নবজাতক
রীনা গুলশান

গতকাল থেকেই প্রিয়তার লেবার পেইন উঠেছিল । এখনও বাচ্চা হবার ডেট দেড় সপ্তাহ দেরী ছিল । তাই ভেবেছিল একবার অফিস হয়ে আসবে । একটা ফাইল দেবার ছিল। প্রায় ৩ সপ্তাহ আগে থেকেই সে বাসায় বসে কাজ করছিল । কারন ওর বেবী বাম্প যথেস্ট বড় হয়ে গিয়েছিল । পায়েও পানি এসেছিল । কিন্তু ফাইলটা দিতে যাবে বলে ঠিক করলো , তার কিছু আগে থেকেই বেশ ঘন ঘন বাথরুম আসছিল । তারপরই কোমরের জোর কেমন জানি কমে আসছিল । তলপেটে কেমন জানি একটা খিঁচ ব্যথা শুরু হলো । বুঝতে পারছে ব্যথাটা কমার কোন লক্ষন নাই । ৩/৪ টা বাড়ীর পরেই ওর অফিসের একজন কলিগ থাকে । তাকেই অগত্যা ফোন করলো , বললো ভালো লাগছে না। ফাইলটা নিয়ে যেতে । একটু পরই মা এসেছিলো দুধের মধ্যে মধু দিয়ে ওকে খাওয়াতে । ওর মুখের দিকে তাকিয়েই ,মা উৎকন্ঠিত গলায় বললো –
ঃ কি রে শরীর খারাপ লাগছে
ঃ হু । কেমন যেন তলপেটে খিঁচ ব্যথা , দাঁড়াতেই পারছি না ।
ঃ সেকিরে ? সময়তো এখনও ১২/১৪ দিন বাকি ।
মা দ্রুত ডাঃ এর ক্লিনিকে ফোন করলো । একজন আর এন ফোন ধরেছিলো , সব শুনে বললো , দ্রুত নিয়ে যেতে । বাবা অলরেডী অফিসে চলে গেছে । তবু মা খুব দ্রুত তাকে একটা এস এম এস করলো । ক্লিনিকে যাবার ব্যাগ অনেক আগে থেকেই ডাঃ এর চার্ট অনুযায়ি গোছানো ছিলো । তবু দ্রুত হাতে একবার চেক করলো । প্রিয়তা ফাইলটা ছোট বোন সৌমির হাতে দিয়ে বললো , ন্যান্সি এলে যেন তার হাতে দিয়ে দেয় । বলতে বলতেই বায়রে কলিং বেলের আওয়াজ । দরজা খুললো ওর মা , দেখলো ন্যান্সি এসে হাজির —
ঃ কি ব্যাপার প্রিয়তার কি খবর ? – খুব উৎকন্ঠিত মুখে জানতে চাইলো প্রিয়তার ৬ বছরের কলিগ এবং বহুদিনের পড়শি । যদিও ওদের ফিল্ড আলাদা । তবু ওদের সখ্যতা বহুদিনের । ন্যান্সি দুই বাচ্চার মা , তাই প্রিয়তার মুখ দেখেই বুঝে ফেললো , যে প্রিয়তার লেবার পেইন শুরু হয়েছে । ন্যান্সি বললো ,তার আর কোন হেল্প লাগবে কিনা ? ওর মা পারভীন আক্তার বললো, ঃ না মা , তুমি ফাইলটা শুধু অফিসে পৌছে দিও , তাহলেই হবে । ওর মা নিজেই ড্রাইভ করতে পারে । সংসারের নব্বই ভাগ কাজ তাকেই করতে হয় । প্রিয়তার বাবা আহাদ শিকদার , ব্যাংকের একজন ফাইন্যান্স অফিসার । তার কাজ বাড়ী টু অফিস , অফিস টু বাড়ী । খুবই অলস প্রকৃতির মানুষ । খুব সরল সোজা মানুষ । কোন কিছুর মধ্যেই সে থাকতে চায় না । তাইতো পারভীনকেই শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে । আজ ১৮ বছর কানাডায় এসেছে । প্রথম দু’বছর খুব কস্ট করেছে । তিন বাচ্চার স্কুলে আনানেওয়া আবার পার্টটাইম একটা জবও করতে হয়েছে । বাসার সব কাজতো রইলোই । আহাদ তখন এখানে ওখানে পার্ট টাইম জব করে , আর তার স্পেসিফিক জবের জন্য রিজুমি দিয়ে বেড়ায় ।যদিও বাংলাদেশে তার সুদীর্ঘ ১৭ বছরের ব্যাংকিং এক্সপেরিয়েন্স ছিলো । তবু এই জব পেতে তাকে প্রায় আড়াই বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে । সে ঢাবি থেকে ফাইন্যান্সে মাস্টার্স । তবু আবারো এখান থেকে আড়াই বছরের মধ্যে ফাইন্যান্সের উপর দু’ বছরের একটা ডিপ্লোমা করেছে । আবার উইকেন্ডে ফুল টাইম আর উইক ডেতে রাতের সিফটে জব করেছে । অতপর , সি আই বি সি তে জবটা পেয়েই গেলো ।৫/৬ বছরের মাথায় স্কারবরোতে প্রায় ৪৫ বছরের পুরানো এই বাড়ীটা বেশ সস্তায় পেয়ে কিনে ফেলেছিলো । অবশ্য পরে রেনোভেশনে ভালো টাকা খরচা হয়েছে । বেজমেন্টের এক্সিট ছিলো না । ওটাকে লিগালাইজ করে , এক্সিট করতে ভালো টাকা গচ্চা গেছে । অবশ্য এখন তাই ১৬০০$ ডলার ভাড়াও পাচ্ছে । পর পর দুই মেয়ে – প্রিয়তা, অমিতা । চার বছরের ব্যবধানে ছোট মেয়ে সৌমি । প্রিয়তা – সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার । অমিতা- বায়োটেকনোলোজিস্ট । ছোট মেয়ে – রায়ারশন বিশ্ববিদ্যালয়ে নার্সিং দ্বিতীয় বর্ষে আছে । জীবনটা বেশ গুছিয়ে নিয়েছে । যদিও তার জন্য স্বামী , স্ত্রীর প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছে ।
