একটি মেয়ে ও কিছু অজানা কষ্টের গল্প

জসিম মল্লিক

এবার বইমেলার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের নিচের পোটিকোতে কিছুক্ষন দাঁড়িয়েছিলাম। এই জায়গাটার একটা গল্প আছে। বাঁক বদলের গল্প। গল্পটা বলা যাক। অনেক বছর পর গেলাম। তখনই স্মৃতির মনিকোঠায় ভেসে উঠল সেই ঘটনা। স্মৃতির জায়গা। এরচেয়ে প্রিয় জায়গা আর বোধহয় নাই। ক্যাম্পাস যখন দিয়ে হাঁটছিলাম মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় এখনও ছাত্র। তরুন তরুনীদের কলকাকলিতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক তরুন ভক্তের সাথে মধুর ক্যান্টিনে বসে চা সিঙ্গারা খেলাম। লাইব্রেরি আর হাকিম তলা গেলাম। কিছুক্ষন রোকেয়া হলের গেটেও দাঁড়ালাম। একসময় কত অনুরোধের আসৱে দাঁড়িয়ে থেকেছি।

বিকেলে আমাদের একটা ক্লাস থাকত। একদিন ক্লাস শেষে আমরা চার বন্ধু পোৰ্টিকোৱ নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করছি। উদ্দেশ্য মেয়ে দেখা। এমন সময় সেই চারজন মেয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে নেমে আসছিল। একই সময় তাদেরও ক্লাস থাকে। চারজনের মধ্যে একজন খুউব জোরে জোরে হাসছিল। সে দেখতে সুবেশি আর মাখনের মতো ঝকঝকে ফৰ্সা। মেয়ে চারজন চলে যাচ্ছে লাইব্রেরির দিকে। আমরাও পিছু পিছু আসছি। আগেই খেয়াল করেছি তাদের একজন হলে থাকে, দু’জন বাড়ির গাড়িতে যায় আর হাসির মেয়েটি ইউনিভাৰ্সিটিৱ বাসে উঠে। এক বন্ধু বলল, যে ওই হাসোজ্জল মেয়েটির সাথে কথা বলতে পারবে সে পঞ্চাশ টাকা পাবে। তখন আমার টানাটানির সময়। সে সময় পঞ্চাশ টাকা অনেক টাকা! আমি রাজী হলাম। তার পিছু নিলাম। বন্ধুরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে সম্ভাব্য পরিণতি দেখাৱ জন্য।

তাকে একলা পেয়ে পিছন থেকে বললাম, শোনেন।

মেয়েটি ঘুরে তাকিয়ে বলল, বলেন।

আমি বললাম, আমরা বন্ধুরা বাজী লেগেছি আপনার সাথে কথা বলতে পারলে পঞ্চাশ টাকা পাব। আমার টাকার দরকার।

সে হেসে বলল, কথা তো হলোই, টাকা নিয়ে নেন।

প্রথম দেখার দিন বাজী লেগে পঞ্চাশ টাকা পেলাম বন্ধুদের কাছ থেকে। সেই টাকা দিয়ে কয়েকদিন চলল আমার। তারপর মেয়েটির কথা আমি বেমালুম ভুলে গেছি। আমাকেও তার মনে থাকার কথা না। সে ছিল ঝকঝকে সুবেশি আর আমি প্রলেতারিয়েত পৰ্যায়েৱ। প্রান্তিক মানুষ। কাপড় চোপড়ের হাল হকিকত যাচ্ছেতাই। অপুষ্টিতে ভুগছি। খাওয়া দাওয়ার ঠিক ঠিকানা নাই। একবেলা খাই তো আর একবেলা উপোস দেই। তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলছে। প্রায়ই নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের সাথে ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলের সাথে ক্যম্পাসে যুদ্ধ হয়। পনোরো দল আর সাত দল যৌথ আন্দোলন করছে। প্রায়ই হল বন্ধ থাকে। আমার থাকার কোনো জয়গা নাই। এখানে সেখানে থাকি আমি। যেখানে রাত সেখানে কাত ধরণের। মাঝে মাঝে ফাৰ্মগেট ওভার ব্রীজেও থাকার কথা চিন্তা করি। এসব টানাপোড়েনের মধ্যে কোনো মেয়ের কথা মনে আসার কথা না। আমি যে সাহস করে একদিন কথা বলেছি এটাই অনেক বড় ঘটনা। এটা ছিল আমার স্বভাব বিরুদ্ধ ।

এর দুই মাস পর আবার সবকিছু স্বভাবিক চলতে লাগল। আবার বিকেলে ক্লাসের পর আমরা যথারীতি আড্ডা দেই। মেয়েদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকি। রোকেয়া হলের গেটে অনুরোধের আসরে অংশ নেই। স্লিপ পাঠিয়ে অপেক্ষা করি কোনো বন্ধুর জন্য। উদ্দেশ্য বিকেলে কেউ ফ্রি চা ফুসকা খাওয়াবে। সেদিন বিকেলে কলা ভবনের পোৰ্টিকোৱ নিচে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছি দেখি সেই চারজন মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। যথারীতি খিল খিল করে হাসছে। মেয়েরা কারন ছাড়াও হাসতে পারে। আবার এমন হতে পাৱে মফস্বলের কোনো ছেলের কিম্ভুত চেহারা বা পোশাক দেখে হাসছে। কে জানে কোনো ওরা এতো হাসে। সেই মেয়েটির হাসি সবচেয়ে জোরালো। দূর থেকেও শোনা যায়। আমাদের পাস কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ তার সাথে চোখা চুখি হলো। মেয়েটি আমাকে দেখে এক ঝলক মুচকি হাসল। তারপর চলে গেলো। আকস্মিক আমার বুকের মধ্যে একশটা ব্যাঙ লাফ মেরে উঠল! কখনও এমন হয়নিতো! আজব কান্ড!

