল না। সব গোছগাছ করতে কয়েক ঘন্টা গেল।
নতুন কাজের যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনও আগের কাজ চলছে। দুই সপ্তাহের নোটিশ তখনও শেষ হয় নি। ঠিক শেষ হবার আগের দিন ম্যানেজার আমাকে ডেকে আরোও কিছুদিন থাকার জন্য অনুরোধ করল। আমি সরাসরি তাকে জানিয়ে দিলাম আমার জন্য নতুন একটি কাজ ইতিমধ্যেই রেডী হয়ে আছে। এখন আর পিছিয়ে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। মনে মনে খুব আনন্দ পেলাম। কোন অপরাধ ছাড়াই যখন কন্ট্রাক্ট ক্যান্সেল করে দিয়েছিলে তখন তোমার মাথায় কি চিন্তা চলছিল। জানি, সে বাধ্য হয়ে চাপের মুখে পড়েই করেছিল কিন্তু একজন ম্যানেজার হিসাবে তার আরোও মনের জোর থাকা উচিৎ। যাইহোক, পরদিন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি শেষবারের মত ফিডেলিটির প্রাঙ্গন ত্যাগ করি। ভবিষ্যতে আর কখনও সেখানে কাজ করা হয় নি।
পরদিন সকালে গাড়ীতে এক এক করে সব জিনিষপত্র তুললাম। দেখা গেল যতখানি অল্প জিনিষ ভেবেছিলাম ততখানি অল্প নয়। আমার ১৯৯৬ মডেলের টয়োটা করল্লা বিশাল গাড়ি ছিল তা নয় কিন্তু ধবধবে সাদা রঙে তাকে একটা বলাকার মত লাগত। আমি আদর করে আমার প্রথম উপন্যাস নীলির সাথে মিলিয়ে তার নাম দিয়েছিলাম নীলি। আমার দুই রুমমেটের সাথে গলা মিলিয়ে, তাদেরকে বিদায় জানিয়ে গাড়ীতে উঠলাম। গাড়ির ট্রাংক সহ ভেতরে জিনিষপত্রে একেবারে কানায় কানায় পূর্ন, একমাত্র ড্রাইভারের সিটটাই ফাঁকা। আমার মনের মধ্যে খুব আবাগের আলোড়ন চলছে। বেশ লম্বা লম্বা ড্রাইভিং ইতিমধ্যেই করেছি কিন্তু এতো লম্বা নয়। ভীষন উত্তেজনা এবং আনন্দ দুটোই একসাথে অনুভব করছি। শেষবারের মত দাঁড়িয়ে থাকা ধীরেন এবং শচীনকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে গাড়ী চালিয়ে দিলাম। তিন হাজার মাইল। দিন পাঁচেকের যাত্রা। অনেক কিছু দেখা হবে। কোন বিপদ আপদ না হলেই হয়।

যাত্রা শুরু করবার কয়েক দিন আগেই বিস্তারিত রুট প্ল্যান করে রেখেছিলাম। প্ল্যান খুব সাদা মাটা । নিউ জার্সি পর্যন্ত ড্রাইভ করে ফ্রিওয়ে ৮০ নেব। সোজা ড্রাইভ করতে থাকলে ওহাইওর কোথাও গিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে ৯০ পাওয়া যাবে। এটা ধরে সোজা চলতে থাকলেই হবে কারণ ৯০ আমেরিকার পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম পর্যন্ত চলে গেছে। পথে অবশ্য পথে একটা ব্যাতিক্রম করার কথা। মিনেসোটার রাজধানী মিনিয়াপোলিসে একটু ঘুরে যেতে হবে। সেখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে একটি মেয়ের সাথে দেখা করে যাবার হুকুম এসেছে বাংলাদেশ থেকে। বাবা-মা দু জনারই খুব আগ্রহ। সেই যখন ঐ পথে যাচ্ছিস, একটু দেখাটা করেই যা। রাজী হয়ে গেছি। কোথায় কার ভাগ্য বাঁধা কে বলতে পারে?