ওদের বাসা থেকে ক্লিনিকের দূরত্ব ১৫ মিনিটের ড্রাইভ । যদিও প্রিয়তা খুব বেশী শান্ত স্বভাবের এবং এতক্ষন চুপচাপ ছিলো । এতক্ষনে হাল্কা কষ্টের শব্দ করছে । তার মানে এখন প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে । পারভীন ড্রাইভ করছে । পেছনে প্রিয়তাকে ধরে বসে আছে সৌমি । অমিতা মেনিটোভায় থাকে । ওর ওখানেই জব হয়েছে । সেখানে একটা স্টুডিও এপার্টমেন্ট রেন্ট করে থাকে ।
সকালে যখন হাল্কা ব্যথা হচ্ছিলো, তখনই সে আতিক কে ফোন দিয়েছে । সে রিসিভ করেনি । এখন গাড়িতে বসে আরো একবার এস এম এস করলো ডিটেলস জানিয়ে । আতিকের ফোন আসতে যত দেরী হচ্ছে ; প্রিয়তার অস্থিরতা আরো বেড়ে চলেছে । লেবার পেইনের সাথে আতিকের দেওয়া এই নিস্পৃহ পেইনে ; সে কেমন জানি বিভ্রান্ত বোধ করছে ।হাসপাতালের গেটে চলে এসেছে । পারভীন , সৌমিকে বললো ঃ তুই ওকে ধরে ধরে নিয়ে যা , আমি গাড়ী পার্কিং করে আসছি ।
কষ্ট হলেও প্রিয়তা নিজেই তার ডাঃ এর রুমে চলে এলো । ডাঃ জেনেট খুবই নরম মনের মহিলা । ওকে দেখেই , নিজেই উঠে এলো ,তারপর ওকে ধরে একটা রুমে নিয়ে গেলো । সৌমিকে চোখের ঈশারা করে বললো চলে যেতে । সৌমি খুব নার্ভাস ফিল করছিলো । এখন রুমের সামনে হলওয়েতে দাড়িয়ে কান্না শুরু করে দিলো । সে আপুর কষ্ট সহ্য করতে পারছিলো না ।এমন সময় আব্বুর ফোন এলো —-
ঃ কি রে সৌমি , তোর মা ফোন ধরছে না কেনরে ?
ঃ আম্মু তো গাড়ী পার্কিং করতে গেছে ; সৌমি ফুপিয়ে বললো ।
ঃ তুই কাঁদছিস কেন ?
ঃ আপুর খুব কষ্ট হচ্ছে ।
ঃ কান্না থামা । দোয়া ইউনুস পড় । আমি এখুনি আসছি — আহাদ অস্হির কন্ঠে বললো ।
নিরবিচ্ছিন্ন চরিত্রের আহাদ জীবনে কোনদিন ভার নিতে শেখেনি । আর এই প্রায় শেষ জীবনে এসে ( তার পেনসনের আর ৪ বছর আছে ) একি পাকে সে জড়িয়ে যাচ্ছে !
“ কোনদিন যে ভোর দেখে না সে একদিন হটাৎ জেগে উঠলো
চুম্বক টানে বাইরে এসে সে ধারাস্নান নিল
বেদনারা কোয়ার মত আলোয়
……………….
তুলোর আগুনের মত ধিকিধিকি করে পুড়ে যাচ্ছে সব স্বপ্ন
সে ভেবেছিল শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে দ্রুত যত পারা যায়
ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে যাবে ।”
কিন্তু আহাদের মাথার ভেতরে এখন কয়েক টনের ভারে সে ন্যুব্জ । তাদের এই প্রথম নাতি আসছে । আনন্দে কোলাহলে তাদের ফেটে পড়ার কথা । কিন্তু বুকের ভেতরে কেন আনন্দ বাজছে না ? বরং প্রিয়তার কথা ভেবে তার বুকের ভেতরটা চৌচির হয়ে যাচ্ছে । আহা তার অতি সরল , কিছুটা বোকা বোকা , খুউব শান্ত মেয়েটার কপালে একি দূর্গতি !! সে এখন কি করবে ? কি ভাবে তার এই অসম্ভব ভালো মেয়েটির ওষ্ঠে আবার হাসি এনে দিবে ?
সিসটারের কাছে পারমিশন নিয়ে সে লেবার রুমে গেল । দেখলো তার স্নিগ্ধ পদ্মের মত মেয়েটির মুখখানি বিষন্ন , বিবর্ণ ।সে পায়ে পায়ে প্রিয়তার কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখলো । সাথে সাথে ওর চেপে রাখা দুঃখ গুলো এক সাথে স্রোতের ধারায় , অশ্রু হয়ে বেরিয়ে এলো । আহাদ বিড়বিড় করে বললো —
ঃ কাঁদে না মা , কাঁদে না । সব ঠিক হয়ে যাবে ( যদিও সে জানে কিছুই আর ঠিক হবে না ) ।
ঃ আব্বু , আমি আতিক কে ফোন করেছি , এস এম এস দিয়েছি , কোন কিছুরই জবাব দিচ্ছে না ।
ঃ হু, অফিসেতো , তাই বোধহয় জানতে পারছে না ,( যদিও জানে, সে কঠিন মিথ্যা বলছে । একশত ভাগ স্তোক বাক্য বৈ আর কিছু নয় , তবু তাকে করতে হচ্ছে এই অভিনয় ।)
এমন সময় ডঃ জেনেট এসে বললো ঃ প্রিয়তার হাসবেন্ড এখনো আসছে না কেন ?
