শেকল  

ফরিদ তালুকদার 

অফিস থেকে বের হয়ে আজ আর ট্রেন-বাস কিছুই নিলো না নাজমুল। কিছুটা সময় অফিসের কাছাকাছি ছোট পার্কটায়, পরে ঘন্টাখানেকের মতো উদ্দেশ্যহীন এদিক-সেদিক এলোপাতাড়ি হাঁটাহাঁটি, এরপরে পাব (pub) না কফিশপ এই ভাবতে ভাবতেই এই কফিশপটায় এসে হাজির। শুক্রবারের সন্ধ্যা। সময় মাত্র আটটার একটু পর। শনি-রবি এবং সামনে এখনো গোটা একটা রাত! কিভাবে কাটাবে? দীর্ঘ সময়টা এখনি যেন মনোজগতে একটা চাপের সৃষ্টি করছে। আজকের রাতটা আর অফিসে কাটাতে ইচ্ছে করছে না তার। আধুনিক অনেক কর্পোরেট অফিসেই ইদানিং মোটামুটি মানের একটা কিচেন, ছোটাখাটো জিম, টিভি, কয়েকটা কাউচ এর ব্যবস্থা অফিস স্পেসের সংলগ্নই থাকে। কাজের চাপ বেশি বা অন্য যেকোনো জরুরী প্রয়োজনে চাইলে কেউ দু’তিন সপ্তাহ কাটিয়ে দিতে পারে এখানে। ব্যবস্থাটা একদিকে ভালোই। তবে অন্যভাবে ভাবলে অতিরিক্ত ঘন্টা কাজ করানোর জন্যে নব্য এক পুঁজিবাদী কৌশলও বলা যায়। বিষয় যা-ই হোক, হুট করে বাসা থেকে বেরিয়ে এসে নাজমুল তার নিশি কাটাতে অফিসের এই ব্যবস্থাকেই ব্যবহার করছে। তবে এভাবে আর ক’দিন? এই সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও একটা পাকা বন্দোবস্ত করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ভবঘুরে হয়ে সময় কাটাতে তার কোনো সমস্যা হ’তো না। কখনো কখনো ব্যাগপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে পরতো কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই। তারপর যেকোনো একটা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে একটা বাসে উঠে দুই-তিন দিনের জন্যে উধাও!  ভবঘুরেপনাটা তার শখ এবং স্বভাবেরই একটা অংশ ছিলো। কিন্তু এই ক’দিনেই সে বুঝে ফেলেছে সেই অভ্যেস থেকে সে দূরে সরে এসেছে বহুটা পথ! একটা স্যান্ডউইচ (sandwich) আর কফি নিয়ে শপটার ডান প্রান্তের খানিকটা ফাঁকা জায়গাটার একটা টেবিল এসে বসলো সে। ভাবনাটাকে মাথা থেকে সরিয়ে দিতে ব্যাগপ্যাক থেকে ল্যাপটপের পরিবর্তে তার প্রিয় গল্প সংগ্রহের বইটা টেনে বেড় করলো। ইতিমধ্যে একবার পড়া একটি গল্পে মনঃসংযোগের চেষ্টা করে দেখলো তাও যেন টানছে না। গল্পটি তার পড়া প্রিয় গল্পগুলোর একটি। তবুও যেন…

আমেরিকায় দাসত্ব প্রথার আনুষ্ঠানিক বিলোপের প্রারম্ভিক সময়টা গল্পের পটভূমি। কৃষ্ণাঙ্গ দাস ম্যাথু আঠারো বছরের অধিক সময় ধরে তার সাদা মনিবের ক্ষেতে-খামারে কাজ করে আসছিল। স্ত্রী এবং তরুণী বয়সের এক মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট পরিবার ম্যাথুর। এক সন্ধ্যায় মনিব মিঃ কার্টার তাকে ডেকে আকাশ সমান বিস্মিত করে বললেন-