ঘটনা দ্রুত গড়াচ্ছে। অতি দ্রুত। নিজের চিন্তার বাইরে। প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বস্তুত আমার কোনো প্রত্যাশাই নাই। চাওয়া পাওয়া নাই। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে ধুকুর পুকুর করে বা ব্যাঙ লাফ দেয় এই টুকুই।

একদিন কামালকে বললাম দোস্ত তোর ভাল শার্ট আছে!

কামাল অবাক হয়ে বলল, কেনো!

-দরকার আছে, দে। ইস্ত্রি করা হলে ভাল হয়।

কামাল একটা শার্ট বের করে দিল। ওর সবচেয় ভাল শার্ট। স্ট্রাইপ শার্ট। কিন্তু শার্টের সাথে কী প্যান্ট পরব! যে কয়টা প্যান্ট আছে একটাও ভাল মানের না। শার্ট না হয় একটু এদিক সেদিক হলে ম্যানেজ করা যায় কিন্তু প্যান্টতো আর অন্যেরটা পরা যায়না! তাই নিজের যা আছে তা থেকে একটা প্যান্ট সিলেক্ট করলাম। জুতার অবস্থাও যাচ্ছে তাই। প্যান্ট-শার্টের সাথে কেডস পায়ে দিলে পুরাই খ্যাত লাগবে।

কামালকে বললাম তোর জুতার সাইজ কত!

-সাড়ে আট মনে হয়।

-ওকে চলবে ।

কামাল আমার রুমমেট। মহসিন হলের ৬৩২ নম্বরে থাকি দু’জনে। কামাল তখন এরশাদের দৈনিক জনতার বিশ্ববিদ্যালয় করেসপন্ডেট। আমি বিচিত্রার প্রদায়ক।

আজকে একটি মেয়ের সাথে আমার দেখা হবে। আগে একদিনই সামান্য কয়েকটা কথা হয়েছে। আর কয়েকবার হাসি বিনিময়..।

কাল আমার ভাল ঘুম হয়নি। কতবার যে ঘুম ভেঙেছে! রাতে কয়েকবার উঠে পানি খেয়েছি, বাথরুমে গিয়েছি, হাঁটাহাঁটি করেছি অকারনে। রাত যে ফুরোতেই চায় না। জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত।

কামাল বলল, তোর শরীর খারাপ!

আমি বললাম না, শরীর ভাল আছে।

-তাহলে ঘুমাস না কেনো!

-এমনি ঘুম আসছে না..।

সকালে রেডি হলাম। শার্টের সাথে প্যান্টটা একদমই কিম্ভুৎ লাগছে। সাদা কালো স্ট্রাইপ শার্টের সাথে মেরুন রঙের গ্যাভার্ডিনের প্যান্ট! জুতাজোড়াও একটু লুজ। ভিতরে কাগজ দিয়ে ফিক্স করলাম। মাথার সামনের দিকে চুল উঠে যাচ্ছে দ্রুত। যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম ঢেকে রাখতে।

কামাল বলল, কই যাস কিছুতো বলতেছিস না।

-পরে বলমুনে।

এগারোটার দিকে লাইব্রেরীর গেটে এলাম। ভিতরে ছটফটানি। কেনো আসতে বলেছে সে! হয়ত ব্যাপারটা কিছুই না, হয়ত খুবই হতাশার। আমার যে হালহকিকত তাতে সেটাই হওয়ার সম্ভাবনা। তাছাড়া তখনও পর্যন্ত আমি জীবন নিয়ে কিছু ভাবিনি। কোনো পরিকল্পনা নাই। যদি পড়াশুনা শেষও করতে পারি, চাকরি পাব না, বরিশাল ফিরে যেতে হবে। মা বলবে তোমার জন্য মেয়ে ঠিক করছি, অতি রুপসী মেয়ে..।

সেও রুপসী। ঝর্নার মতো তার হাসি। যে হাসি ছড়িয়ে পরে দিগ্বিদিক। আমি অবশ্যম্ভাবি খারাপ পরিণতির কথা ভাবছি। আচ্ছা আমার কি উচিত ফিরে যাওয়া! আমি হাকিম ভাইর দোকানের এককাপ চা কিনলাম। আমার বন্ধু ইমরান সাত সকালে আমার সাজপোশাক দেখে খুবই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। বলল, মল্লিক তোরে খ্যাত লাগতেছে। ইমরান এমনই। সবার খুঁত ধরে। ইমরানের আধা খাওয়া সিগারেটটা নিয়ে দুটো টান মারলাম। টেনশনটা দূর করার চেষ্টা করছি..।

অবশেষে সে এলো।আমার দিকে ভাল করে তাকালোওনা সে। পোশাকের লজ্জা থেকে বাঁচলাম মনে হয়। আমি তাকে দূর থেকে যতটুকু সুন্দর মনে করছিলাম তারচেয়েও বেশি সুন্দর সে। কী সুন্দর হাতের আঙ্গুল! কী ঝকঝকে দাঁত। আর যে পোশাকটা পরে এসেছে সেটার দাম মেরে কেটে হলেও হাজার বারোশো টাকা.।

কিছু এলেবেলে কথার পর আমি নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য বললাম, আমি লিখি, বিচিত্রায় লিখি। সে অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি! সে কখনো আমার নামও শোনেনি। আমি খুবই হতাশ হই। তারপর সে আমাকে অনেকগুলো বাঘমার্কা কয়েন দিয়ে বলল, আমি হলের কয়েনবক্স থেকে চাইলে তাকে ফোন করতে পাৱি। তখন পচিঁশ পয়সার কয়েন দিয়ে ফোনে কথা বলা যেতো…।