ঃ ডাঃ প্লিজ তুমি এক মিনিটের জন্য বায়রে আসো ।
সাথে সাথে ডাঃ জেনেট বেরিয়ে এলো ।প্রশ্ন নিয়ে আহাদের দিকে চেয়ে রইলো । আহাদ অনেকটা ফিসফিস করে বললো ঃ ওর হাসবেন্ড আর আসবে না । দু ‘ সপ্তাহ আগেই আমি আতিকের পাঠানো ডিভোর্স এর উকিল নোটিস পেয়েছি । কিন্তু আমি প্রিয়তার এডভান্স স্টেজ বলে ,ওকে এটা জানাই নি । শুধু ওর মা আর আমি জানি ।
ঃ ওহ । পুওর বেবী !!, খুব ভালো করেছো তুমি ওকে না বলে । ওর আইরন লেভেল খুব কম ছিলো । হয়ত ব্যাপারটা জানতে পারলে একটা এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারতো ।
ওদের পাশে পারভীন এসে দাড়িয়েছিলো । সেও তখন ঢুকরে ঢুকরে কান্না শুরু করলো । ডাঃ জেনেট পারভীন কে বললো ঃ উহু। না । মিসেস আহাদ , তুমি যদি ভেঙ্গে পড়ো , ও বুঝে ফেলবো ! এমনিতেই সে বারবার তার হাসবেন্ডকে ফোন করছে ! এবং , আমি তাকে আসবার পর থেকে তিনবার জিজ্ঞাসা করেছি Epidural ইনজেকশন টা দেবো কিনা ? কারন তার প্রচন্ড লেবার পেইন হচ্ছে । কিন্তু প্রিয়তা বারবার বলছে তার ব্যাথা কমানোর ইনজেকশন এর দরকার নাই । আমাদের নার্স এবং আমি এতটা বিস্মিত কখনো হইনি । কারন অন্যরা যারা লেবার পেইন নিয়ে আসে, তারা এসেই আমাদের পাগল করে দেয় , Epidural নেবার জন্য !,, এতক্ষনে বুঝলাম , ওর বুকের ভেতরে এতটাই কষ্ট হচ্ছে যে , সে লেবার পেইনটা পর্যন্ত ইগনোর করছে ! ঠিক আছে তোমরা নিজেদের কন্ট্রোল করো । আমি ওদিকটা দেখছি ।— হটাৎ আহাদ বললো-ঃডাঃ, প্রিয়তাকে আর কষ্ট দিও না । দরকার হলে ওকে সিজার করে দাও । আমার মেয়েটা বড্ড নরম , আমাদের খুব আদুরে ছিলো । কি জানি কেন ওর জীবনে এমনটা হলো ? বলতে বলতে এই প্রথম আহাদ শিকদার হু হু করে কেঁদে ফেললো । ডঃজেনেট উদ্বিগ্ন ভাবে বললো ঃ প্লিজ তোমরা শক্ত হও । তা না হলে প্রিয়তা এই সময়ে জেনে ফেললে মারাত্মক একটা এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে ।
প্রিয়তার ব্যথাটা এখন হটাৎ কম মনে হচ্ছে । আজব ব্যথা । কিছুক্ষন পর পর ব্যথাটা উঠা নামা করছে । অনেকটা আতিকের মত । বিয়ে হয়েছে এই চার বছর । তবু ওকে বুঝতে পারলো কৈ । অথচ বিয়ের আগে ওদের পরিচয় এবং , প্রনয় পর্ব এক বছরের মত সময়ে , আতিক কে ক্লিয়ার বুঝতে পারতো । আসলেই কি বুঝতে পারতো ? কি জানি ? নিজেকেই প্রশ্ন করলো মনে মনে । হটাৎ ওর হাসি পেলো । বিয়ের আগে কি পাগলামিটাই করেছে আতিক ওর জন্য ।
তখন সবে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং এ পাস করে এক বড় কোম্পানিতে জব টা পেয়েছে । স্যালারীটাও ডিসেন্ট অংকের । সব মিলিয়ে মনে মনে সে উড়ছে । সবে ২৩ বছরের প্রিয়তা । শরীরে মননে উড়ছে । তখন সব কিছুই ভালো লাগে । তবু তার ভেতরে বাঙ্গালী সত্বাটা প্রবল । যদিও যখন সে বিডি র থেকে এসেছে তখন সে ৫ বছরের শিশু । অমিতা ২ বছরের । সৌমি ওদের কানাডা আসারও ৩ বছর পর হয়েছে ।
প্রিয়তার পড়াশুনা প্রথম থেকেই এখানে । তবু পরিধানে সে আগাগোড়াই রক্ষনশীল । যদিও সে হেজাব পরে না । কিন্তু সে আজ পর্যন্ত লেগিং এর পরে কখনো সার্ট বা টপস পরেনি । এমনকি সে কখনো কেপরীও পরে না । অমিতা সবই পরে । ওরজন্মদিনে অমিতা একটা কেপরী এবং স্লিপ লেস হাতের টপস দিয়েছিলো । প্রিয়তা কখনো পরেনি । অমিতা রাগ করে নিজেই সেটা পরেছে ।
সেদিন ঈদ বাজারে এসেছিলো ওরা চারজন । তিন বোন আর প্রিয়তার একদম ছোট্টবেলার বন্ধু সোমা । অমিতা একটা গারারা চয়েস করেছিলো । ওরা তিনজন , তিনটা সালোয়ার কামিজ কিনে ফেলেছে । এখন এই গারারা নিয়েই দর কষাকষি চলছিলো । নীল আর হলুদের কম্বিনেশন । দামটা বলছে ৩৫০$ ডলার ! ওরা ২০০$ডলারের জন্য চাপাচাপি করছিলো । হটাৎ পেছন থেকে কেউ বললো—
ঃ কি রে সোমা কেমন আছিস ?