কাল থেকে তুমি মুক্ত মানুষ ম্যাথু। তোমার পরিবার নিয়ে যেখানে ইচ্ছে তুমি চলে যেতে পারো। তোমাকে যে আমি স্ব-ইচ্ছায় মুক্ত করে দিয়েছি তার প্রমাণ স্বরূপ এই কাগজটি তোমাকে দিলাম। সাথে রাখবে সবসময়। হারিয়ো না।

অনেক সময়ই মানুষ তার ভাবাবেগে এতোটাই আপ্লুত হয়ে পড়ে যে তার ব্যাখ্যা করা কঠিন। ঘটনার আকস্মিকতায় ম্যাথুর অবস্থাও তখন তেমনি। দাসত্ব প্রথা বিলোপের কথা ইদানিং ইয়াঙ্কিদের বাতাসে ভাসছে। এদিক-ওদিক হয়ে ম্যাথুর কানেও এসে পৌঁছেছে খবরটা। সে নিজেও মনে প্রাণে এই প্রথার বিলোপ চায়। কিন্তু এই সময়ে এভাবে!? মিঃ কার্টার তার হতবিহ্বল অবস্থা দেখে বললেন, কালকে বলছি বলে তোমাকে যে কালকেই চলে যেতে হবে তা নয়। এর অর্থ হ’লো তুমি কাল থেকে মুক্ত। চাইলে যেকোনো সময় চলে যেতে পারো। আর না চাইলে থেকে যাবে যতোদিন ইচ্ছে। সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে আমাকে জানিয়ো। ম্যাথুর দু’চোখের কোণ তখন নোনাজলে সিক্ত। খুব ভালো মানুষ মিঃ কার্টার এবং তার পরিবার। দাসদের সাথে মনিবদের ব্যবহারের যে সব গল্প ম্যাথু শুনেছে এই মানুষটির কাছ থেকে কখনোই তেমন ব্যবহার পায় নি। শুধু তার মেঝ ছেলেটা মাঝেমধ্যে…। মাথাটাকে খানিকটা অবনমন করে সে বেরিয়ে এলো। এই অবনমনে মিঃ কার্টারের প্রতি তার শ্রদ্ধা এবং ভক্তি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।

মনিবের বাড়ি থেকে তার ছোট্ট ঘরের দূরত্ব খুব বেশি নয়। কোনোকিছু সঠিক করে সে ভাবতে পারছে না। এইটুকু পথের মাঝেই সে যেন দেখতে পেলো তার জীবন নদীটা হঠাৎ তীব্র একটা বাঁক নিয়ে এক বিপুলতার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে যার ধারাটা একটু পরেই সে আর দেখতে পাচ্ছে না! সে কি এটা চায়? সাদাসিধা মনের মানুষ ম্যাথুর মনে এর কোনো উত্তর নেই। ভাবলো সবার আগে বিষয়টা তার স্ত্রী রোজালিনকে জানাতে হবে। সে হয়তো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। রোজালিনের সাথে আলাপ করে দু’দিন পরেই সে মিঃ কার্টারকে জানালো পরের সপ্তাহে তারা চলে যাচ্ছে। সিদ্ধান্তটা তারা যতোটা না মনের আনন্দে নিয়েছে তার চেয়েও বলা যায় দাস প্রথা বিলোপের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে মিঃ কার্টারের এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে। সিদ্ধান্ত শুনে মিঃ কার্টার শুধু বললেন যেদিকেই যাও পরিস্থিতি বুঝে চলবে। তবে আমার মনে হয় সাউথের দিকে না যাওয়াটাই ভালো কারণ ওদিকটায় এ বিষয়টা এখনো তেমন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। বরং তোমরা নিউইয়র্ক শহরের দিকে যাওয়ার কথা ভাবতে পারো। জ্বী বলে ম্যাথু মিঃ কার্টারের সিদ্ধান্তে সম্মতি জানালো।