আমার কাছে অনেক কয়েন। বাঘ মাৰ্কা কয়েন। পঁচিশ পয়সার কয়েন সবগুলো। তার সাথে কথা বলার জন্য ফাউ কয়েন পেয়েছি। এদিকে কি কারনে যেনো ক্লাস বন্ধ। ক্লাস বন্ধ হলেও হল খোলা আছে। বন্ধ ক্যাম্পাসকে শূণ্য মনে হয় আমার কাছে। মনে হয় কি যেনো নেই। কি যেনো থাকার কথা ছিল। একলা একলা কলা ভবন দিয়ে হাঁটি। লাইব্রেরির কাছে বসে থাকি। হাকিম ভাইর চা খাই। চায়ের স্বাদ বিস্বাদ লাগে। চোখচুখি হলে হাসি বিনিময়ের সেই দৃশ্যগুলো চোখে ভেসে উঠে। হলের কয়েন বক্সের কাছ থেকে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করলাম। দেখি সেখানে ভিড় লেগেই আছে। লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছে ছেলেরা। আমি মনে মনে খুশী হই। নিজের কাছে নিজে অজুহাত দাঁড় করাই। নিজেকে বলি লোকজনের জন্য ফোন করতে পারছিনা। সবার সামনে প্রাইভেট কথা বলা যায়! ছেলেরা ঘারের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। তাছাড়া ফোন করে আমি কি কথা বলব! আমার তো বেশি কথা নাই। গুছিয়ে কথা বলতে পারি না আমি।

একদিনই শুধু ফোনে কথা হয়েছে। কয়েন যা ছিল খরচ করে ফেলেছি। কয়েনবক্সের ধারে কাছেও যাই না। হলে যাওয়া আসার সময় তাকিয়ে দেখি ছেলেরা কথা বলছে। সবাই যে প্রেমিকের সাথে কথা বলে তা না। যাদের হোম ফোন আছে তারাই মা বাবা, ভাই বোন বা প্রেমিকের সাথে কথা বলছে। তখনতো আর সেল ফোন ছিল না! ইউনিভাৰ্সিটি অনিৰ্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। কবে খুলবে জানা নাই। যে কোনো সময় হলও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে তখন। হল বন্ধ হয়ে গেলে যাদের ঢাকা শহরে বাড়ি ঘর নাই, থাকার ব্যবস্থা নাই তাদের বিরাট বিপদ। আমার সেই অবস্থা হয় যখন তখন।

তখন আমি পথে পথে ঘুরে বেড়াই। এর ওর কাছে ধৰ্না দেই থাকার জন্য। কখনও বরশাল চলে যাই। একবার হাতিরপুল ভুতের গলিতে ছয় মাসের মতো ছিলাম। বন্ধু আপেলের কাছে থাকি। সে সময় চমৎকার একটা এপাৰ্টমেন্টে ছিলাম আমরা কয়েকজন। তারমধ্যে কবি ইকবাল আজীজ, সালেম সুলেরি, সোহরাব ভাই থাকতেন। প্রতি শুক্রবার ল্যান্ডলৰ্ড আমাদের স্পেশাল খাবার পাঠাতেন। বিশেষকরে আমি সেই খাবারের অপেক্ষায় থাকতাম। আমাদের হাউস লীডার ছিল সুলেরি। ডাইনিংয়ের দ্বায়িত্ব ছিল তার। সেখানে আমাদের অন্য বন্ধুরাও আসত। আড্ডা হতো।

আমি তার কথা প্রায় ভুলে গেছি। একেবোরে ভুলে গেছি বললে ঠিক হবে না, মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছি। আমি কোনো মেয়ের সাথে পরিপূৰ্ণ জড়িয়ে পড়তে চাই না। বন্ধুত্ব এক জিনিস আর প্রেম এক জিনিস। প্রেম বিষয়টার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ তৈরী হয়নি। আমি প্রেমের উপন্যাস পড়ি, একটু একটু প্রেমের গল্প লিখি। কিন্তু নিজের প্রেমের প্রতি অনীহা। একটা ভীতি। তবে আমি বিশ্বাস করি প্রেম মহান, প্রেম স্বৰ্গীয়। কিন্তু আমি প্রেমে পড়তে ভয় পাই। প্রেম আমার জন্য না। কোনো মেয়ের সাথে জড়িয়ে পরাটাকে আমার কাছে সমীচিন মনে হয়না। আমি একলা থাকতে চাই। একলা থাকাতেই আমার আনন্দ। আমি কখনও বিয়ে করব না এটা জানি। আমাকেও কোনো মেয়ে বিয়ে করবে না এটা নিশ্চিত।

স্বামী হিসাবে যেমন ছেলে পছন্দ মেয়েদের আমি তেমন না। আমি একটু উদাসীন, নিৰ্লিপ্ত, আউলা ঝাউলা, উদ্দেশ্যহীন। মেয়েরা সবসময় প্রেমিকের এটেনশন চায়, কেয়ারিং চায়, নিৰ্ভরতা চায়, বিশ্বাস চায়। আমি তেমন না। প্রেমে পরা মেয়েরা অনেক ন্যাগিং করে গল্পে পড়েছি, সংসার পাতার স্বপ্নে বভোর থাকে, প্রেমিককে নিজের সম্পত্তি মনে করে। ন্যাগিং আমার পছন্দ না। কেউ আমাকে কন্ট্রোল করুক এটা আমি চাই না। অভিযোগ আমার একদম পছন্দ না। আমি নিজে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করি না, কাউকে কন্ট্রোল করতে চাই না। আমি যদি সত্যি কখনও কারো প্রেমে পরেই যাই সেটা হবে বিস্ময়কর। একজন প্রেমিকের মনোজাগিতিক আচরন কেমন হবে সেটা নিয়ে আমার মধ্যে একটা দ্বিধা আছে, ধোঁয়াসা রয়ে গেছে। মোট কথা তার সাথে আমার জমবে বলে মনে হয় না। আমি কখনও প্রথাগত প্রেমিক হবো না।

