নয়া ট্রেন্ডঃ টিকটক

শিশিরকন্যা জয়িতা

আমি বরাবরই সমকালীন বিষয় নিয়ে লিখতে পছন্দ করি। যুগের সাথে মানানসই, আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, অথবা আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মাঝে দারুণ ভাবে সাড়া ফেলেছে, এমন কিছ বিষয়ে। বিষয়টার ব্যাপারে খোঁজখবর করতে গিয়ে অনেক নতুন তথ্য সম্পর্কে যেমন অবহিত হই তেমনি জানতে পারি অনেক অজানা রহস্য। বিস্তর গবেষণার পর নিজেকে এই যুগের সাথে চলার মত চলনসই মনে হয়। মনে হয়, আমি এদের সাথে একই সমান্তরাল ভূমিতে অবস্থান করছি। 

জেনারেশন ওয়াই বা মিলেনিয়ালসরা যখন ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রাম নিয়ে খুবই সাড়া জাগিয়েছিল, তখন আমরা ওল্ড স্কুলাররা ভাবছিলাম, বাহ দারুন তো। প্রযুক্তি দুনিয়ায় এবং সামাজিক মাধ্যমে কি বড় ধরনের একটা পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু কে জানতো, এরপরও অপেক্ষা করছে আরো বিস্ময়। এরপর এলো আরো একটি যুগান্তকারী ভিডিও প্ল্যাটফর্ম যা সবার কাছে ‘টিকটক’ নামে হল পরিচিত। বর্তমান সময়ের টিনএজাররা হল যার মূল চালিকাশক্তি। প্রজন্ম জেড বা জেনারেশন জি এর ছেলেমেয়েরা বর্তমানে ‘টিকটক জেনারেশন’ নামে পরিচিত। যারা কিনা চিন্তাভাবনায়, সৃষ্টিশীল কাজে, কিংবা প্রভাব বিস্তারে আছে, সবার থেকে এগিয়ে।    

টিকটক কি? ২০১৬ সালে চায়নাতে একটি ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ উদ্ভাবিত হয় যার নাম ছিল Douyin. তবে তার বিস্তার শুধুমাত্র চায়নাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী এক বছরের মাথায় এটি সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হওয়া শুরু করলে, এই অ্যাপটিকে নতুন করে সাজিয়ে কিছু পরিবর্তন এর মাধ্যমে টিকটক নামকরণ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে তরুণ তরুণীদের মধ্যে এটি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারন এই অ্যাপটি দিয়ে ভিডিও তৈরি করে শেয়ার করা ছিল খুব সহজ একটি কাজ। 

জেনারেশন জি এর ছেলেমেয়েদের অন্য একটি নাম ডিজিটাল নেটিভস। কারন তাদের জন্ম ডিজিটাল যুগে, স্মার্ট ফোন আর ট্যাবলেটকে সাথে করে। স্মার্ট ফোনের আগে জীবন যাত্রা কেমন ছিল তা সম্পর্কে এদের বিন্দু মাত্র ধারণা নেই। এদের পারিবারিক জীবন, শিক্ষা জীবন ও সামাজিক জীবন সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ইন্টারনেট এর মাধ্যমে। ডিজিটাল নেটিভসরা ক্যমুনিকেশনে বিশ্বাসী। এরা পরিবর্তনে উৎসাহী। অনেক বেশী স্বাবলম্বী চিন্তা ধারার মানুষ এরা। সবসময় নতুন কিছু সৃষ্টির চিন্তায় এরা মগ্ন। আর তাইতো টিকটক তাদের এই চাহিদা পূরণের জন্য হয়েছিল সর্বশ্রেষ্ঠ সোশ্যাল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম।

একটি জরীপ অনুযায়ী, প্রতি মাসে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ টিকটক এর প্রচারমুখি দুনিয়াতে ঘুরাফিরা করে। এদের বেশীর ভাগেরই বয়স ১৪ থেকে ২৪ এর মধ্যে। আর যদি জেন জি এর কথা বলি, তাহলে পৃথিবীর ৬০% জেনারেশন জি এর ছেলেমেয়েরা টিকটক করে। নিঃসন্দেহে, এই ভিডিও প্ল্যাটফর্মটি তাদের মধ্যে দারুণ ভাবে পপুলার। বিশ্বের ১৫৫টি দেশে ৭৫টি ভাষায় এই টিকটক কার্যকরী আছে।

