সাপ

রুমানা সোবহান পরাগ 

চরম ফাঁকিবাজ এই রিয়ার মা। প্রতি দুই দিন পর পর ওর ছুটি কাটাতে হয়। আর এই ছুটিছাটা নিয়ে এমন গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলে যে ওর বেতন কাটা তো দূরের কথা বরং ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ওর হাতে দিয়ে আরও একদিনের ছুটি মন্জুর করতে হয় আমাকে। 

তাৎক্ষণিক মিথ্যা কথা বলার যদি কোনো প্রতিযোগিতা হতো তাহলে নির্ঘাত সে বিজয়ীর বেশে ট্রফি হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতো। শুধু কাজগুলো নিখুঁত ভাবে করে বলে আমি সব সয়ে নিচ্ছি বছরের পর বছর ধরে। 

কিন্তু আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়! রোজার দিনে এমনিতেই বাসায় হাজারো কাজ থাকে। একা সামলানো কঠিন হয়ে যায়। আমি আরেক জন বুয়া রাখতে চেয়েছিলাম অন্তত রান্নার কাজে সাহায্য করার জন্য। ও তখন ঠা ঠা করে উঠলো। বলল, ‘ আমি থাকতে অন্য কেউ এই বসায় ঢুকতে পারবে না। আমিই সব কাজ করবো।’ এখন ঠেলা সামলাচ্ছি আমি। রোজার প্রথম কয়দিন বেশ নিয়ম মাফিক সার্ভিস দিল। এখন আবার যে কে সেই। দু দিন পর পরই একটা না একটা বাহানা দিয়ে ও ছুটি কাটাচ্ছে।

 গত পরশু দিন ইফতারের আগে দিয়ে এসে বলল সকাল বেলা যখন সে আমার বাসার কাছাকাছি এসেছে তখন হঠাৎ করে দেয়ালে টাক খেয়ে সে পরে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তারপর এলাকার লোকেরা ধরধরি করে ওকে বাসায় দিয়ে গেছে। 

এগুলো আর আমার শুনতে ভালো লাগে না। আজকে আসুক খালি। যে কয়দিন কাজ করেছে তার বেতন দিয়ে দরজা থেকেই বিদায় করে দেব। 

বলতে না বলতেই মহারানীর আগমন ঘটল। 

কি ব্যাপার! এখন আসছো কেন? তোমার আর রান্না ঘরে যাওয়ার দরকার নাই। আমার সব ধোয়া মোছা শেষ। এখানেই দাড়াও। যে কয়দিন কাজ করছো তার বেতন নিয়া ভাগো। এই বলে আমি বেডরুমের দিকে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ ও চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরল! মনে মনে বললাম ড্রামা কুইন একটা। আবার খটকা লাগলো মনে; এমন করে আহাজারি করতে দেখিনি ওকে আগে। বুকের ভেতরে খচ করে উঠলো। সত্যিই হয়তো কোনো বিপদ হয়েছে ওর। 

ফ্লোরে ওর পাশে বসে ওর মাথায় আলতো করে হাত ছুঁয়ে বললাম,” কি হইছে রে রিয়ার মা!”

“আমি আজকেই বাড়ি চইলা যামু। আর এখানে থাকুম না। রিয়ারে নিয়া বিকালের লঞ্চে উঠুম। আফা আমার সর্বনাশ হইয়া গেছে। এই ঢাকা শহর আমার সব নিল গো আফা। আমার আর কিচ্ছু নাই গো আফা। “

বলবি তো কি হয়েছে? না বললে বুঝবো কি করে?

কালকে রিয়ার ওভার টাইম শেষ হয় রাত তিনটায়। তাড়াতাড়ি আসনের লাগি মেইন রোড দিয়া না আইয়া গলির মধ্য দিয়া আরেকটা মাইয়ার লগে রিয়া আসতেছিল। সেহেরির সময়। আপনাগো এই গল্লির মুখের এই চিপায় চার পাঁচটা পোলা রিয়ারে ধরছে। ওর লগের মাইয়াডা জান নিয়া দৌউড়াছে আর আমার রিয়া বুঝে ওঠার আগেই ধরা খাইছে।

 ঘোড়ার মতো চিল্লাইছে। কেউ আসে নাই বাচাইতে। ওরা আমার মাইয়াডার সারা শরীর কামড়াইছে । চুল টাইনা ছিড়ছে। মারছে চিৎকার বন্ধ করনের লাগি।

 আমার রিয়া পাগলের মতো দৌড়াইতে দৌড়ইতে ঘরের ভিতরে ঢুকছে। মাইয়াটার গা জ্বরে পুইড়া যাইতাছে আফা। পেশাব করতে পারতাছেনা। চিক্কুরের উপর আছে ব্যাথায়। আফনে লন আমার লগে।”

 হাত পা অসাড় হয়ে আসছে এই ঘটনা শোনার পর থেকে । চুলা নিভিয়ে শাড়ি চেন্জ করে রিয়ার মায়ের সাথে রওনা দিলাম। থানায় যেতে হতে পারে ভেবে পৃথ্বার বাবাকে সংক্ষেপে একটা টেক্সট দিয়ে রাখলাম। বেড়োনোর সময় পৃথ্বাকে বলার জন্য ওর রুমে গিয়ে দেখি অঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। রিয়ার মুখটা মনে পরে বুকের ভেতরটা মুসড়ে উঠলো। আহারে আমার মেয়ের বয়সীই তো রিয়া। পৃথিবীর সব কদর্যতার ঐ বাচ্চা মেয়েটাকে গ্রাস করে ফেললো।