মিঃ কার্টারের এমন হঠাৎ সিদ্ধান্তে পরিবারের অন্য সবাই বেশ একটা উষ্মা প্রকাশ করতে লাগলো। কারণ ম্যাথু একা তো নয়, ঘরোয়া টুকিটাকি কাজে রোজালিন এবং তাদের মেয়েটাও তো বড় এক সহায়ক শক্তি হিসেবে ছিলো। আর বাইরের বাতাসে যখন এমন একটা মুক্তি মুক্তি গন্ধ তাতে হুট করে ওদের জায়গায় কাউকে পাওয়াও সহজ নয় এখন। তবে বিষয়টা বেশিদিন বেশিদূরে গড়ালো না। চলে যাওয়ার প্রায় সপ্তাহ তিনেক পরেই মিঃ কার্টারকে কিছুটা বিস্মিত করে দিয়ে ম্যাথু তার সান্ধ্য বৈঠকখানায় এসে হাজির! মিঃ কার্টার জিজ্ঞেস করলেন কোনদিকে গিয়েছিলে? উত্তরে ম্যাথু বললো নিউইয়র্ক।  

— ওখানে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়? কাজ পাওনি?

— ম্যাথু ঘাড় নেড়ে জানালো না বিষয়টা তা নয়।

এবার মিঃ কার্টার বললেন ওহ্ বুঝতে পেরেছি। যেও না আমি এখনই আসছি। এতোদিন তালাবদ্ধ থাকা ম্যাথুর ঘরের চাবি নিয়ে ফিরলেন তিনি। চাবিটা ম্যাথুর হাতে দিয়ে বললেন নেও, ঘরটা এখনো তেমনই আছে। তারপরে বললেন বুঝলে ম্যাথু—

আমাদের জীবনে মায়াটাও এক বড় শেকল! আসলে শুধু বড় শেকলই নয় অন্যতম শক্ত শেকল! এই যে দেখ, পৃথিবীও তো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে অবিরাম। এর মাঝে নিশ্চয়ই মায়া-ভালোবাসা কিছুই নেই। বিজ্ঞান বলে মহাকর্ষ শক্তি। তা বিষয় যা-ই হোক, ঘুরছে এটাতো এক অমোঘ সত্য!

আর কিছু নয়, এই মায়ার টানেই আবার ফিরে এসেছে ম্যাথু। কিন্তু মুখ খুলে সেটা বলতে পারেনি! মিঃ কার্টার তার মনের কথাটা এমন করে পড়তে পারলেন বলে তার খুব ভালো লাগছে। জ্বী বলে ভক্তি ভরে মথাটাকে সেই আগেরই মতো খানিকটা অবনমন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে মিঃ কার্টার আবারও ডেকে বললেন শোন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে খামারের দক্ষিণ-পশ্চিমের ঐ কোণায়টায় তোমাদের নামে কিছু অংশ জমি আমি বন্দোবস্ত করে দিবো। পরে ধীরে সুস্থে ওখানেই তোমাদের থাকার জন্যে একটা ঘর তুলে দিবো। কথাটা শুনে এবার শুধু ম্যাথুরই নয়, রোজালিনের চোখের কোণও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো!