টিকটক এর মূল কেন্দ্র বিন্দু হল অডিও ট্র্যাক্স। অনলাইনে দারুণ পপুলার হওয়া কোন গানের ট্র্যাকে লিপ সিংক করা, কোন ট্রেন্ডিং টিউন এর সাথে নাচের ভিডিও তৈরি করা অথবা ভাইরাল হয়েছে এমন কোন অডিওর সাথে একটি অভিনয় ক্লিপ যুক্ত করে দেয়া, ব্যস এই হল টিকটকের জাদুগরি। Z দের দ্বারা তৈরি মাত্র ১৫ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের চিত্তাকর্ষক ভিডিওগুলোই সারা দুনিয়ায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করছে।    

তবে আরও কিছু কারসাজি আছে। প্রতিটি পোস্ট এর সাথে টিকটকাররা জুড়ে দেয় খুবই আকর্ষণীয় কোন হ্যাশ ট্যাগ যা কিনা টপিক এর সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। অনেক সময়, পুর্বে ভাইরাল হয়েছে এমন পোস্ট থেকে একই হ্যাশ ট্যাগ নিয়ে তাদের নিজেদের পোস্টে জুড়ে দেয়। যাতে টিকটক ফিডে তাদের পোস্টটি অনেক বেশী লাইক পায় এবং তড়তড় করে তালিকার উপরে উঠতে পারে। 

টিকটক দুনিয়াতে টিকে থাকতে গেলে বা নাম কুড়োতে গেলে জানতে হবে, বর্তমানে কি কি ট্রেন্ড পপুলার চলছে। তারপর সেগুলোকেই নতুন কায়দায়, নতুন ঢঙ্গে আবার নতুন ভাবে সৃষ্টি করে একজন টিকটকার আবার রিপোস্ট করতে পারে। সেখানেও কোন বাঁধা নেই। এই যেমন পুরোনো মাল নতুন মোড়কে ভরে ব্যবসাদাররা বিক্রি করে, ঠিক সেই রকম।   

প্রচারমুখি দুনিয়ায় ফ্যাশন, ব্যবসা এবং টিকটক এখন হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। প্রায় সময়ই বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাদের পণ্যের প্রমোশন বাড়াতে টিকটকারদের উদ্দেশ্যে হ্যাশ ট্যাগ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। আর ওমনি সারা দুনিয়ার টিকটকাররা সেই বিষয়ের সাথে মিল রেখে ভিডিও তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। ব্র্যান্ডের ম্যানেজারদের যেই ভিডিও পছন্দ হয় সেটা তারা তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডের জন্য ফিচার করতে পারে। আর ভিডিওটি যে বানায়, সে হয়ে যায় ‘স্টার টিকটকার’। 

আমার ক্লাসের ছাত্রীরা প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার টিকটক অ্যাকাউন্ট আছে কিনা। আমি হেসে বলি, “না নেই, কারন আমার বয়সটা একটু বেশী, টিকটক করার জন্য।” তারা মহা উৎসাহে আমাকে আরো বলে, “না, না বয়স কোন ব্যাপার না। যে কেউই টিকটক করতে পারে।” মিডল স্কুলে পড়া ১২/১৩ বছরের মেয়েগুলোর বেশীর ভাগেরই আছে টিকটক অ্যাকাউন্ট। ওদের থেকে জানলাম, যারা ট্রেন্ড সেটার তাদেরকে ডাকা হয় ‘টিকটক ইনফ্লুএন্সার’ । এরা কিনা প্রতি পোস্টে হাজার হাজার ডলার কামাই করে। এদের এক এক জনের ৫০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ফলোয়ারস আছে। 

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল, এই বহুল প্রচলিত এবং বহুল ব্যবহৃত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি ভীষন ভাবে তরুণ প্রজন্মের মানসিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই অ্যাপের সবচাইতে খারাপ দিক হল সাইবার বুলিং । বাই ডিফল্ট টিকটকের সব একাউন্ট থাকে পাবলিক। যে কেউ এতে কমেন্ট দিতে পারে। অপরিপক্ক বুদ্ধি ও কাঁচা বয়সের তরুণ তরুণীরা টিকটক পোস্ট দেখে যে বানিয়েছে তার চেহারা, স্বাস্থ্য, নাচ ও গানের দক্ষতা নিয়ে অপ্রীতিকর মন্তব্য, অপমানসূচক কথা, নির্দয় কটূক্তি করে থাকে। যার ফলোশ্রুতিতে অনেক টিনএজারদের মধ্যে বিরাজ করে ডিপ্রেশন, হতাশা, বিদ্বেষ, এমনকি আত্মহত্যা করার প্রবণতা। অনেকে, অন্যের পোস্ট করা কমেন্টের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেদের শারীরিক ক্ষতি সাধন করে। অনেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে করে দিয়ে অতিরিক্ত শুকানো বা অপরিসীম ওজন হ্রাসের চেষ্টা করে থাকে।