এরপর মাস পেরিয়েছে। একদিন সকালে ক্যান্টিনের এক বয় আমার রুমে নক করল। দরজা খুলে দেখি তার হাতে একটা প্যাকেট। বলল, স্যার এক ম্যাডাম পাঠাইছে। আপনারে দিতে কইছে। প্যাকেট খুলে দেখি তারমধ্যে গরম গরম খিচুরি, গুরুর মাংস আর একটি পুটলিতে অনেকগুলো কয়েন। আমি মজা করে সেই খিচুরি খাই এবং একদিন আবার কয়েনবক্সের কাছে লাইনে দাঁড়াই…।

আমি কল্পনায় যেরকম একটি মেয়ের স্বপ্ন দেখতাম এতো সেরকম না! কিশোর বয়স থেকেই বই পড়ে পড়ে একটি কল্পিত মানুষের ছবি মনে গেঁথে গিয়েছিল এবং সেটা একটি নারীর ছবি। কিন্তু ওসবতো কাউকে বলা যায়না। ওসব কথা মনের মধ্যেই লুকিয়ে রাখতে হয়। তখন আমি নিতান্তই এক একলা কিশোর। আমাকে কেউ তেমন খেয়াল করে না, কারো নজরেও নেই আমি। তখন থেকেই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ি। লাইব্রেরী থেকে বই আনি। লাইব্রেৱিয়ান চাচা কোনো এক অদৃশ্য কারণে আমাকে যতখুশী বই নিতে দেন। তখন থেকেই আমার কল্পনাৱ জগতে বসবাস। জাগতিক বিষয় থেকে দূরত্ব তৈরী হচ্ছে। যাদের সাথে খেলাধুলা করতাম আকস্মিক তাদের আর কাছের মনে হচ্ছেনাতো!। বইয়ের নেশা আমাকে পেয়ে বসল। সবসময় আমার রোমিান্টিক চরিত্রগুলো ভাল লাগত। ওরা কেমন করে কথা বলে, হাসে, একে অপরকে কমিউনিকেট করে, কেমন করে দুঃখ পায় আমি গভীরভাবে অনুভব করতাম। তখন আমি গল্পের মতো কল্পনায় কোনো নারীকে দাঁড় করিয়ে তার সাথে কথা বলতাম। সে মানুষটি কেমন, তার আদল কেমন, স্বভাব কেমন তা আমার কাছে স্পষ্ট না হলেও একটা অবয়ব মনের গভীরে আঁকা হয়ে থাকত। বারো তেরো বছর বয়সটা ওরকমই। অনেক ওলট পালট করা বয়স! শরীরে স্বেদ গন্ধ পাওয়ার বয়স। হরিণের মতো চঞ্চল হওয়ার বয়স।

তাঁর সাথে পরিচয় হওয়ার পর বুঝলাম আমার কল্পনার মেয়েতো সে নয়! মেয়েদের হতে হবে নরম, লাজুক, সুন্দর আর রেমান্টিক! যে কখনও দুঃখ দেবেনা, জোড়ে কথা বলবে না, ভুলত্রুটি নিয়ে কিছু বলবে না। যে শুধু ভালবাসবে, প্রেম দেবে, রোমান্টিক হবে। তার সাথে ঘুরে বেড়াব, সাগর দেখব, পাহাড় দেখব। সাগরের উদ্দাম ঢেউ ভিজিয়ে দেবে কোমল পা, বাতাসে উড়বে খোলা চুল। হাত ধরে হাঁটব বালুকাবেলায়। কিন্তু তাঁকে সেরকম মনে হচ্ছে নাতো!েএই মেয়ের আগেও আমার কয়েকজন মেয়ের সাথে স্বল্প বিস্তর পরিচয় হয়েছে। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত কেউই আমাকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে নেয়নি। আমাকে আউলা ঝাউলা স্বভাবের মনে করে খারিজ করে দিয়েছে। যাওবা দু’একজন আমাকে বুঝতে চাইত তারাও আমার দুবর্ধ্য স্বভাবের জন্য অল্প দিনেই গুডবাই দিয়েছে। আমার যে সেজন্য বিশেষ খারাপ লেগেছে তা না। বরং নিজেকে হালকা লাগছে। তারাই জড়িয়েছে তারাই দুরে সরে গেছে। আমার কোনো দায় নেই। আমি শুধু নিরবে সেইসব চলে যাওয়া দেখেছি। আহা কিভাবে আমার নিজের মানুষ অন্যের হয়ে গেলো! ওরা কেনো আমাকে বুঝতে পারল না! না হয় আমি একটু ভুতুরে স্বভাবের কিন্তু একজনও কি নেই যে এই মানুষটিকে বুঝবে এবং পাগলামিগুলোকে মেনে নেবে! একজনও নেই!

প্রথম পরিচয়ের পর আমার মাঝে মাঝে মনে হত সে বলবে, চল আজকে কোথাও নিরিবিলি বসে গল্প করি। কিন্তু তা বলত না! সহজে দলছুট হতে চাইত না। যেনো কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। তার কথা ছিল সকালে কি খেয়েছো! দুপুরে কোথায় খাবা! তখন আমার টানাটানি অবস্থা। আমিতো আর তাকে বলতাম না যে আমার পকেটে পয়সা নাই। ওসব কি বলা যায়! আবার এমনও না যে নিজের বাহাদুরি দেখিয়ে তার নজর কাড়ার চেষ্টা করব! প্রেম ছুটে গেলে যাবে! কিন্তু সে সব বুঝত, মেয়েরা ওসব বোঝে। প্রায়ই আমার জন্য বাড়ি থেকে গরম খাবার নিয়ে আসত। হয়ত ওটা তার নিজের ভাগের খাবার ছিল। আমি মনের সুখে সেই খাওয়া খেতাম। পকেটে পয়সা না থাকলে যে বেশি বেশি খিদা পায়!

একদিন সে বললাম তুমি এরকম কেনো!