ওরা পেছন ফিরে দেখলো দুটি ছেলে ওদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে ।
ঃ আরে দীপক ভাই তুমি যে ?
ঃ হ্যা, আমরাও পান্জাবী কিনতে এসেছি ।
ঃতাই নাকি ? কিনেছো ? ও , হ্যা তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই , এ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড , প্রিয়তা । আমরা এক সাথেই পড়াশুনা করেছি সেই প্রাইমারী ক্লাস থেকে । আর এ হলো প্রিয়তার পরের বোন অমিতা । প্রিয়তা – এ হলো আমার কাজিন দীপক ।
দীপক সবার সাথেই সালাম বিনিময় করে, তার বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো , আর এ হলো আমার বন্ধু , আতিক । এবারে অতিকও সহাস্যে সবাইকে সালাম দিলো । তারপর নিজেই , নিজের পরিচয় দিলো । বাংলাদেশ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রিপল ই , পাস করে ওখানেই তিন বছর টিচিং করেছে ।এখন রায়ারসনে এম, এস শেষ করেছে , কিছুদিন হলো একটা কাজ পেয়েছে , তবে কনটাক্টে ।
পরিচয়ের মধ্যেই নিলম” এর খোদ মালকিন এসে পড়েছিলো ,উনি ২৫০$ ডলারে রফা করলো । দু’ পক্ষই খুশী মনে কেনা কাটা করলো । তখন দীপক হটাৎ বললো –
ঃ সোমা চল, চটপটি খাই , ফুচকাও আছে ।
অমিতাই আগে লাফ দিলো , তার বোন কে বললো –
ঃ চল , আপু ফুচকা খাই ।
ওরা হৈ চৈ করে ফুচকার অর্ডার দিলো । সবার আগে পানির গ্লাস নিয়ে বসলো । প্রিয়তা ঘরের থেকে খোরমা নিয়ে এসেছিলো । সবার হাতে ১ টা করে দিলো । ফুচকা আসতে আসতে প্রিয়তার সেল ফোনে আজান দিলো । প্রিয়তার অজু করাই ছিলো । সে মোনাজাত করে আগে খোরমা খেলো তারপর পানি খেয়ে , ফুচকা খেলো ।
আতিক মুগ্ধ হয়ে ওকে অবজারভ করছিলো ।
ফুচকা খেয়ে ঐ সব দোকানের একটা কোথায় দাড়িয়ে নামাজও পড়ে এলো । তারপর ওরা যার যার বাসায় চলে গেল । সেদিন প্রিয়তার মনে আতিকের জন্য কোন ছায়াপাত হয়নি! তবে আতিকের মনের গহীনে প্রিয়তা রয়ে গেল ।
২.
এই পরিচয়ের ২/৩ সপ্তাহ পরই একদিন লান্চ টাইমে প্রিয়তা, কেবল লান্চের বক্স খুলে বসেছে , তখুনি একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন এলো । যদিও সে আননোন নম্বরের ফোন ধরে না । তো এখন লান্চ টাইম, তাই কি মনে করে ধরলো ।
ঃ হ্যালো , কে বলছেন ?
ঃ বলুনতো কে ?
ওর কথার টানে ধরে ফেললো সে , ওটা আতিক । ওর কথার টানে , তার নিজ এলাকার টান টা স্পষ্ট । তাই সে হেসে হেসেই বললো –
ঃ হু , তাহলে সোমার কাছ থেকে নাম্বারটা নেওয়া হয়েছে ?
ঃ তবে ডাইরেক্ট নয়, ভায়া দীপক । তাই সোমা ক্ষমার যোগ্য
তার বলার ভঙ্গিতে প্রিয়তা হেসে ফেললো । হেসেই বললো –
ঃ ওকে দুজনকেই ক্ষমা করা গেলো । তা আমাকে কি করতে হবে ?
ঃ অফিসের পর আমরা একটু দেখা করতে পারি কি ?
ও একটু ভাবলো । ওর বাবা আবার বেশ কনজারভেটিভ । তাই প্রতিটি পা তাকে অনেক ভেবে ফেলতে হয়েছে সারাজীবন । তবু আজ কেন জানি একটু নিয়মের বায়রে যেতে ইচ্ছা করছে ? কি জানি কেন ?