প্রথম দিনে আমি খুব বেশী একটা ড্রাইভ করলাম না। অনেক দিন লম্বা ড্রাইভের অভ্যাস নেই। হঠাৎ করে বেশী চাপ নিয়ে শেষে একটা বিপদ আপদ না হয়। বিশেষ করে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনা তো থাকেই। মাত্র ৩৫০ মাইল গিয়ে পেন্সিলভানিয়ার ব্লুমসবার্গে থামলাম সেদিনের জন্য।

রাত হতে অনেক বাকী। হাতে ঘোরা ফেরা করার যথেষ্ট সময়। পেন্সিলভানিয়ার বিখ্যাত অমিশ ল্যান্ড না দেখে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। ল্যঙ্কাস্টার কাউন্টি, যেখানে তাদের প্রধান আবাস সেটা মাত্র নব্বই মাইল দূরে। ঘন্টা দেড়েকের বেশী লাগার কথা নয়। গাড়ী ছুটিয়ে চলে গেলাম। অমিশরা জাতীতে ডাচ। আধুনিকতা থেকে যতখানি দূরে থাকা সম্ভব ততখানি দূরত্ব তৈরী করে জীবন যাপন করে তারা। সব কিছু এখনও আগের নিয়মেই চলে তাদের জগতে। ঘোড়ার গাড়িতে করে তাদেরকে শহরে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। বেশ একটা অভিনব অভিজ্ঞতা।
পরদিনই আমার মিনিয়াপলিসের ইউনিভার্সিটিতে যাবার কথা। ব্লুমসবার্গ থেকে অনেক পথ, প্রায় ১২০০ মাইল। একদিনে ড্রাইভ করার জন্য অনেক লম্বা পথ। অনেকক্ষন ড্রাইভ করতে হবে। মোটেলে ফিরে গিয়ে কোন রকমে কিছু খেয়ে নিয়ে বিছান্য চলে গেলাম। ভালো ঘুম না হলে পরদিন এতো পথ যাওয়া হয়ত সম্ভব হবে না। গড়ে ৮০ মাইলে গেলেও প্রায় ১৫ ঘন্টার ড্রাইভ।
যখন ড্রাইভ করে ঘুরি তখন আমার একটা স্বভাব হচ্ছে পথে ‘রোড সাইড এট্রাকশন’ গুলো সব দেখতে দেখতে যাওয়া। এই জাতীয় দর্শণীয় বস্তুগুলো খুব বিখ্যাত না হলেও ঘুরে বেড়ানোর আনন্দটা বেশ কয়েক গুন বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু পরদিন মিনিয়াপোলিস যাবার পথে লম্বা ড্রাইভের কথা ভেবে ‘এট্রাকশন’ দেখা তো দূরে থাক, একমাত্র তেল নেয়া এবং খাবার কেনা ছাড়া কোথাও থামলাম না।

ইন্টারস্টেট ৯০ ধরে এগিয়ে চললাম। পথে মিশিগানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ডেট্রয়েট মিশিগানের সবচেয়ে বড় শহর। তার পাশ দিয়ে যাবার সময় অনেক স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। ডেট্রয়েট থেকে মাইল ত্রিশেক উত্তরের ছোট শহর রচেস্টার হিলসে অবস্থিত ওকল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে তিন বছর পড়াশোনা করেছি, কম্পিটার সায়েন্সে মাস্টার্স। দুই বছর পড়েছিলাম, আরেক বছর কো-অপ জব করেছিলাম।