‘মায়া’! শুধুমাত্র অভ্যস্ততাই কি মারাত্মক  এই শক্ত বাঁধনটার শেকড় না এর বাইরে আরও কিছু আছে? নাজমুলের মনে এ প্রশ্নটা প্রায়শই ঘুরেফিরে আসে। কী আশ্চর্য! যে গল্পটা সে পড়তে গিয়ে ভালো না লাগায় থেমে গেলো এতোক্ষণ ধরে মনের ঘোরে তারই আদ্যপান্ত যেন সে আরেকবার ব্যবচ্ছেদ করলো! বইটাকে ফের ব্যাকপ্যাকের উদরে গুঁজে দিয়ে কফি কাপটা হাতে নিয়ে দেখলো ওর শরীর এখন কক্ষ তাপমাত্রায় নেমে গেছে! স্যান্ডউইচে কামড় পরেনি একটাও! আজ নয়দিন হয় সে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ভেবেছিলো সুশীলা হয়তো ফোন করবে। কিন্তু না তেমন কিছুই না। তবে মেসেজ পাঠিয়েছিলো দু’বার। দু’টো মেসেজই শাওতালীর পক্ষ হয়ে। প্রথম মেসেজটায় লেখা ছিলো ‘শাওতালী জিজ্ঞেস করেছিলো -বাবা গতকাল রাতে আসলো না কেন’? দ্বিতীয় মেসেজটা তারও চারদিন পর। লেখা ছিলো ‘শাওতালী জানতে চায় বাবা আর ফিরে আসবে কিনা’? কোনোটারই কোনো উত্তর দেয়নি সে। তবে তারপর থেকে ওপাশটাও চুপচাপ। শাওতালীকে কী উত্তর দিয়েছিলো সুশীলা কে জানে? তার অবর্তমানে বিল-বাট্টাগুলো পরিশোধ সহ দৈনন্দিন সব বিষয় যাতে করে সুশীলা ঠিকমত চালিয়ে নিতে পারে সেই সম্বলিত কিছু তথ্য এবং নির্দেশনা সে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রেখে এসেছিলো। জয়েন্ট একাউন্টে তার নিজের ব্যাংক কার্ডের পাসওয়ার্ড সুশীলা প্রায়শই ভুলে যেতো বলে ওটিও লিখে রেখে এসেছে এবং ওগুলোর সাথেই ছিলো অতি গুরুত্বপূর্ণ ডিভোর্সের কাগজটি! শাওতালী কি বিষয়টা এখন সব জানে? শাওতালী ছাড়া ইতিমধ্যে  আর কাকে কাকে বলেছে সুশীলা? বিষয়টা ভাবতেই তার শরীরে কেমন একটা ঘাম ঘাম ভাব হ’লো! হয়তো ক্লান্তি জনিত!?

ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটি যে সে খুব ভেবে চিন্তে নিয়েছিলো তা নয়। প্রায় মাস খানেক পূর্বের ঘটনা। শনিবারের সন্ধ্যায় বন্ধুর বাসায় নিমন্ত্রণ ছিলো। এধরণের অনুষ্ঠানগুলো নাজমুল ক্রমশঃ বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তো আর সম্ভব হয় না। সমাজ বলে কথা। পরিমন্ডলটা পারিবারিক। ব্যাচেলর থাকলে হয়তো অন্য কথা ছিলো। তাছাড়া মেয়ে শাওতালীর কথা ভেবেও সে এমন দু’একটা অনুষ্ঠানে এখনো যায়। অনুষ্ঠানের হোস্ট মইনের সাথে তার বন্ধুত্ব দেশে থেকেই। এখানে রিয়েল এস্টেট আর কনস্ট্রাকশন এর ব্যবসা করে তাদের চেয়ে অনেক স্বচ্ছল অবস্থা ওদের। বিপত্তির শুরুটা ওখান থেকেই। এধরণের অনুষ্ঠানগুলোর মূল উদ্দেশ্য যে শো-অফ (show off) এবং ব্যবসায়িক যোগাযোগ স্থাপন করা নাজমুলের তা জানতে বাকী নেই। ওদের অবস্থা এবং অবস্থান যে সুশীলার মনোজগতে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে সে ভয়টাও তার ছিলো। কিন্তু তারপরও…। বাসায় ফিরে সেই পুরনো নিয়মেই যেন উঠে এলো তাদের স্বপ্ন দৌড় থেকে পিছিয়ে পড়ার সাতকাহন!

সুশীলা বললো— ‘মইন ভাবী বলছিলো সামনের মাসে তারা সবাই ইউরোপ ট্যুরে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করছিলো আমাদেরও এমন কোনো প্লান আছে কিনা’?

নাজমুলদের অর্থনৈতিক অবস্থা মইনদের পরিবারে অজানা কিছু নয়। সুতরাং মইনের স্ত্রী এটা যে একেবারে জেনেশুনে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলো তা সুশীলার বুঝতে কোনোই সমস্যা হয়নি!