রিয়ার প্রচণ্ড জ্বর। খাটের নীচে লুকিয়ে আছে।সম্ভবত নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়েছে মেয়েটার। একটু পর পর চিৎকার করছে। আমি কি বলবো ওকে! কি সান্ত্বনা দেবো! কিভাবে ঠাণ্ডা করবো ! হঠাৎই বেরিয়ে এসে আমাকে ঠেসে ধরেছে। মনে হচ্ছিলো ও আমার বুকের ভেতর লুকাতে চাচ্ছে। আমি ধরেই রাখলাম।

মনে পরল পৃথ্বা যখন ছোট ছিল তখন আমি বারান্দায়   রোদে বসে ওর গায়ে তেল মাখাতাম, রিয়াও কাছে এসে দাড়াতো। কতোদিন ওর ঐ ছোট্ট ছোট্ট হাতে তেল ডলে দিয়েছি। চুপ করে দাড়িয়ে থাকতো। ছোট্ট তুলতুলে বিড়ালের মতো গা ঘেসে দাড়িয়ে থাকতো। আজকেও আছে। কোথায় লুকাবো ওকে আমি ! 

আমার সারা শরীরের লোম দাড়িয়ে গিয়েছে। বললাম চল মা, আমরা থানায় যাই। 

‘না খালা না ‘বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো এগারো বছরের বাচ্চা মেয়েটা। 

তোর তো প্রচণ্ড জ্বর রে মা । একবার ডাক্তারের কাছে যাই চল। 

না, না। আমি মইরা গেলেও এই শহরের আর কোনো কিছু নিমুনা, কারো কাছে যামুনা, কিচ্ছু খামুনা।লাগবোনা আমার গার্মেন্টস এর বেতন বোনাস। এই শহরের সব মানুষ খারাপ। সব খারাপ। বলতে বলতে মেয়েটা আবার জ্ঞাণ হারালো। 

 কতো কষ্ট করছি আমরা মায়ে ঝিয়ে মিল্লা। রিয়ার বাপ আরেক বিয়া কইরা আমাগোরে থুইয়া অন্য খানে ঘর ভাড় করলো। আমার বাচ্চা মাইয়াডারে বয়স বাড়ানির লাগি স্টরিডের (স্টেরয়েড) সুই দিলাম । আপনেগো কারো কাছে কইনাই সেই কথা; দশ বছরের মেয়েরে চৌদ্দ বছর লিখা গার্মেন্টসের চাকরিতে দিলাম এক আপার পরামর্শে। আমি সারাদিন বাড়ি বাড়ি কাজ করি। মেয়েটারে একলা বস্তিতে রাখার চাইতে গার্মেন্টসে চাকরিতে থাকলে নিরাপদে থাকবো আর ওর বেতনের টাকা জমায়ে একটা ভালো বিয়া দিমু এই নিয়ত করছিলাম। আল্লাহ্য় সব নষ্ট কইরা দিল।

আমার মাইয়াটা এখন পর্যন্ত বালিগ হয় নাই । একটা শিশুর উপর কতোবড় জুলুম হইল। আল্লাহ আর কতো পরীক্ষা নিবো আমাগো। আমরা না খাইয়া মইরা গেলেও আর এই শহরে থাকুম না আফা। 

  সেখানে কি কম হায়েনা আছে রে। পলানো কোনো সমাধান না। তুই মেয়েকে রাজী করা। আমরা থানায় যাই। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করি ।

আফা, এরা সবাই এই এলাকার  বাড়িওয়ালাদের ছেলে। বাইরের কেউ না। সেহেরির সময় বাইরের মানুষ কোনদিক দিয়া আসবো এই গলির ভিতরে? এরা বাসা থেকে মসজিদে নামাজ পরার জন্য বাইর হইছে। 

কার কাছে আপনি নালিশ দিবেন আফা! এরা উল্টা আমার মেয়েরে বেশ্যা বানাইয়া থানায় চালান দিবো। আমি আর এক মুহুর্তও এই ঢাকা শহরে থাকুম না।  আমি আজকেই এই শহর ছাড়ুম ।

 ওর কথায় যুক্তি আছে।  যদি দারোগা সাহেবের পকেটে একবার মোটা টাকা ঢুকে যায় তাহলে দিন কে রাত বানানো কোনো ব‍্যাপার না। যদিও সব পুলিশ এক না তবে এ ক্ষেত্রে পুলিশি সহায়তা কতোটি পাওয়া যাবে তা ভাগ‍্যের উপর নির্ভর করবে । ওরা যেহেতু থানায় যেতে চাচ্ছে না আর আমিই বা কতোটা ঝুঁকি নিতে পারবো যেখানে  আমার নিজের ঘরেও মেয়ে আছে। খারাপ লোকেরা আত্মরক্ষার জন্য যেকারো ক্ষতি করতে পারে। ব্যাগ থেকে টাকার পার্সটা রিয়ার মায়ের হাতে দিয়ে উদভ্রান্তের মতো বেড়িয়ে এসেছি সেদিন ।

বাসায় ফিরে একদৌড়ে ওয়াশ রুমে গিয়েছি। কতোক্ষণ ঝরনার নীচে দাড়িয়ে ছিলাম জানিনা।এতো পানি গায়ে দিচ্ছি কিন্তু আমার গা ঘামা কমছে না। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চারিদিকে শুধু  সাপ দেখছি কিলবিল করছে। ফ্লোর ভরতি সাপ। আমি নিথর হয়ে দেয়ালের কোনায় সিটিয়ে গিয়েছি। আমার বাচ্চাগুলোকে কোথায় রাখবো ভেবে পাচ্ছি না। এতো সাপেদের ভীরে আমার মেয়েরা নিরাপদে থাকতে পারবে তো!

Top

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments


Copyright © 2023. All Rights Reserved.