৫ টার দিকে তারা “ বে এন্ড ইয়াঙ” এর ফুট কোর্টে দেখা করলো । দুটো চেয়ার টেবিলে বসলো । আতিক নিজেই বললো , আমরা ডিনারটা করে ফেলতে পারি ? প্রিয়তা রাজী হলো না । অতপর: আতিক দু পিস ব্লাক ফরেস্ট কেক আর দুটো কফি নিয়ে এলো । প্রিয়তা কোন কথাই বলতে পারছিলো না । যদিও আতিক আজ প্রচুর কথা বলছিলো । প্রিয়তা মনে মনে খুব অবাক হচ্ছিলো । সেদিনের সেই লাজুক আতিকের মধ্যে আজকের আতিকের কোনই মিল ছিল না । আজ সে রীতিমত স্বচ্ছ , চটপটে । আর বেশ মিস্টি । তাকে আবার বিভিন্ন জোকস বলে বলে খুব হাসাচ্ছিল । প্রিয়তা এক বুক ভালো লাগা নিয়ে বাড়ী ফিরে গেল ।রাতে ঘুমাবার আগে রোজকার মত , দু বোনের ফিসফাস চলছিলো । অমিতা আর প্রিয়তা দু শরীরে এক আত্মা । আজকের পুরা ঘটনাই , অমিতাকে ,সে সবিস্তারে বললো । অমিতা সব শুনে বললো , দেখে শুনে , সাবধানে পা ফেলতে ।
এরপর তাদের প্রত্যহ দেখা হওয়া কোন কিছুতেই আটকানো গেলনা । এমনকি উইকেন্ডেও তারা নানান বাহানায় দেখা করতে শুরু করলো । অবশেষে সোমাও সব জানতে পারলো । সোমা দীপক কে সব বললো । দীপক ও খুব উৎসাহিত করলো । বললো ছেলেটা খুব বনেদি এবং শিক্ষিত পরিবার । তবু আমি আরো খোঁজ খবর নিয়ে তোমাকে জানাবো ।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাদের অলক্ষ্যের প্রেম , একটি লক্ষ্যে চলে এলো । দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়েটা হয়ে গেলো ; যদিও আতিকের পরিবারের মা/ বাবা/ বড় ভাই কেওই আসতে পারলো না । তবে কথা হলো আগামী বছরেই তারা দেশে যাবে এবং বড় করে অনুষ্ঠান করবে । তবু আহাদ শিকদার আর পারভীন আক্তার কোন কিছুই কম করলো না । অনেক বড় পার্টি করলো । প্রায় ২০০ এর মত মানুষ এলো তাদের বিয়েতে । বিয়ের লেহেঙ্গা, অমিতা প্রেজেন্ট করলো । পারভীন আক্তার ১৭ ভরি দিয়ে একটা সোনার সেট দিলো । আহাদ শিকদারের ছোট ভাইও কানাডায় থাকে । সে একটা রাডো ঘড়ি দিলো জামাইকে । প্রিয়তাদের দিক থেকে কোন কমই হলো না । আতিক আগেই , স্কারবরো তে বাসা নিয়েছিলো ( ড্যানফোর্থ এন্ড ইগলিন্টন এরিয়ায় ) । বাসার সমস্ত ফার্নিচার তারা দুজন মিলে ব্রীক থেকে কিনেছিলো । দুজনের যৌথ টাকা দিয়ে । বিয়ের রাতেই তারা নিজের বাসায় উঠলো । হানিমুনে তারা , নায়াগ্রা,তে গিয়েছিলো ৪ দিনের একটা ট্রিপে । HOLIDAY INN এ । এটা উপহার দিয়েছিলো দীপক । সোমা তার বেডরুমের , সেট কেনার সময় , ড্রেসিং টেবিলের দামটা দিয়েছিল।
প্রথম ৬ টি মাস কি ভাবে যে কেটে গেল , প্রিয়তা নিজেই জানে না ।
যদিও দুই বছরের বেশী সময় আতিক কানাডাতে এসেছে । এতকাল একা ছিল । সবই তাকে করতে হয়েছে । কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় , বিয়ের পর থেকে , আতিক একদম টিপিক্যাল বাঙ্গালী ছেলেদের মত , রান্না ঘরের ধারেও আসে না । বিয়ের পর পর কিছুদিন এটা বেশ এনজয় করেছে প্রিয়তা । কিন্ত তার অফিস ৮ থেকে ৪ টা । ভোর ৫ টায় উঠেই তাকে সব কিছু শুরু করতে হয়। সকালের নাস্তা । দুজনের লান্চ । এমনকি লান্চের বক্সটা আতিকের গাড়িতে রেখে আসতে হয় । একদিন বেশ তাড়াহুড়া করে অফিসে যেতে হয়েছিল , আতিকের লান্চ রেডী করে কিচেনের কাউন্টার টপে রেখে এসেছে । বাড়ী এসে দেখে , আতিক লান্চ না নিয়েই চলে গিয়েছে । অথচ , আতিকের অফিস মাত্র ৭/১০ মিনিটের ড্রাইভ । আর প্রিয়তার ৪৫/ থেকে ১ ঘন্টার ড্রাইভ । এটা নিয়ে কথা বলায় , তার জবাব ছিলো — আজ গাড়ীর মধ্যে দাও নি কেন ?
সেই শুরু । মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভাঙ্গা চোরা শুরু হলো , আতিকের প্রতিটি ব্যবহারে ।
এরপর, তার শশুর শাশুড়ী বেড়াতে এলো । যদিও প্রায় ৬ মাস ছিলো । প্রথম প্রথম প্রিয়তা তার স্বভাব সুলভ নম্রতার সব টুকু ঢেলে দিলো তাদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় । তাকে অফিস থেকে এসে রান্না করা, ঘর ক্লিন , এমনকি টেবিলে খাবারটা পর্যন্ত বেড়ে দেওয়া । প্রথম প্রথম শাশুড়ী মা , তাকে হেল্প করতে চাইতো । কিন্তু একদিন উইকেন্ডে , রান্নার সময় , শাশুড়ী তাকে পেয়াজ ,সবজী কেটে দিচ্ছিলো । আতিক রান্নাঘরে এসে তার মাকে বললো ঃ মা, তুমি কেন কাজ করছো ? তুমি বেড়াতে এসেছো । তাছাড়া তোমার বৌমা আছে না ?
ঃ তোদের এখানে কাজের লোক নাই , প্রিয়তা একা একা কত করবে ?