-কি রকম!

-মোটেও রোমন্টিক না! দেখোনা ওরা কি সুন্দর গল্প করছে, পাৰ্কে হাঁটছে, বাদাম খায় আর ঘাস ছিঁড়ে।

-হইছে। সিনেমার ডায়লগ দিবানা। আমি এমনই। তোমার রুমের ছেলেটা বাড়ি থেকে আসছে! রান্না করবে কে, তুমিতো ক্যান্টিনের খাবার খেতে পারো না!

মনে মনে ভাবি কিসের মধ্যে কি!

আমার তখন একটা মোটর বাইক ছিল। সবুজ রঙেৱ ইয়াহামা মোটর বাইক। কিনেছিলাম বিচিত্রার আলমগীর ভাইর কাছ থেকে। মজার ঘটনা কেনার আগে আলমগীর ভাই আমাকে একবার ট্রাইলও দিতে দেয়নি। তাঁকে সবাই সমঝে চলত। আমিও ভয়ে কিছু বলতে পারিনি। ইয়ামাহা ডিলাক্স। সেটাতে তাঁকে চাপিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বাড়ি পৌঁছে দিতাম মাঝে মাঝে। ওদের বাসা মহাখালী ওয়াৰ্লেস গেট । জল খাবার পৰ্যন্ত আসার পর বলত আমাকে নামিয়ে দাও। রিক্সায় যাব। সে আমাকে কখনও পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বসত না, মাঝখানে একটু জায়গা ফাঁকা থাকত, কোনো মানে হয়! আমি করতাম কি জোড়ে জোড়ে ব্রেক করতাম। সে তখন ধমক দিত , বলত এক্সিডেন্ট করবা, আস্তে চালাও!

তার প্রথম কথা হয়েছিল টাকার জন্য। কথা বলতে পারলে পঞ্চাশ টাকা পাব তাই। টাকাটা বেশ কাজেও লেগেছিল আমার। পঞ্চাশ টাকা কম না তখনকার সময়। তারপর থেকেই মাঝে মাঝে চোখাচুখি হতো। সেটা এমন কিছু না। সুন্দরী মেয়েদের দিকে না তাকানো ঠিক না আমিও তাকাই। আমার খারাপ লাগে না। মেয়েরা হচ্ছে একটা নেশার মতো। শুধু টানে। এমন অনুভূতি আগে হয়নি কখনও। কত মেয়ে বন্ধুই তো আছে আমার। একসাথে ঘুরছি, আড্ডা দিচ্ছি, ফাজলামি করছি কিন্তু বুকের ভিতর কেমন করে উঠা সেটা হয় নি। বন্ধুদের প্রতি আমার সবসময় এমনই মনোভাব। মেয়ে বন্ধুদের প্রতি আমি কখনও প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকাইনা বা কোনো গোপন আকাঙ্খা কাজ করে না আমার মধ্যে। অনেকে ছেলে মেয়ে বন্ধুত্ব এবং প্রেম গুলিয়ে ফেলে। আমার এমন হয় না। আমি সবসময় এমনই ছিলাম। এ জন্য জীবনে আমাকে কম ভুগতে হয়নি।

এভাবে দিন গড়ায়। সপ্তাহ গড়ায়। মাস পার হয়। একমাস, দুই মাস, ছয় মাস..। বিকেলের দিকেই যা একটু দেখা পাই। ক্লাস শেষ হলে। তাও প্রতিদিন না। সপ্তাহে মাত্র দুই দিন। বাস্তবে আমাদের কথা হয় চোখে চোখে, মনে মনে। বন্ধুরা টের পায়। দু’ একজন বন্ধুর আগ্রহ আছে তার প্রতি আমি টের পাই। তারা সাধে সেধে কথা বলে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি। সেও হেসে হেসে কথা বলে তাদের সাথে। আমি কী একটু ঈৰ্ষা বোধ করি তখন! ঠিক বুঝতে পারি না। এমনতো হওয়ার কথা না আমার। আমি এসব তেমন পাত্তা দেবো না বলে ঠিক করি। কিছুতো আর হবে না। ওই দেখাদেখি, চোখাচুখি পৰ্যন্তই ঘটনা শেষ। আমার নিৰ্লিপ্ততায় কেউ কেউ আশাবাদীও হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি টের পাই সে যতই অন্য বন্ধুদের সাথে হেসে হেসে কথা বলুক না কেনো তার চোখ আমাকেই খোঁজে। আমাকে দেখলেই আলোকিত হয়ে উঠে। এমনভাবে আড্ডা দেয় যেনো আমি দেখতে পাই। আমার যতই দুৰ্দশা থাকুক না কেনো আমিও গোপনে আশাবাদী হয়ে উঠি। পরষ্পরকে জানার ব্যাপারে আমার মধ্যে আগ্রহ তৈরী হতে থাকে।

অবশেষে একদিন সেই মহেন্দ্রক্ষন এসে যায়। সমস্যা হচ্ছে সে থাকে বাসায়। ইউনিভাৰ্সিটিৱ বাসে আসা যাওয়া করে। হলে থাকলে ভাল ছিল। শামসুন্নাহার হলে এটাচ। মাঝে মাঝে দলবেধে হলে যেতে দেখি। আমি হ্যাংলার মতো ফলো করি তাঁকে। অনেকটা নিজের অজান্তে। চুম্বকেৱ মতো টেনে নিয়ে যায় আমাকে। নিজেৱ ব্যাক্তিত্ব খসে পড়ে।

সেদিন ছিল বিকেল। বিকেলের ক্লাসটা কোনো কারণে হয়নি। সবাই আমরা এলেবেলে আড্ডা দিয়ে সময় পার করি। কলা ভবনের সামনের খোলা জায়গাটায় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আড্ডা হচ্ছে। আমি, সিনা, শামীম, তাহমিনা, নাসরিন। ওদের সাথেও কয়েকজন বন্ধু। আমাদের চোখাচুখি হয় বারবার। ঝাল মুড়ি পাঠায় আমাদের। আমরা খাই।

বাসের সময় হলে সে উঠে যায়। আমি পিছু নেই। সে একবার ঘার ঘুরে আমাকে দেখে। অন্য বন্ধুরা যে যার মতো চলে যায়। এটাই সুযোগ।

সে প্রস্তুত হয় কথা বলার জন্য। টের পাই আমি। আমিও তৈরী হই। বুকের ধুকধুকানি শুনতে পাই।

বাসে উঠার আগ মুহুৰ্তে সে বলল, আমি কোন হলে থাকি।

আমি বললাম মহসিন হল।

ঢাকায় কোনো আত্মীয় স্বজন আছে!