শুনে নাজমুল বললো— এসব কথা এখন না বললে নয়? দু’দিনের পসারে এরা সব একেকটি ‘ইডিয়টিক স্নব’ (idiotic snob) হয়ে উঠছে! সুশীলা বললো–ইডিয়ট বলছো কেন? হিংসে হয়? ওদের সামর্থ্য আছে শুনিয়ে দিলো!

ব্যাস। তাপমাত্রা এতো দ্রুত বাড়তে লাগলো যে পরিস্থিতি সামাল দিতে নাজমুল বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। ঘন্টা খানেক বাইরে কাটিয়ে যখন ফিরলো সুশীলা তখন শুযে পড়েছে। রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে নাজমুলই নীরবতা ভাঙলো।

— ঘুমিয়ে পড়েছো?

— না। কেন?

—- বলছিলাম যে, আমাদের সম্পর্কটা দিন দিন যে পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে তাতে একসাথে এভাবে থাকার চেয়ে আলাদা জীবন বেছে নেয়াই মনে হয় ভালো!

— কী সব বকবক করছো?

— বকবক করছি না। আমার মনে হয় এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত।

— সঠিক সিদ্ধান্ত মনে হ’লে নিবা। তা আমাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে? আমি এ নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলতে চাই না।

সিদ্ধান্তটা নাজমুল ঐ রাতেই নিয়েছিল। মাঝের এই ক’দিন চলে গেছে শুধু তার বাস্তবায়নে!

সংকট! এই সংকট ছাড়া পৃথিবীতে কি কোনো মানুষ আছে? কেউ ভোগে খাদ্য সংকটে, কেউ আশ্রয়ের, কেউ চিকিৎসার, কেউ এই নাজমুলদের মতো প্রাইভেসি সংকটে আবার কেউ বিলিয়ন ডলার থাকার পরেও হয়তো আরেক বিলিয়ন ডলারের সংকটে পড়ে থাকে! আহ্ হারে মানুষ! একবারও ভেবে দেখে না যে আজ তারা সবাই-ই মনুষ্যত্ব বোধের এক গভীর সংকটে ভুগছে! ভুগছে শান্তির সংকটে। যেখানে প্রাপ্তির সীমানা ছেড়ে চাহিদা সবসময়ই চার পা এগিয়ে থাকে সেখানে শান্তি কোথায়!?

রাত তখন শেষ প্রহরে। সুশীলা গভীর ঘুমে। বের হওয়ার পথে লিভিং রূমে ঘুমন্ত মেয়ে শাওতালী ও কিছু টের পায়নি। ব্যালকনির খাঁচায় পোষা পাখিটাকে বাদ দিলে এই তিন প্রাণীরই সংসার নাজমুলদের। আসার দিন সন্ধ্যা রাতেই সে পোষা পাখিটার খাঁচার দরজাটাও একফাঁকে খুলে রেখেছিলো। বছর চারেক আগে মলের মাঝে একটা পাখি শপ দেখে শাওতালী পাখি পুষতে চাইলো বলেই এই ব্যবস্থা। যদিও খাঁচায় বন্দী করে কোনোকিছু পোষারই পক্ষপাতী সে নয়। পাখীটার জন্যে নিশ্চয়ই শাওতালীর এখন ভীষণ মন খারাপ! আচ্ছা কার জন্যে এখন ওর বেশি মনখারাপ? বাবার জন্যে না পাখীটার জন্যে? এমন একটা প্রশ্ন হঠাৎ মনে উঁকি দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল!