ঃ না, না, মা , তুমি এদিকে আসো , ও একাই একশো ।
এবং, এরপর আশ্চর্য জনক হলো, উনি রান্নাঘরের ধারে কাছেও আসে না । কোন কাজেই হেল্প করে না । উল্টো , সে অফিস থেকেই এলেই শুরু হয়ে যেত তার নানান খাবারের বাহানা । এমনকি, বৌমা , মাথায় একটু তেল দিয়ে দাওতো ? নখটা একটু কেটে দেবে ? ইত্যাদি । তবে শশুর বাবা মাঝে মাঝে বলতো, বৌমা অফিস করে , একা কত করবে ? ৬ মাস পর ওরা দেশে গেলো । এই ৬ মাসের মধ্যে মাত্র ৪/৫ বার সে বাপের বাড়ী গেছে । মায়ের রাজ্যের নালিশ এর সামনে, প্রিয়তা এক রাশ বেদনাহত বোবা চাহনি নিয়ে বসে থাকতো । ততোদিনে সে এতটুকু বুঝে গেছে, নিজে বিয়ে করার যন্ত্রনা !!, কোন দিকেই উঁচু গলায় কথা বলা যায় না । তবে , ওর বাবা ঠিক বুঝে যেত। মনে হয় , ওর বাবা খুব ছোট বেলা থেকেই ওর ভেতোরটা দেখতে পায় । ওর সবটুকু কষ্ট । আনন্দ । সঅব ।
এই এতটুকু বয়সেই সে বুঝে গেল, সবাইকে আনন্দের ভাগ দেওয়া যায় । কিছু কষ্টের কথা সবাইকে বলতে নেই । তবু অমিতা বুঝে যায় । কারন, একমাত্র অমিতা তার গলার ভাজ, চোখের কাঁপুনি সঅব চিনতো । এক সাথে বড় হয়েছে । কত ঝগড়া , কত ভালবাসা ; সব এক সাথে । কোন কিছুই ওর কাছে লুকানো প্রায় দুঃসাধ্য ।
বিয়ের দু’ বছরের মাথায় , একবার অমিতা ওর বাসায় বেড়াতে এসেছিলো । যাবার সময় ওর গাড়ী বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুব ফিসফিস করে বলেছিলো— মনে হয় না তুই এই ঘরে বেশী দিন টিকতে পারবি ।
আতিক কে সত্যি বুঝতে পারছিলো না প্রিয়তা । প্রতিটি প্রহর যেন পরাজয়ের কথা বলছিলো তার সাথে । সে এই পরাজয় কিছুতেই মানতে পারছিলো না । নিজের সাথে নিজে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছিলো । তখন সে ভাবলো, হয়তো একটি বেবী এলে , আতিক চেন্জ হবে । যদিও সে মাঝে মধ্যে গায়ে পর্যন্ত হাত তুলছিলো । আবার বেশ কিছুটা পরেই এসে হাত , পা ধরতো । যাতে সে আবার ৯১১ কল না করে । কত রাত প্রিয়তা একাকি লিভিং রুমে অঝোরে কেঁদে কাঁটিয়েছে । এই ভাবে মেঘভাঙ্গা প্রহরের মধ্যে সে দিবা রাত্রি নিমজ্জিত ছিলো । এক ছুটির দিনে , আতিক কে, সে নিজেই বললো , আমাদের একটা বেবী এলে কেমন হয় ?
ঃ বেবী টা দেখবে কে ? দুজনই চাকরী করি ?
ঃ কেন ডে- কেয়ার অথবা আম্মু ।
ঃ ওকে । আমার তো কোন অসুবিধা নাই । যদি তুমি সব কিছু ম্যানেজ করতে পারো ।
আর তখনই সে ,মা , হবার জন্য মরিয়া হয়ে গেলো । যতটা না মাতৃত্বের জন্য , তার থেকে অনেক বেশী ছিলো সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্য । এবং , ৩/৪ মাসের মধ্যেই একদিন সে উল্লসিত ভাবে আতিককে , তাদের নবজাতকের আগমনি বার্তা শুনালো । আতিক কে বেশ উদ্ভাসিত মনে হলো । সে নিজে থেকে ই বললো , এখন থেকে তুমি সব কাজ করবে না । আমরা ভাগ করে করবো ।
প্রিয়তা , মনে মনে প্রবল আনন্দের স্রোতে ভেসে গেল । মনে হলো চিৎকার করে বলে , “ পেরেছি” আমি সত্যিই আতিক কে জয় করতে পেরেছি । প্রেগনেন্সির দু’ মাস সে সত্যিই নিষ্ঠার সাথে তাকে হেল্প করলো । এমনকি কোন এক বর্ষন মূখর , ছুটির দিনে , সে ঘোষনা করলো , আজ আমি নিজ হাতে তোমাকে খিচুড়ি, ডিম ভাজা খাওয়াবো। প্রিয়তাকে অত্যন্ত অবাক করে দিয়ে , সত্যি আতিক তাকে অতি সুন্দর খিচুড়ি , ডিম ভাজা খাওয়ালো । এমন কি , নিজে হাতে খাওয়ালো , সেই বিবাহ পর্বের প্রথম সোনালী দিন গুলোর মত । আহা এই সব দিন গুলো হারিয়ে কেন যায় ? আনন্দে প্রিয়তা কেঁদে ফেললো , আতিকের বুকের ভাজে ।
এরপর অফিস আর, ৬ সপ্তাহ পর পর একবার করে ডাঃ এর কাছে চেক করতে যায় । ৫ মাসের মাথায় চেক আপ এবং আলট্রাসাউন্ড এর রিপোর্ট দেখে ডাঃ জেনেটের মুখ গম্ভির হয়ে গেলো । সে তবু স্বাভাবিক কন্ঠে বললো —
ঃ প্রিয়তা, আমি খুবই দুঃখিত , তোমার বাচ্চার গ্রোথ নাই বললেই চলে । ৫ মাসে বেবীর যে ওজন হবে , তার প্রায় অর্ধেক ।
প্রিয়তার বুক কেঁপে উঠলো । আর ওর মা , পারভীন ঝাঁঝিয়ে উঠলো ডাঃ এর সামনেই ।
ঃ ডাঃ আমি এই কথা আগেই বলেছি ওকে, আমার তিনটে বেবী হয়েছে , তাছাড়া সে মারাত্মক দূর্বল ও । ঠিক মত খায় না ।
প্রিয়তা কোন কথা না বলে মায়ের সাথে , বাপের বাড়ী চলে এলো । সারাদিন চুপচাপ শুয়ে বসে কাটালো, অফিস গেলো না । ওর মা / বাবা ২/৩ মাস থেকেই ওকে নিয়ে আসতে চেয়েছে । সে আসেনি । ভেবেছে আতিকের সত্যিই বুঝি পরীবর্তন আসবে । কিন্তু মাস খানেক পরই , সেই আগের আতিক । সেই অর্ডার করা । চরম স্বার্থপরতা । বিয়ের পরপর আতিকের একটা কাজিন সেলিনা , ওদের বাড়ীতে এসেছিলো , স্বামী এবং দুই বাচ্চা নিয়ে । ৩/৪ দিন ছিলো । ওরা ফিলাডেলফিয়ায় থাকে । একদিন অফিস ফেরত , প্রিয়তা রান্না করছিলো । আবার আতিকের বারবার বিভিন্ন অর্ডারি খাবার, চা ও সার্ভ করছিলো । সেলিনার খুব খারাপ লাগছিলো — রান্না ঘরে এসে মুখটা কালো করে বললো
ঃ আতিক দেখি এখনও একটুও চেন্জ হয়নি । একই রকম আছে ।
ঃ কেমন চেন্জ ??