তেমন কেউ নাই।

দেশের বাড়ি কোথায়!

বরিশাল।

বরিশাল শুনে একটু ভয় পেলো নাকি! কেনো যে আগে ভাগে বললাম!

শুধু বলল, ও।

কে আছে বরিশালে!

সবাই আছে।

তারপর বাসে উঠে চলে গেলো।

আমি অপস্রিয়মান বাসটার দিকে তাকিয়ে থাকি। বাসের ধোঁয়ার গন্ধটাও ভাল লাগে আমার। বুকের ভিতরের ব্যাঙগুলো লাফ মারতে থাকে!

তারপর থেকে আমাদের দু’জনের নিয়মিত কথা হয়। এলেবেলে সব কথা। যার কোনো মাথা মুন্ড নাই। একটা নতুন পরিচয়, নতুন সম্পৰ্ক হলে নারী ‍পুরুষের যে ধরণের কথাবাৰ্তা হয় সাধারণত, একটু দীৰ্ঘ নিশ্বাস থাকে, দেখা না হলে বুকের মধ্যে কষ্ট মোচর দেয়, জীবনটা কখনও কখনও অৰ্থহীন মনে হয়, দুঃখী মনে হয়, দিন যেনো কাটতেই চায়না প্রতিদিন দেখা না পেলে আমার সে রকম হচ্ছে না। বস্তুত তারও হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের কথা হয় ঠিকই, একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা আর কি। ক্লাস বন্ধ, চাইলে দেখাও করা যায়। হয়ও দেখা। কিন্তু আমি নিজে থেকে দেখা হওয়ার কথা বলি না কখনও।

আমি স্বীকার করছি কথা বলতে আমার ভাল লাগছে। একজন রুপসী মেয়ের সাথে কথা বলতে কার না ভাল লাগে। বন্ধুরা অবাক হয়ে দেখে, আমি এনজয় করি ওদের দীৰ্ঘনিশ্বাস। ভাল লাগার কারন হচ্ছে দেখা হলে আমি মজার মজার খাবার খেতে পারি তার পয়সায়। ফোন করার জন্য কয়েন পাই। মাঝে মাঝে পকেট মানিও। আমার যেটা হয়, সবসময় এটা আমার মধ্যে ছিল আমি সহজে চেয়ে নিতে পারি না। কারো কাছে হাত পাততে পারি না। কতদিন না খেয়েও থেকেছি কিন্তু কারো কাছে বলিনি। এমনকি তাকেও না। জিজ্ঞেস করলে বলি খেয়েছি, কোনো সমস্যা হচ্ছে না। একদিন শুধু বলেছিলাম হলের ডাইনিংয়ের খাবার অসহ্য। বোটকা গন্ধ পাই। তারপর সে আমাকে একজন লোক রাখতে বলল, যে রুমে রান্না করে দেবে। আমি তাই করলাম। সে হাড়ি পাতিল ও হীটার কেনার টাকা দিল, বাজারের টাকা দেয় আর ছেলেটা রান্না করে। আমি মহা আরামে খাই।

এখন সমস্যা হচ্ছে এই যে একজনেরটা খাচ্ছি, নিচ্ছি এখন কি হবে! প্রতিদান কিভাবে দেবো! বেশিদিন ফাউ খাওয়াওতো ঠিক না। নিজেকে অনেকটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। বিয়ে যে করব না তা নিশ্চিত। একদিন যখন বুঝবে আমার কোনো ভবিষ্যত নাই, আউলা ঝাউলা, যার কোনো কিছু বেশিদিন ভাল লাগে না তখন তা হবে তার জন্য বেদনার। প্রেম ভালবাসার কথা আমরা কেউ ভুলেও উচ্চারন করি না। সব নৰ্মাল। যেনো ওসব কিছুই না। একদিন যে যার মতো দুদিকে চলে যাব। আচ্ছা তখন কি আমার খারাপ লাগবে! কষ্টে বুক ভেঙ্গে যাবে! বুঝতেছিনা ঘটনা কোন দিকে গড়াচ্ছে।

একদিন ক্লাস খুলে গেলো। সবকিছু স্বাভাবিক। বন্ধুরা মিলে দলবেঁধে আড্ডা দেই। ফুসকা খাই। একলা হওয়ার কথা কখনও বলে না। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে একদিন বলল, আমি একটা চাকরি নিয়েছি।

মানে কি।

একটা কিন্ডার গাৰ্টেন স্কুলে পাৰ্ট টাইম চাকরি। দুইদিন ক্লাস।

হঠাৎ চাকরি কেনো।

নিলাম। ওই টাকা তোমাকে দিতে পারব।

ও মাই গড। কাজটা ঠিক হয়নি। পড়াশুনার ক্ষতি হবে।

ওই দুইদিনতো ক্লাস থাকে না।

কোথায় স্কুলটা।

বনানী দুই নম্বর রোড। জল খাবারের কাছেই। বাসায় খুব রাগারাগি করছে। কেনো চাকরি নিলাম।