পাশ করে চাকরী নিয়ে চলে যাবার পর কারো সাথেই আর তেমন যোগাযোগ নেই। কিন্তু পড়ার সময় প্রচুর বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে ফেলেছিলাম। অধিকাংশই অবশ্য ছিল ভারতীয় এবং হাতে গোনা কয়েকজন পাকিস্থানী। মনে পড়ে যায় প্রথম এসে একটা দুই বেডরুমের এপার্টমেন্টে আমরা ছয়জন থেকেছিলাম প্রায় বছর খানেক। দুই বেড রুমে দুই জন থাকত আর আমরা বাকীরা সব লিভিংরুমে কার্পেটে তোষক বিছিয়ে লাইন দিয়ে ঘুমাতাম। মাসে দুই শ’ ডলার দিতাম। আমাদের সাথে এক পাকিস্থানী ছেলে ছিল। তার সাথে প্রায়ই খুটখাট লেগে থাকত। তার কথা শুনেই বুঝতাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে তার জ্ঞান খুবই সীমিত ছিল। এই নিয়ে বাজে মন্তব্য করায় মারপিট হতে যা বাকী থেকেছে।

বিশেষ করে মনে পড়ে ম্যাট গুরনসের কথা। সে ছিল আমার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট। আইরিশ, শ্বেতাঙ্গ। তার একটা আদ্যিকালের ভ্যান গাড়ী ছিল। সেই গাড়ীতে সে আমাকে গাড়ী চালানো শেখায়। পরে আমি তাদের পারিবারিক গাড়ী – একটা ডজ অমনি – কিনে নেই পাঁচশ ডলারে। এটা ছিল স্টীক শিফট। ২৫০ হাজার মাইল। আমার আরেক রুম মেট ছিল রাজেশ। সে গাড়ী কিনবে। কিন্তু গাড়ী দেখতে নিয়ে যাবার মানুষ নেই। আমাকে বলল আমি যদি তাকে একটু নিয়ে যেতে পারি। একটা পুরানো গাড়ী নাকি তার খুব পছন্দ হয়েছে। তার আগে আমি কখন ফ্রিওয়েতে উঠিনি। স্থানীয় রাস্তায় গাড়ী চালাই। কিন্তু রাজেশের অনুরোধে রাজী হয়ে গেলাম। তখন শীতকাল। রাস্তায় বরফ পড়ে পিছলা হয়ে ছিল। ফ্রি ওয়ে পর্যন্ত যেতেও পারি নি। ওঠার মুখেই বরফে পিছলে একেবারে রাস্তার পাশে গাড়ী নিয়ে উলটে পড়লাম। রাজেশের কপাল কেটেছিল কিন্তু আমার কোন ক্ষতি হয় নি। কিন্তু গাড়ীটা জলাঞ্জলী দিতে হল। ইন্সুরেন্স ছিল শুধু লায়াবিলিটি। গাড়ীটা হারিয়ে খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। হাতে টাকা পয়সা ছিল না যে আরেকটা গাড়ী কিনব।
মনে পড়ে মুর্তি দার কথা। আমার চেয়ে বয়েসে বেশ বড়। এসেছিলেন পি এইচ ডি করতে। তাকে আমি শিখেয়িছিলাম গাড়ী চালাতে। ভদ্রলোক খুব নার্ভাস হয়ে থাকতেন এবং প্রায়ই গাড়ী চালাতে চালাতে ভয় কাটানোর জন্য হেঁড়ে গলায় গান গাইতে শুরু করতেন। তার পাশে বসে আমার হৃতকম্পন বেড়ে যেত। না জানি কার গায়ে গিয়ে গাড়ী তুলে দেয়।
ভেবেছিলাম যদি একটু সময় পাই তাহলে ঝট করে ইউনিভার্সিটি থেকে ঘুরে যাবো। পরিচিত কেউ আছে কিনা জানা নেই কিন্তু স্কুলের ভেতরে একটু ঘুরতেও ভালো লাগত। এতো সুন্দর ছিল প্রাংঙ্গনটা! প্রায়ই হরিণের দল বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে চলাফেরা করত।
সময়ের অভাবে এই যাত্রায় আর সেই দিকে যাওয়া হল না।