সুশীলার সাথে দাম্পত্য সম্পর্কের উষ্ণতায় ভাটার টান শুরু হয় বছর তিনেক আগে থেকেই। টানটান অর্থনৈতিক অবস্থাই যে এর প্রধান কারণ তা ওরা দু’জনেই বুঝতে পারে। এক বেডরুমের যে ফ্লাটটিতে তারা থাকে, ছয় বছর পূর্বে ওটা মর্টগেজ নিয়েছিলো। শাওতালী তখনো বেশ ছোট। লিভিং রুমে তার বিছনাটা তখনো তেমন অসামঞ্জস্য লাগতো না। কিন্তু এখন তার আরও প্রাইভেসি দরকার। এদিক-সেদিক যেকোনো বিষয় এলেই সুশীলা এ বিষয়টিকে টেনে এনে মন খারাপ করে। নাজমুল নিজেও যে বুঝে না তা নয়। কিন্তু আয় আর ব্যায়ের ইঁদুর দৌড়ে সে ক্রমশই পিছিয়ে পড়ে গত তিন বছরেও অবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ব্যর্থতার এই গ্লানিই ধীরে রূপ নিতে থাকে মনোমালিন্যে এবং অবশেষে  ঝগড়াঝাটিতে! বিষয়টা যে শাওতালীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে খুবই ক্ষতিকর সেটা উপলব্ধি করার পরেও কোনোভাবে যেন এটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না!

ঠান্ডা কফি আর স্যান্ডউইচ শেষ করে নাজমুল আবারও রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। এবারও উদ্দেশ্যহীন। সে না থাকলে মা-মেয়ের প্রাইভেসিতে যে খুব কিছু উন্নতি হবে তেমন নয়। ডিভোর্সের কাগজ রেখে আসলেও তাদেরকে য়ে সাধ্যমত অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে যাবে এ বিষয়ে সে দৃঢ় সংকল্প। বিষয়টা উকিল সাহেবও জিজ্ঞেস করেছিলেন। নাজমুলের উত্তর শুনে সে কিছুটা বিস্মিত হয়েই বলেছিলো- ‘কিন্তু আপনার স্ত্রী যদি হেল্প নিতে রাজি না হন’? এ বিষয়টা নাজমুল অবশ্য ভেবে দেখেনি। শুধু বললো- ‘সে তখন দেখা যাবে’। কিন্তু  এখন পরিস্কার বুঝতে পারছে এক্ষেত্রে তাদের খরচের পরিমানটা আরও বেড়ে যাবে নিশ্চিত। তবে সুশীলা যদি অন্য কাউকে জীবনের সাথে…!? নাহ্ এমন ভাবনা কেন জানি সে এখনো ভাবতেই পারছে না! সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে আবার। চিন্তার দৌড়টাকে সে তাই আজকের রাতের মাঝেই সীমাবদ্ধ করে ফেললো। অফিসে ফিরে যাবে নাকি এভাবে মধ্য রাত অবধি ঘোরাঘুরি করে কোনো একটা পার্কে গিয়ে রাতের আকাশের রূপ কেমন বদলায় তা দেখতে দেখতেই এ রাতটা কাটিয়ে দেবে সেই আগের মতো। তৃতীয় যে অপশন তা হ’লো বাসায় ফিরে যাওয়া! দশদিন হয়ে যাচ্ছে ওদেরকে একবার দেখতে যাওয়াটাও কি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? তবে এই যাওয়াটা তো দিনের বেলা হ’লেই ভালো হয়।

পাশাপাশি তিনটা বিল্ডিং। মাঝারি থেকে ছোটো সাইজের কন্ডোমিনিয়াম এগুলো। নাজমুলদের এপার্টমেন্টের বিল্ডিংটা ইংরেজি ‘L’ শেপের (shape) মতো। বাঁক নেয়ার পরে বিল্ডিংয়ের ঐ অংশটায় প্রত্যেক তালায় মাত্র দু’টা এপার্টমেন্ট। সাত তলায় এরই একটা হ’লো নাজমুলদের। অন্যটায় বয়স্ক রিটায়ার্ড এক দম্পতি থাকেন। খুব বেশি বাইরে যাওয়া-আসা নেই তাদের। সুতরাং করিডোরের এই অংশটা খুবই চুপচাপ।