ঃ না , ওর তো “ বাই- পোলার “ অসুখ আছে । এই ভালো । এই খারাপ । দুটো রূপ । তুমিতো সবই জানো তাইনা ? আমেরিকায় আসার পর আমার বাসায় ৩/৪ মাস ছিলো , আমি খুবই টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম । এখন নিজেই বিয়ে করেছে । এখন নিশ্চই ভালো হয়েছে , কি বল??
প্রিয়তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল । তবু কিছুই বুঝতে দেইনি সেলিনা আপাকে । নিজে ভালোবেসে বিয়ে করার কত জালা , সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল । না যায় সওয়া, না যায় কাওকে বলা ? এক অসহনীয় অনন্ত দহন কেবল কুরে কুরে খায় অহর্নিশ ।
তবে আজকের ব্যাপারটা আলাদা ছিলো । বেবীটা এরই মধ্যে তার স্বত্বায় যেন মিশে গিয়েছিল । একেই কি মাতৃত্ব বলে ? সে জানে না । তবে ডঃ এর ঐ কথা শোনার পর থেকেই সে অনবরত চুপিচুপি কাঁদছিল । পারভীন দেখছিল এবং সবই বুঝতে পারছিল । সে অফিস গেল না এবং আতিক কে , এস এম এস করে জানিয়ে দিল সব, ডাঃ জেনেট যা কিছু বলেছে । সন্ধ্যায় তবু বাসায় রওনা দিল । একটা দিনেই মায়ের আদরে বেশ ফ্রেশ লাগছিল ।
বাসায় আসতে আসতে তার অনাগত সন্তানের কথা ভেবে সে অত্যন্ত উৎকন্ঠিত হচ্ছিল । কারন আতিকের যত্ন এবং সাহায্য তো দুই মাসেই শেষ । তারপর আবার সেই পুরানো আতিক । কিন্তু সেতো আর সেই পুরানো প্রিয়তা নয় । সে এখন প্রেগন্যান্ট । সব সময় ক্লান্ত বোধ করে । অফিসের কাজ । বাড়ীর কাজ , সব মিলিয়ে , তার নিজের প্রতি একদম যত্ন হচ্ছিলো না । তারপর মাঝেমাঝে খুব বমি হতো । নিজের রান্না একদম খেতে পারছিলো না । আতিক একটা ডিম ভেজে দিলেও , সে সোনা মুখ করে খাচ্ছিলো । সে সেটাও করতো না । মাঝেমাঝে প্রিয়তা কমপ্লেইন করছিল—
ঃ তুমিতো কিছু রাধতে পারো , আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছি ।
ঃ আমিতো তোমাকে আগেই বলেছি , আমার দ্বারা এসব হবে না । আর চাকরী করে তোমার পক্ষেও সম্ভব নয় ।
ঃ তাহলে চাকরী ছেড়ে দেই ?
ঃ তাহলে চলবে কি করে , বাড়ী কেনা হলো ।
ঃ বাড়ীর ২৫% ডাউন পেমেন্ট আমি দিয়েছি । এই দুই বছর মর্টগেজ ও আমিই দিয়েছি । এবারে তুমি চালাও ।
ঃ আমার পক্ষে সম্ভব নয় । আমার দেশে টাকা পাঠাতে হয় ।
ঃ তাই বলে কি আমরা কখনও বাচ্চা নিবো না ? এটা কেমন কথা বলছো ?,
ঃ বাচ্চা চাইছো , তো এখন ঠ্যালা সামলাও —- বিভৎস মুখ করে আতিক জবাব দিল ।
গত মাস তিনেক এরকম ঝগড়া ওদের ৩/৪ বার হয়েছে । কোন কাজ হয়নি । সে যেমন, তার থেকে এক ইন্চি পরিমান ও তাকে সরানো যায় না । একবার শশুর কে ফোন করে কিছুটা বলেছিলো ।কারন ঐ মানুষটা যথেষ্ট বুঝদার । তাতে হিতেবিপরীত হলো । বাসায় এসে প্রচন্ড ঝগড়া শুরু করলো । জিনিশ পত্র ভাঙ্গলো ।
ঃ তোর এত্ত বড় সাহস , আমার বাবাকে নালিশ করিস ?
প্রিয়তা ভয়ে , লজ্জায় কোন জবাব দিলো না । কাওকে বলতে পারছিলো না । এক অসহনীয় কষ্টে সে দিনে দিনে ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছিলো । অফিসের কলিগরা পর্যন্ত ওকে নিয়ে উৎকন্ঠিত ছিল ।
তবে আজকের ব্যাপারটা সম্পূর্ন আলাদা । সব কিছু ছাপিয়ে , আজ প্রিয়তার মাতৃত্বটাই প্রবল ভাবে জেগে উঠলো । বাসায় গিয়ে , বাচ্চার জন্য টুকিটাকি কেনা জিনিশ গুলো গুছিয়ে নিলো । তারপর তার নিজের বেশ কিছু কাপড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিশ গুছিয়ে নিচ্ছিল । এর মধ্যে আতিক এলো । সব কিছু দেখলো । তারপর ঠান্ডা গলায় বললো –
ঃ এসব কি হচ্ছে ?