মিনিয়াপোলিসে যখন মোটেলে পৌঁছালাম তখন বেশ রাত। দীর্ঘ সময় ড্রাইভ করে ক্লান্ত হয়ে ছিলাম। কোন রকমে মোটেলের পাশের একটা রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু একটা খেয়ে নিয়ে গোসল সেরেই বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। প্রায় ষোল ঘন্টার মত গাড়িতে ছিলাম। অভ্যাস নেই। শরীরে ব্যাথা হয়ে গেছে। দূর পাল্লার ট্রাক যারা চালায় তারা কিভাবে দিনের পর দিনে সারা দিন ধরে ড্রাইভ করে কে জানে। পরদিন সকালে মিনিয়াপোলিস ইউনিভার্সিটিতে মেয়েটার সাথে দেখা করত যাওয়ার কথা। সেটা তাড়াতাড়ি সেরে আবার আমার যাত্রা শুরু করতে চাই। অনেক ইন্টারেস্টিং জায়গা পড়ে আছে সামনে। কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম খুব রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন। ভ্রমনের জন্য চমৎকার দিন। দ্রুত দাঁত ব্রাশ এবং শেভ করে জামা কাপড় পড়ে গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার উদ্দ্যেশ্যে। পথে এক দোকানে থেমে কিছু ফুল কিনে নিলাম। সেন্ট পল এবং মিনিয়াপোলিস এখানকার দুটি বড় শহর, প্রায় পাশাপাশি, যে কারনে তাদেরকে টুইন সিটি বলা হয়। ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার যথেষ্ট নাম ডাক আছে। ক্যাম্পাস্টা খুঁজে বের করতে কিছু সময় গেল। রাস্তা ঘাট খুঁজে পাওয়া নিয়ে সব সময়েই একটু সমস্যার মধ্যে থাকি। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটির হাউজিং বিল্ডিঙগুলো খুঁজে পেলাম। পার্কিং লটে গাড়ী রেখে বাইরে বেরিয়ে এসে আমার টনক নড়ল। একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি। তাকে নিয়ে কোথাও যাওয়াটাই তো রীতি। কিন্তু আমার গাড়ীতে ড্রাইভারের সীট ছাড়া আর সব স্থানই মালপত্রে ভর্তি। যার অর্থ গাড়ীতে কাউকে তোলা সম্ভব হবে না। মোটেলে হয়ত কিছু রেখে আসা যেত কিন্তু আবার মালপত্র নামানোর চিন্তা মাথাতে আসেই নি। যা হবার হবে। এখন আর চিন্তা করে কি লাভ?

মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে দেয়া এপার্টমেন্ট নাম্বারটা খুঁজে বের করলাম। কলিং বেল বাজাতে একটি সুদর্শনা তরুণী দরজা খুলে দিল। তার বয়েস মনে হল বাইশ তেইশ হবে। তার সাথে আরেকজন তরুণকে দেখলাম, যার বয়েস আরেকটু বেশী মনে হল। আমার আসার কথা তাদেরকে আগেই জানানো হয়েছিল সুতরাং তারা আমাকে আশা করছিল। কিন্তু আমার কাছে মেয়েটার কোন ছবি ছিল না। এই মেয়েটির সাথেই পরিচিত হতে এসেছি কিনা বুঝতে পারলাম না। তাই বাধ্য হয়ে বিনীতভাবে নিজের পরিচয় দিলাম। তারা আমাকে লিভিংরুমে বসতে বলে চলে গেল। মিনিট খানেক পর আরেকটি মেয়ে, যার বয়েস মনে হল বিশের উপর হবে না, সুন্দরী, সপ্রতিভ, লিভিংরুমে এসে ঢুকল। সে তার পরিচয় দিল। তার নাম জিনিয়া। বুঝলাম এই মেয়েটির সাথেই দেখা করতে এসেছি। আমরা সেখানে অল্প কিছুক্ষন আলাপ করলাম। তার সাথে কথা বলে ভালো লাগল যদিও মনে হল আমি যা আশা করেছিলাম তার বয়েস তার চেয়ে যথেষ্ট কম।