তাতো করারই কথা।

মনে মনে খুশী হই আমি। চাকরি করা ভাল। আমার কোনো সমস্যা নাই। আমার কষ্টের দিন প্রায় শেষ বললেই চলে। নিয়মিত রুমের রান্না খাই, বিচিত্রা থেকে কিছু পয়সা আসে। সবমিলিয়ে আমি স্বচ্ছল! মনে মনে ভাবি কবে না জানি এসব বন্ধ হয়ে যায়। আশঙ্কায় আছি একদিন নিজে থেকেই বিদায় নেবে।

একদিন বলল, তোমার প্লান কি।

কিসের প্লান।

পাশ করার পর কি করবা।

এখনও জানিনা। চাকরি বাকরির চেষ্টা করব, না হলে বরিশাল চলে যাব।

বরিশাল কি আছে। ওখানে গেলে কিছুই হবে না। তুমি না সাংবাদিক হতে চাও। লেখক হতে চাও।

তুমি তো আমার লেখাই পড়ো না।

তাতে কি। আমার পড়তে হবে এমন কোনো কথা নাই।

আমার এখানে চাকরি হবে না। মামুর জোর লাগে বুজছ!

চেষ্টা করলেই হয়। তোমারও হবে। আমিতো ফুল টাইম চাকরির চেষ্টা করছি। ব্রাকে এপ্লাই করেছি।

ও তাই নাকি!

দু’জন ইনকাম না করলে চলা কঠিন হবে!

দু’জন মানে কি!

তুমি আৱ আমি!

এটা শুনে আমার বুকের মধ্যে ধরফর করে উঠল। এসবেৱ মানে কি!

হল ছেড়ে দেয়ার নোটিশ পেলাম একদিন। টেনশনে রাতে ঘুম হয়না। এখন কী ফার্মগেট ওভারব্রিজে রাত কাটাব? এরচেয়ে বরিশাল চলে যাওয়াই ভাল। সুবিধামত সময়ে আবার ঢাকা ফিরে আসব। আমি লেখক হতে চাই, আমি সাংবাদিক হতে চাই। এজন্য আমাকে ঢাকায়ই থাকতে হবে। আমি ঢাকা এসেছিলামও সেই স্বপ্ন নিয়ে। গোপন স্বপ্ন। কিন্তু আমার সেসব স্বপ্ন পূরন হবার নয়। অনেক কষ্টে সৃষ্টে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছি। যত না লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী ছিলাম তারচেয়ে বেশি নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলাম। পত্রিকা অফিসে অফিসে ঘুরেছি। বিচিত্রায় লেখার পাশাপাশি অন্যান্য পত্রিকায় ছোটখাট লেখা লিখি। কেউ তেমন পাত্তা দেয়না। এইসব ক্ষেত্রে দরকার চেনাজানা মানুষ কিন্তু আমার সে সব নাই। আমি একটু অর্ন্তমুখী, লাজুক এবং ভীতু। কাউকে বলতে পারিনা যে আমার কিছু একটা কাজ দরকার। বলতে পারি না যে সুযোগ দিলে আমি পারব। আমার মধ্যে আবেগ আছে, অনেক না বলা কথা আছে। আমি সে সব বলতে চাই। কিন্তু সে সব শোনার কেউ নাই। তাই বরিশাল ফিরে যাওয়াই সব্যস্ত করলাম। বেটার আইডিয়া। ঠিক এই রকম টানাপোড়েনের মধ্যে সে একদিন বলল,

-তোমার জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা করেছি।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কোথায়!

-আমার এক আত্মীয় আছে বিদেশ থাকে, ওনার বনানীতে একটা বাড়ি আছে। বাড়ি খালি পড়ে আছে। তুমি ওখানে থাকতে পারবা।

আমি অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বললাম বাসায় উঠলেইতো হবে না, প্রবলেম তো থেকেই যাবে, চাকরি নাই।

সে বলল, এ ছাড়া আর কি করবা। বরিশাল চলে গেলে কোনো লাভ নাই, এখানে থেকে চাকরির চেষ্টা করতে পারবা। চলে গেলে তো সেটা হবে না।

-তুমি অনেক হেল্প করছ! ঋণের বোঝা বাড়তেছে শুধু।

-হইছে বইয়ের ভাষায় কথা বলতে হবে না।

এদিকে সে ফ্যামিলি থেকে বিরাট চাপে আছে। এক মেয়ে, দেখতে শুনতে ভাল, চারিদিক থেকে সম্বন্ধ আসছে। আমার একটা কিছু হিল্লে হলে বিয়ের পাত্ৰ হিসাবে প্রজেন্ট করা যায় হয়তবা। আমি মনে মনে চাচ্ছি তাঁর বিয়ে হয়ে যাক। ভবিষ্যৎটা ভাল হবে। আমাকে বিয়ে করাটা হবে বিরাট ভুল। আমি আবেগকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিতে চাইলাম।

বনানীর বাসায় আমার সুন্দর দিন কাটতে লাগল। বিরাট বড় বাড়ি। চারিদিকে গাছ গাছালি। ফুল ফার্নিশড বাসা, ফোনও আছে। ল্যান্ড ফোন। বোনাস হিসাবে একজন কাজের লোকও আছে। সেখানে বিচিত্রার বন্ধুরা আসে, পার্টি করে, খায়, থাকে। ডেটিং করে…।

সে আমার লেখালেখি বিষয় নিয়ে কখনও কিছু বলে না। পরিচয় হওয়ার পর একদিন বলল, তুমি নাকি লেখো! কী লেখো!

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি জানোনা আমি লিখি!

-না তো!

আমি ব্যাথিত হয়ে বললাম ওহ্! মনে মনে ভাবলাম, যে আমার লেখা পড়েনি বা আমার নামই শোনেনি কখনো তাকে বিয়ে করা ঠিক হবে না!

একদিন আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল বিচিত্রায় তোমার একটা গল্প পড়লাম!

-পড়ছ!