ঃ কিচ্ছু না । অনেক আগেই যেটা হলে ভালো হতো । আমি এসময়টা আম্মুদের বাসায় থাকবো । আমি তোমাকে এস এম এসে লিখেছিতো , বেবীর কোন গ্রোথ নাই । আমি নিজের রান্না খেতে পারছি না । অফিস করে আমি এত কাজও করতে পারছি না । তুমি বলেছিলে , হেল্প করবে । মাত্র এক/ দেড় মাস হেল্প করলে । তারপর সেই আগের জায়গাতে চলে গেছো।
ঃ আমার পক্ষে ওসব সম্ভব নয় । আমিতো আগেই বলেছিলাম , চাকরী করে বাচ্চা নেওয়া যাবে না ?
প্রিয়তা যেন এতদিনে নিজেকে সত্যি হারালো , চিৎকার করে বললো —-
ঃ মানে কি ? যারা চাকরী করবে , তাহলে তারা কখনো মা হতে পারবে না ?
ঃ কেন পারবে না ? মা হতে চাইছো , তাহলে ঠ্যালা সামলাও ।
ঃ এটা বাংলাদেশ নয় , এটা কানাডা । এখানে সবাই সেয়ার করে কাজ করে । ঘরে বায়রে একা হাতে কেও করে না । তোমার মত কেও নবাবীও করে না । যদি ঘরের কাজ করতে না চাওতো, আমাকে চাকরী করা থেকে অব্যাহতি দাও , সেটাও তো পারো না ।
ঃ কি তুই আমাকে টাকার খোঁটা দিস ? তোর মত একটা মেয়েকে আমি বিয়ে করেছি, এটা তোর ১৪ গুষ্টির কপাল ।
ঃ তাই নাকি ? এত বড় নবাব সাহেব তো , বউ কে দিয়ে ইনকাম করাও কেন ?
ঃ কি ? যত বড় মুখ নয় , ততো বড় কথা ? আজ তোর একদিন কি , আমারি একদিন ! তারপরই সে ঝড়ের মত এসে প্রিয়তা মুখের উপরে এত জোরে ঘুষি মেরেছে , যে দূর্বল ,বিষন্ন প্রিয়তা নিজেকে সামলাতে পারেনি । মাথা ঘুরে পড়ে গেছে ; পড়বার সময়ে বেড সাইড টেবিলে কপাল ঠুকে গেছে । তবু ফ্লোরে পড়বার পূর্ব মুহূর্তে হাত দুটো দিয়ে নিজেকে ঠেকিয়ে ছিল। নাহলে ভুট হয়ে পড়তো । কপাল ফুটো হয়ে দর দর করে রক্ত ঝরছিলো । প্রিয়তা জ্ঞ্যান হারালো । কতক্ষন জানেনা । নিজের থেকেই জ্ঞ্যান ফিরে দেখলো আসে পাশে কোথাও আতিক নাই । তখন সে নিজেই ধীরে ধীরে উঠে দেখলো বাসার কোথাও আতিক নাই । মানে কাপুরুষ টা বৌ পিটিয়ে পালিয়েছে । একবার ভাবলো পুলিশ কল করবে । আবার নিজেকে নিরস্ত করলো । তারপর ধীরে ধীরে , গোছানো সু্যটকেস , ব্যাগ নিয়ে নিজেই গাড়ী ড্রাইভ করে আম্মুদের বাড়ী চলে গেলো ।
তারপর অনেক কিছু ঘটে গেছে এই ৪/৫ মাসে । তবু প্রিয়তা নিজের থেকে আতিক কে ডিভোর্স দেবার কথা একবারও ভাবেনি । যদিও তার আব্বু / আম্মু ঘোষনা করেই দিয়েছে , জীবন থাকতে ঐ বাড়ীতে আর যেতে দেবে না । আর আতিক একবার ও নিজে এসে অথবা ফোন করে ,এমন কি এস এম এস করেও ক্ষমা চাইবার চেষ্টা করেনি ।
উহ আবারও ব্যাথাটা চরম আকারে এলো । এবারে প্রিয়তা কোকিয়ে উঠলো —
ঃ উহ ডাঃ আর পারছি না ।
আর এন আবারো চেক করলো , এবং মাথা নাড়লো পজিটিভলি ,ডঃ এর দিকে চেয়ে ।ডাঃ জলদি করে প্রিয়তার মাথার কাছে এসে নরম সুরে বললো —
ঃ প্রিয়তা তুমি একজন গ্রেট ফাইটার , তুমি এমনকি ‘ Epidural “ ও নাওনি ….আর একটু নিজেকে ধরে রাখো প্লিজ ……..উহু এভাবে নয় … শ্বাস টা নীচের দিকে ঠেলে দাও …… হ্যা ,গাল দিয়ে নয়, শ্বাসটা নীচের দিকে …হ্যা ..হ্যা এইভাবে ..বেবী , তোমার বুকের উপর আসার জন্য অস্হির হয়ে গেছে । ওহ ! কি কষ্ট । উহ , এত্ত যন্ত্রনা ……সে আতিকের দেওয়া সব কষ্ট মনে করার চেষ্টা করলো…… আহ । আর যেন নিতে পারছে না … হটাৎ গোটা হাসপাতাল নাকি সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে , এক নবজাতক শিশুর ক্রন্দন ধ্বনিত হলো ………!
“ মেয়েটি একদিন পাখি হতে চেয়েছিলো ।
নীলাম্বরী আকাশে সে একটুখানি পাখা মেলার
আনন্দ চেয়েছিলো ,
কিন্তু একদিন হটাৎ আকাশ হয়ে গেলো ।
সে হয়েছিলো সব পাখীদের উন্মুক্ত ঠিকানা !!!
( মহাদেব সাহা)
সমাপ্ত।