আমি একসাথে লাঞ্চ করবার প্রস্তাব দিলাম। স্বাভাবিকভাবেই তারা আশা করেছিল আমি জিনিয়াকে আমার গাড়িতে করে নিয়ে যাবো। তার রুমমেট দু’ জনের আমাদের সাথে আসার কোন প্ল্যান ছিল না। আমি লজ্জিতভাবে তাদেরকে আমার গাড়ির ভেতরের স্থানের স্বল্পতার কথা বললাম। তারা ইতিমধ্যে নিজেদের পরিচয় দিয়েছে এবং জানিয়েছে যে তারা স্বামী-স্ত্রী। তাদেরকেই অনুরোধ করলাম জিনিয়াকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসার জন্য। তারা প্রথমে খুব একটা আগ্রহ না দেখালেও যখন বুঝল আমি সম্ববত সত্য কথা বলছি তখন আর কোন আপত্তি করল না।
আমরা সবাই মিলে কাছেই অবস্থিত একটা পিজ্জারিওতে গেলাম। আমি অনেক কিছু অর্ডার দিতে চাইলাম কিন্তু তারা কেউ তেমন কিছু খেতে চাইল না। আমরা চা-নাস্তা জাতীয় কিছু খেলাম। কথা বার্তা মোটামুটি হল। সেখান থেকে তারা আমাকে নিকটবর্তি একটা পার্কে নিয়ে গেল। আমরা সবাই আলাপে এমন মশগুল হয়ে গেলাম যে মনে হল তাদেরকে আমি যেন কত যুগ ধরে চিনি।
ঘন্টা খানেক কাটিয়ে আমি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমাকে পথে নামতে হবে। সেই দিন আমার সাউথ ডাকোটার র্যাপিড সিটিতে গিয়ে নোঙর ফেলার কথা। ছয় শ’ মাইলের মত ড্রাইভ, কম করে হলেও। ইতিমধ্যেই দুপর দুইটার মত বেজে গেছে। রাতে ড্রাইভ করতে পছন্দ করি না। বিদায় নেবার এটাই সময়।
আবারও পথ হারিয়ে কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে সময় নষ্ট করে শেষ পর্যন্ত এক্সপ্রেস ওয়ে খুঁজে পেয়ে যখন উঠে ভোঁ করে গাড়ী ছুটিয়ে দিলাম তখনই বুঝলাম আজ আর র্যাপিড সিটি পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হবে না। সন্ধ্যার পর আমি নিতান্ত বাধ্য না হলে ড্রাইভ করছিলাম না। অচেনা অজানা জায়গা, কোন রকম বিপদে আপদে পড়লে সমস্যায় পড়ে যাবো। বেশী ভয় ছিল গাড়ী নিয়ে। হাজার হোক যন্ত্র, সমস্যাতো হতেই পারে। আমি র্যাপিড সিটিতে যে মোটেলে আগেই রুম রিজার্ভ করে রেখেছিলাম সেখানে ফোন করে রিজার্ভেশন বদলে পরের দিন করে নিলাম। ঠিক করলাম ড্রাইভ করতে করতে যখন মনে করব রাতের জন্য থামা দরকার তখন সবচেয়ে নিকটবর্তি কোন শহরে থেমে হোটেল কিংবা মোটেল কিছু একটা খুঁজে নিয়ে রাতটা কাটিয়ে দেব। ধরে নিলাম যদিও গ্রীষ্ম এবং এই সময় সাধারণত মোটেল পাওয়া কঠিন তারপরও এই সমস্ত এলাকায় প্রচুর হোটেল এবং মোটেল আছে। সুতরাং একটা কামরা পাওয়া খুব সমস্যা হবার কথা নয়। সময় যখন এলো তখন টের পেলাম, আমার ধারণা কতখানি ভুল ছিল।