-হ্যাঁ।

-কেমন লিখছি!

-চলে। বেশি আবেগ আর মাখামাখি টাইপ।

আমি মনে মনে খুউবই ব্যাথিত হলাম। কিন্তু তা প্রকাশ করিনা।

 ৮

আমি বনানী এসে উঠেছি। মহাসুখে দিন যাপন করছি বনানীর এই বাসায়। ভাড়া দিতে হয় না। শুধু ইউটিলিটি বিল দিতে হয়। গ্যাস, পানি, ইলেকট্রিক এবং ফোন বিল। এমন কিছু বেশি না। ফোন থাকায় মহা সুবিধা। তাৱ সাথে কথা বলতে পাৱি। এটা মেয়েটির এক আত্মীয়র বাড়ি। তারা বিদেশে থাকে। বাড়িটা খালি পড়ে আছে। সে আমার থাকার জন্য ব্যবস্থা করেছে। রান্না বান্না এবং বাজার করার জন্য একটা ছেলে জোগাড় করলাম আমি। বিচিত্রায় চাকরি করত সোলায়মান। সে এই ছেলেটাকে ম্যানেজ করে দিয়েছিল। কাজ তেমন পারত না যদিও কিন্তু আমার চলে যেতো। ছেলেটার বেতন এবং বাজারের পয়সা সেই দেয়। মাঝে মাঝে এসে রান্নার তদারকি, আমার কাপড় লন্ড্রি করতে সাহায্য করত। আমি তখনও নিশ্চিত ছিলাম আমাদের কিছু ঘটবে না। বিয়ে করার কোনো ইচ্ছাও আমার নাই। সেও বিয়ের ব্যাপারে কোনো চাপ তৈরী করছে না বলে আমি স্বস্তি পাই। শুধু চাকরির জন্য চেষ্টা করতে বলছে। নিজেই পেপাড় কাটিং নিয়ে আসে। কোথায় কোথায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। আমি মাঝে মাঝে ক্ষেপে যাই। ঝগড়া লেগে যায় আমার সাথে। আমি জানি ঢাকা শহরে কেউ আমাকে চাকরি দেবে না। আমার মামা খালু কেউ নাই। খামোখা জুতার তলি নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তারচেয়ে বরিশাল ফিরে যাওয়ার চিন্তা করি। কিন্তু তার ধারনা হবে। চেষ্ট করলেই হবে।

আমি মনের আনন্দে খাই দাই ঘুরে বেড়াই। ৯ হায়দারবক্স লেনে বন্ধু এমদাদ হক চিনার বাসায় প্রায়ই যাই আমরা। চিনাটা হুট করে চলে গেলো। কোনো মানে হয়! সময় কাটাই। খালাম্মা আমাদের খাবার দাবার দেন। যেনো আমরা এ বাসার আত্মীয়। যেনো সে আমার বিশেষ কেউ। আসলে ব্যাপারটা মোটেও এমন না। তাও আমার কাছে লাইফ ইজ ঠু গুড টাইপ মনে হয়। সুন্দরী মেয়ে নিয়ে ঘুরছি। ভাব অন্যৱকম! বন্ধু লিটু আমাদেৱ সময় দেয়, আড্ডা দেই । তেমন কোনো চিন্তা নাই মাথায়। চাকরি হলে হবে না হলে নাই। ইন্টারভিউ দিতে পাঠায় সে আমাকে। কোথা থেকে শাৰ্ট, জুতা, টাই জোগাড় করে নিয়ে আসে। ইন্টারভিউর জন্য এসব দরকার আছে। চাকরি হোক না হোক চেষ্টা করতে দোষ কি। কিন্তু আমাৱ মাথার মধ্যে চলে যাব। ঢাকা শহরে আমার তেমন কোনো রেফারেন্স নাই। তাই বরিশাল চলে যাব ঠিক করে রেখেছি।

সেদিন ছিল শুক্রবার। সে সকাল সকাল হাজির। মুখটা কালো। দেখেই বুজেছি কিছু একটা ঘটেছে!

প্রতি শুক্রবার সে আসে। এ আর নতুন কি। তখনও বিরাট টানাপোড়েন আমার মধ্যে। তাকে যে আমি বিয়ে করব না এটা নিশ্চিত। কিন্তু সে এগুচ্ছে তার নিদিষ্ট লক্ষ্যে। রীতিমতো প্লান মাফিক। আমি মাঝে মাঝে আতঙ্কে থাকি। আচ্ছা আমি কেনো তার কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা নিচ্ছি! এটা তো বিরাট স্বাৰ্থপরতা। কেনো চুপ করে থাকছি! এখনই সময় বলে ফেলার যে আমি তোমাকে বিয়ে করছি না। সাহস করে বলতে হবে। গুড বাই। আমি জানি তার উপর ফ্যামিলি থেকে বিরাট চাপ আছে। চারিদিক থেকে সম্মন্ধ আসছে। সেটাই স্বাভাবিক। যদিও সে আমাকে সবকিছু বলে না।

সে মুখ কালো করে বসে আছে।

আমি বললাম, কোনো সমস্যা হয়েছে!

সে বলল, না কোনো সমস্যা হয় নাই।

কিন্তু আমি বুঝতে পারছি কিছু হয়েছে। প্রতি শুক্রবার সে কিছু না কিছু নিয়ে আসে আমার জন্য। আজকে এসেছে খালি হাতে।

তোমারে আপসেট লাগতেছে।

তখন সে আমাকে চমকে দিয়ে বলল, বাসায় প্রপোজাল পাঠাও।

আমি ঘাবরে গিয়ে বলি, মানে কি!

মানে বিয়ের প্রপোজাল।

আমার ভিতরে দর দর করে ঘাম ছুটছে টের পাই।

টরন্টো ১১ মাৰ্চ ২০২৩

Top

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments


Copyright © 2023. All Rights Reserved.