প্রথম তুষার

কাজী সাব্বির আহমেদ

একজন বাংলাদেশীর জন্য জীবনের প্রথম তুষারপাত দেখাটা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কারণটা অবশ্য খুবই সাধারণ। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ মূলতঃ একটি গ্রীষ্ম প্রধান দেশ। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের আমাদের এই দেশে কোথাও তুষারপাত হয় না। ফলে বাংলাদেশীদের কল্পনায় তুষারপাতের শ্বেতশুভ্র দৃশ্যপটটা অনেকটা স্বপ্নপুরীর মতন, অন্তত প্রথম অভিজ্ঞতাটা হওয়ার আগ পর্যন্ত। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত আমাদের দেশে শীত পড়লেও সেই শীত রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার আশে পাশের অঞ্চলে তেমন একটা একটা অনুভূত হয় না। তবে বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়ে আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে আমি দীর্ঘ ছয়টি বছর বাংলাদেশের অন্যতম শীতের অঞ্চল রংপুরে কাটিয়ে এসেছি। রংপুরের সেই হাড় কাঁপানো শীতের ভোরে খোলা মাঠে পিটি প্যারেড করেছি। শীতের রাতে আমাদের হোস্টেলের রুমে কোন হিটিং-এর ব্যবস্থা ছিল না, সম্বল ছিল দু’খানা কম্বল মাত্র। তাতেই মনে করেছিলাম যে শীতকে আমি জয় করে এসেছি। সেই ভুল আমার ভেঙ্গেছিল যখন ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে উচ্চ শিক্ষার জন্য চীনের রাজধানী বেইজিং-এ আসি। সেপ্টেম্বর হচ্ছে ‘ফল’ বা পাতা ঝরার সিজন। শীতের আগমনী বার্তা। হাড় কাঁপানো শীত যে কি জিনিষ সেটা বেইজিং-এ এসেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে যাই। এই সময় সাইবেরিয়া থেকে ঠান্ডা বাতাস আসে। হু হু করে সেই বাতাস যখন বয়ে যেত তখন স্বল্প পরিচিত বেইজিং-কেও অদ্ভুত অচেনা লাগত। মনে হত পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে এসে পড়েছি। বেইজিং-এর বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত সিনিয়র ভাইয়েরা আমাদেরকে অবশ্য এই বলে আশ্বাস দিতেন যে, এই শীত এক সময় সহ্য হয়ে যাবে। সেই সাথে আমাদেরকে উৎসাহিতও করতেন যে, শীত যতই খারাপ হোক না কেন, এর একটি অপরূপ দিকও রয়েছে। সেটা হচ্ছে তুষারপাত।

তাই মনে মনে উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম কবে সেই অদেখা তুষারপাতের সাক্ষাৎ পাব। আমাদের ক্লাস নাইনের বাংলা বইতে সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত প্রেমের উপন্যাস ‘শবনব’-এর অংশ বিশেষ পাঠ্য ছিল। সেখানে লেখকের ভৃত্য আব্দুর রহমান তার নিজ শহর পানশিরের তুষারপাতের এক বিশদ বিবরণ দেন। ভৃত্য আব্দুর রহমানের কাছে এই তুষারপাতের সৌন্দর্য্য ছিল স্বর্গীয়। কিন্তু লেখকের কাছে সেই তুষারপাতের সৌন্দর্য্য তেমন আকর্ষণীয় মনে না হওয়ায় আব্দুর রহমান তার সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন, ‘ইনহাস্ত ওয়াতানাম’ – ‘এই তো আমার জন্মভূমি’। সেই থেকে মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে তুষারপাতের এক কাল্পনিক স্বর্গীয় দৃশ্য এবং গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছি কবে সেই কাঙ্ক্ষিত তুষারপাতের দেখা পাব।

সেই বহুল প্রত্যাশিত মূহুর্তটি অবশেষে এলো একদিন। সেদিন ছিল ৩০শে অক্টোবর,১৯৮৭ সাল। আমরা কয়েকজন সহপাঠী মিলে আমাদের বাংলাদেশ অ্যাম্বাসীর এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষ করে যখন বাইরে এসেছি আমাদের ছাত্রাবাসে ফিরব বলে ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। দেখি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। কিছুদূর হেঁটে আমাদের মেট্রো নিতে হয়। সেই হাঁটার মাঝেই টের পেলাম যে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ধীরে ধীরে তুষারকণায় পরিনত হয়ে যাচ্ছে। আর সেগুলো ফুটপাতের উপর জমা হয়ে হাল্কা এক শুভ্র আস্তরণের সৃষ্টি করছে। ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় সেই তুষারপাতের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল এটা যেন অন্য কোন এক পৃথিবীর দৃশ্য। অদ্ভূত সুন্দর এই দৃশ্যটিকে আমরা কেউই মিস করতে চাচ্ছিলাম না,তাই পাতাল ট্রেনে না চড়ে আমরা ট্যাক্সি নিলাম। আমরা যখন আমাদের হোস্টেলে এসে পৌঁছলাম তখন নরম ভেজা ভেজা তুষারে ডুবে যাচ্ছে পায়ের গোড়ালি অবধি। দেখি চারিদিকে ভীড়,আমাদের মতন অনেক দেশের ছাত্রদের জন্যও হয়ত এটাই প্রথম তুষারপাত। তাই ছবি তোলার ধুম পড়ে গেছে চারিদিকে। শিশুদের মতন স্নো বল বানিয়ে বড়রাও মেতে উঠেছে বল ছোড়াছোড়িতে। চারিদিকে এক নির্মল আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে এই তুষারপাত উপলক্ষ্যে। বেশ রাত অবধি আমরা বাইরেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন।

জীবনের প্রথম তুষারপাত -বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউট – লেখক

জীবনের প্রথম তুষারপাত -বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউট – দুই সহপাঠিসহ লেখক


Top

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments


Copyright © 2023. All Rights Reserved.