মিনিয়াপোলিস থেকে বের হয়ে হাইওয়ে ৯০ ধরে নাক বরাবর ড্রাইভ করতে থাকি।পরবর্তি বড় শহর সিয়ক্স ফলস – মিনেসোটা, আইওয়া এবং সাউথ ডাকোটার সন্ধিস্থলে অবস্থিত। আমার অবশ্য সেখানে থাকবার কোন প্ল্যান নেই। ম্যাপ ঘাটাঘাটি করে এবং ট্রাভেল গাইড পড়ে যা বুঝেছি সাউথ ডাকোটা হচ্ছে টুরিজমের স্বর্গ, বিশেষ করে আমার মত প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য। র্যাপিড সিটির আশেপাশেই দর্শনীয় বস্তুর সমারোহ, যার মধ্যে কয়েকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – মাউন্ট রাশমোর মেমোরিয়াল, ব্যাড ল্যান্ডস ন্যাশানাল পার্ক, ব্ল্যাক হিলস ন্যাশানাল ফরেস্ট, রেপ্টাইল গার্ডেন্স, ক্রেজি হর্স মেমোরিয়াল, ডাইনোসর পার্ক, ডেভিলস টাওয়ার (ওয়াওমিংয়ে কিন্তু র্যাপিড সিটি থেকে বেশী দূরে নয়)। এই কারণেই আমি আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম র্যাপিড সিটিতে একদিন থাকার। কিন্তু মিনিয়াপোলিস থেকে বের হতে হতে বিকেল হয়ে যাওয়ায় ঐ দিন আর র্যাপিড সিটি পর্যন্ত ড্রাইভ করে যাবো না বলেই সিদ্ধান্ত নেই। মোটেলের রিজার্ভেশন পালটে পরের দিন করে দেই। ইচ্ছা সন্ধ্যা পর্যন্ত ড্রাইভ করে কাছাকাছি কোন শহরে গিয়ে রাতের জন্য একটা ঠাঁই খুঁজে নেব।
সিয়ক্স ফলস প্রায় তিন শ’ মাইল মিনিয়াপোলিস থেকে। সেখানে পৌঁছাতে সন্ধ্যা সাতটার মত বেজে গেল। আলো থাকবে আরোও ঘন্টা দুয়েক। সেখানে একটা রেস্টুরেন্টে বসে কিছু খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এখান থেকে র্যাপিড সিটি আরোও তিন শ মাইলের মত – প্রায় পাঁচ শ কিলোমিটার। ইচ্ছা অন্তত পক্ষে অর্ধেকটা পথ এগিয়ে থাকা। শ’ দেড়েক মাইল যাবার পর চ্যাম্বারলেইন নামে একটা শহরের কাছে মিসৌরি নদী পেরিয়ে যাবার পর ঠিক করলাম পরবর্তি শহরেই থামব। এদিকে পাশাপাশি দুই শহরের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ত্রিশ চল্লিশ মাইলের মত।
পরের শহরে ঢুকে দেখলাম আকারে ছোটখাট হলেও সেখানে বেশ কয়েকটা হোটেল এবং মোটেল আছে। কিন্তু খোঁজাখুঁজি করে কোন কামরা পাওয়া গেল না। চিন্তার কিছু নেই। রাত হতে তখনও বাকী। পরের শহরের উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় চল্লিশ মাইল পর আরেকটা মোটামুটি বড় সড় শহর চোখে পড়ল। এখানেও ভালো কোন হোটেল কিংবা মোটেলে কোন কামরা পাওয়া গেল না। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি একটু চিন্তায় পড়ে যাচ্ছি। পরবর্তি শহর কত দূরে কে জানে। কিন্তু যত দূরেই হোক সেখানে পৌঁছে যেভাবেই হোক একটা কিছু জোটাতে হবে।
যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে একটু বেশীই ড্রাইভ করতে হল পরবর্তি শহরে পৌঁছানোর জন্য। ততক্ষণে ঘোর অন্ধকার। এখানে খান তিনেক মোটামুটি ভালো মোটেল আছে। কিন্তু কোথাও কোন কামরা ফাঁকা পাওয়া গেল না। রিসেপশনের একটা তরুণ আমাকে বলল শহরের অন্য পাশে একটা ছোট মোটেল আছে। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে। নীচুমানের মোটেলে থাকার কোন ইচ্ছা ছিল না কিন্তু উপায় নেই। মিনিট দুই তিনের ড্রাইভ। বাইরে থেকে দেখেই খুব একটা সুবিধাজনক মনে হল না। চারদিকে অন্ধকারের মধ্যে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট কামরা, রিসেপশনটা এক পাশে, তার মধ্যে মৃদু আলো জ্বলছে। ভেতরে ঢুকে কামরা ভাড়া করার সময়েই খেয়াল করলাম পাশেই বার। যারা সেখানে বসে মদ্য পান করছে তাদেরকে দেখে খুব সুবিধার মনে হল না। আমার দিকে কয়েক জন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আমি কোন রকমে চাবি নিয়ে সেখান থেকে সটকে পড়লাম। কামরার সামনেই গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা। গাড়ী বন্ধ করে রুমের ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। একটু পরে শূনলাম বাইরে থেকে মদ্যপদের একজন চিৎকার করে বলছে, “যেখান থেক এসেছো সেখানে চলে যাও।” হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা সাধারণত কৃষ্ণাঙ্গদেরকে লক্ষ্য করে এই জাতীয় কথা বলে। (আফ্রিকা থেকে এসেছিলে, আবার সেখানেই ফিরে যাও)। আমি ধারণা করলাম এই গর্দভ হয়ত সাউথ ইস্ট এশীয়ান এবং কৃষ্ণাঙ্গদের পার্থক্য বোঝে না। আমারও বুকে এমন পাটা নেই যে তাকে শেখানোর চেষ্টা করব। ভয় হচ্ছিল রাতে কোন ঝুট ঝামেলা না করার চেষ্টা করে। আসলেই শঙ্কিত হবার কোন কারণ আছে কিনা সঠিক জানি না কিন্তু সাবধানের মার নেই। সেই রাতে আমি আর দরজার বাইরে পা রাখলাম না। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ভোর বেলা ঘুম ভাঙল। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।
আমি দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে গাড়ীতে চাপলাম। ইচ্ছা সকাল হবার আগেই র্যাপিড সিটিতে পৌঁছানো। সেখানে কত কিছু দেখার আছে। সময় হবে কিনা ভাবছি।


ব্যাড ল্যান্ডস ন্যাশনাল পার্ক একটি অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক স্থান যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। বাতাস এবং পানির অত্যাচারে এই ভুমি এমনভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে যে তা হয়ে উঠেছে দৃষ্টি নন্দন এবং আকর্ষনীয় – তার রুক্ষতা দিয়ে। এখানে যেমন আছে সুউচ্চ পাহাড়ের পাথুরে চুড়া তেমনই আছে গভীর উপত্যকা আর বয়ে যাওয়া চিকন স্রোতস্বিনী। ক্রমাগত ক্ষয় হবার ফলে নীচের স্তরের পাথর বেরিয়ে এসে বেগুনী, হলুদ, বাদামী, ধুসর, লাল এবং কমলা রঙের অপুর্ব সমাহারের সৃষ্টি করেছে। নানা ধরণের বুনো জীব জন্তুর মধ্যে এখানে বাইসনও দেখা যায়।
র্যাপিড সিটিতে পৌঁছানোর আগেই পড়ে পার্কটা। আমি ইন্টারস্টেট ৯০ থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য একটা রাস্তা ধরে ব্যাড ল্যান্ড ন্যাশনাল পার্কে গিয়ে ঢুকলাম। ড্রাইভ করে অনেকক্ষণ ঘুরলাম। এই স্থানের সৌন্দর্য দেখে আমি খুবই মুগ্ধ হলাম।
(সৌভাগ্যবশত আমার সেখানে আরেক বার যাবার সুযোগ হয়েছিল)