সম্প্রতি মার্কিন সরকার একটি অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চালু করে চায়নার কাছে অনুরোধ জানিয়েছে, যে তারা যেন মার্কিন টিনেজাররা যারা টিকটক ব্যবহারকারী তাদের ব্যাক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্যসমগ্র কিভাবে সুরক্ষিত হচ্ছে তার একটা বিশদ বিবরণ প্রকাশ করে। বলাই বাহুল্য, এর কোনো সঠিক জবাব বা গ্রহণযোগ্য রিপোর্ট এখনো মার্কিন সরকারের হাতে পৌঁছায়নি। বিভিন্ন খবরের সূত্র অনুযায়ী, টিকটক এবং তার অভিভাবক কোম্পানির অনেক কর্মকর্তা নির্দিধায় স্বীকার করেছেন যে মার্কিন ইউজারদের তথ্য সম্বলিত ডাটাবেসে তাদের পূর্ণ প্রবেশাধিকার আছে।    

প্রজন্ম জি এর ছেলেমেয়েরা ভীষণ ভাবে আলাদা। তারা নিজেদের সর্বক্ষণই তুলে ধরতে চায়, প্রকাশ করতে চায়। অচেনা, অপরিচিত মানুষের মাঝে দৃষ্টি আকর্ষণের মধ্য দিয়ে পায় অসীম আনন্দ। তবে তা কঠিন অধ্যবসায় ও শ্রম দিয়ে অর্জনের মাধ্যমে নয়। বিরাট কিছু আবিষ্কারের মাধ্যমে নয়। বরঞ্চ বিনা মেধায়, অল্প সময়ে, কিছু তড়িৎ কার্যকলাপের মাধ্যমে। লিপ সিঙ্কিং, ভিডিও এডিটিং, ফিল্টারিং, ইত্যাদি করার মাধ্যমে প্রতিভা বা গুণ কোনটারই প্রকাশ ঘটেনা। শিল্পের বহিঃপ্রকাশ তো নয়ই। এসবের মধ্য দিয়ে প্রকাশ ঘটে, কে কতটা টেকস্যাভি বা প্রযুক্তিতে পারদর্শী।

যতো দিন যাচ্ছে, আমাদের জীবন থেকে খাঁটি/অকৃত্রিম/বিশুদ্ধ শব্দগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা পুরোনো প্রজন্মের মানুষেরা চুপ করে মেনে নিচ্ছি, নীরবে দেখে যাচ্ছি। পরিবর্তনের এই ঝড়, ঠেকানোর নয়। যুগের পরিবর্তন, মানুষের পরিবর্তন, ধ্যান-ধারনার পরিবর্তন। আমাদের উত্তরসূরিরা এই পরিবর্তনের স্রোতে গা ভাসিয়ে চলেছে। কিন্তু ভয় হয়, এর পর কি হবে? এই ধারা আর কত দূর যাবে? প্রতিটা ভালোরই যে কিছু মন্দ দিক থাকে। 


Top

Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Ehsan
Ehsan
2 years ago

শিশির,
Good reading to understanding this Tic Toc influence in GenZ. All social media has impact as well responsibilities on content creators, users and providers. Before the evolution of technology our life was steady, peaceful and balanced. Now everything is moving with instant gratification and external exposures. The shifts in generation are so drastic and wide that we do not know ourselves. The Y,Z know all have info without life experience and journey. They are missing the human element in communication, group feeling and long relationships.
Very good prespective on what generation will come after the letter Z.
You have excellent eye on changes in behavior, habits, culture, society with free flowing thinking and being articulate.

শিশিরকন্যা জয়িতা
Reply to  Ehsan

Thank you so much for being my critic and providing such positive feedback!!
I find the changes in our current generation (Z & Alpha) intriguing but scary at the same time. I always feel the HUMAN element is missing in all their endeavors.
But I guess, they will be perfectly fine and feel normal being a part of their new cultures, trends, and advancement. Best wishes to them!


Copyright © 2023. All Rights Reserved.