মাউন্ট রাশমোর ন্যাশানাল মেমোরিয়ালঃ
পৃথিবী খ্যাত এই মেমোরিয়াল একটি সত্যিকারভাবে দর্শনীয় আকর্ষন। ব্যাড ল্যান্ডস ন্যাশানাল পার্ক থেকে প্রায় আশী নব্বুই মাইল যেতে হয় স্থানীয় রাস্তা ধরে। আমি ম্যাপ দেখে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম কোন পথ ধরে যাবো। বাস্তবে বরাবরের মতই পথ ঘাট কিছু গোলমাল হয়ে গেলেও সাইন দেখে ঠিক ঠাক মত পৌঁছে যাই সেখানে। গ্রীষ্মের সময় এখানে বেশ ভালোই ভীড় থাকে। ব্ল্যাক হিল এলাকায় অবস্থিত মাউন্ট রাশমোরের শরীরে গ্রানাইট পাথর খুদে আমেরিকার চার প্রসিডেন্টের (জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, থিওডর রুজভেল্ট এবং আব্রাহাম লিংকন) প্রায় ষাট ফুট লম্বা বিশাল আকৃতির ভাষ্কর্য তৈরী করা হয়েছিল ১৯৪১ সালে।




মাউন্ট রাশমোর মেমোরিয়াল থেকে মাত্র পনের বিশ মাইল দূরে অবস্থিত এই আকর্ষনটি। দৈর্ঘ্যে সাড়ে ছয় শ’ ফুট প্রস্থে সাড়ে পাঁচ শ’ ফুটের এই ভাষ্কর্যটি প্রাইভেট জমিতে সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত উদ্যোগে প্রস্তুত করা হচ্ছে। কাজ চলছে প্রায় সত্তর বছর ধরে। ক্রেজি হর্স (১৮৪০-১৮৭৭) ছিল নেটিভ ইন্ডীয়ানদের ওগলালা লাকোটা গোত্রের একজন ওয়ার লিডার যে আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল ইন্ডীয়ানদের ভুমি এবং জীবন যাত্রাকে স্বাধীন রাখার জন্য। নেটিভ ইন্ডীয়ান ওয়ারিয়রদের ভেতরে যে কয়জন সম্মানিত আছে তার মধ্যে ক্রেজি হর্স একজন। এই ভাষ্কর্্যটি শেষ হতে এখনও বেশ বাকী। যখন শেষ হবে তখন দেখা যাবে ক্রেজি হর্স তার ঘোড়ার পিঠে চেপে দুরের দিগন্তের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করছে। চারদিকের দিগন্ত ব্যাপি পাহাড়ী এলাকার মাঝখানে এটি একটি মন মুগ্ধকর দৃশ্য।
র্যাপিড সিটিঃ
ক্রেজি হর্স মেমোরিয়াল থেকে যখন রওনা দিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। র্যাপিড সিটি সেখান থেকে আধা ঘন্টার পথ। দু’ দিকের চমৎকার দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি সেদিকে গাড়ি ছুটিয়ে দেই। আমার লিস্টে এখানকার আরেকটি আকর্ষন রয়েছে। সেখানে পরদিন যাবার ইচ্ছা। সেটা আমার পরবর্তি গন্তব্যে যাবার পথেই পড়বে। সুতরাং সময় নষ্ট হবে না।

র্যাপিড সিটি চমৎকার একটি শহর। বেশ শান্ত, ছিম ছাম একটা ভাব আছে। আমি যে মোটেলে কামরা ভাড়া করেছি সেটাতে ছোটখাট একটা ইন্ডোর পুল আছে নয়টা পর্যন্ত খোলা। সেখানে ঘন্টা খানেক বেশ আরাম করে গোছল করলাম। সম্পূর্ণ একা। খেয়ে দেয়ে অল্প কিছুক্ষন টেলিভিশন দেখে তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে গেলাম। পরদিন আবার সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব।
(চলবে)