ভোর চারটা বাজার আগেই পার্কের বেঞ্চি ছেড়ে আবারও রাস্তায় চলে এলো নাজমুল। একটুখানি ন্যাপ হয়েছিলো কী হয় নাই। তবে ব্যাকপ্যাক মাথার নিচে রেখে অনেক অনেক বছর পরে সে আবারও দেখলো শুকতারার যাত্রাপথ। ঘোরে কিংবা স্বজ্ঞানে একটা সময়ে সে নিজেকে আবিস্কার করলো তাদের কন্ডোমিনিয়ামের গেটে! সবটা পথই সে হেঁটে এসেছে! পকেট থেকে সেলফোন বের করে দেখলো এখনো ছ’টা বাজতে বেশ বাকী। সুনসান সবটাই। ছুটির সকাল। গোটা কন্ডোমিনিয়ামই বলা যায় এখনো ঘুমোচ্ছে। এপার্টমেন্টের সামনে এসে সে যেন কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলো! তার অন্তরলোকের কেউ যেন বলে উঠলো-

একবার ভেবে দেখ এভাবে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশের অধিকার কি তোমার আছে? সুশীলা সাধারণত ছ’টার মধ্যেই বিছানা ছাড়ে। কিন্তু এই ক’দিনে তার অভ্যাসেও তো কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। এতো সকালে তাদের ঘুম ভেঙে দেয়াও কি ঠিক হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে সে দরজাটার একপাশে পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে পড়লো। ক্লান্ত। ক্লান্ত সে ভীষণ। এ ক্লান্তি দশ দিনের কিংবা দশ বছরের। হয়তো আরও বেশি, একজীবনের কিংবা জন্ম জন্মান্তরের!

নাজমুলের চেয়ে অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত আবেগ সুশীলার। ওর হঠাৎ এমন প্রস্থানে সে ভেতরে একেবারে চুরমার হয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত কাউকেই তা বুঝতে দেয়নি। এর পেছনে হয়তো আরেকটা বড় কারণ তার বিশ্বাস। এ বিশ্বাস তার নাজমুলের প্রতি। এ বিশ্বাস তার কিছুটা উল্টোপাল্টা স্বভাবের এই মানুষটির প্রতি গত প্রায় বিশটা বছর ধরে সত্তার গহীন থেকে প্রথিত যে ভালোবাসা তার শেকড়ের প্রতি!

কোভিডের কারণে আট মাস পূর্বে সুশীলা তার কাজটি হারায়। আহামরি কিছু কাজ নয়। সারভাইভাল ধরনের একটি পার্ট টাইম ছিলো ওটা। আঁৎকা পরিস্থিতি এমন বদলে যাওয়ায় গত কয়েকদিন সে শাওতালীকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েই বেরিয়ো পড়তো কাজের সন্ধানে। তারই ফলশ্রুতিতেই  আজ তার একটা সাক্ষাৎকারের সুযোগ এসেছে। স্থানটা বেশ দূরে বলে সে সকাল সকালই উঠে পড়ে। নিজের এবং শাওতালীর নাস্তা তৈরী করে শুটে কিছু ওয়েস্ট (waste) ফেলবে বলে দরজা খুলতেই দেখে নাজমুল! করিডোরের দেয়ালে ঠেস দেয়া মাথাটা একটুখানি ডানে হেলে পড়েছে। ঘুমে ও। কিন্তু কতোটা গভীর ঠিক বুঝতে পারছে না। চেহারায় পরিস্কার ক্লান্তির ছাপ। কয়েক সেকেন্ড একেবারে নিশ্চুপ হয়ে সে দৃশ্যটা দেখলো। প্রচন্ড একটা ঘূর্ণী বাতাস মুহূর্তের তীব্র মোচড়ে যেন উপরে ফেললো তার ভেতরের পুঞ্জীভূত সব মান-অভিমান, ভাঙা স্বপ্নের রুগ্ন ক্ষোভ! সেখানে এখন এক হুঁ হুঁ ঝড়ের মাঝে শুধুই নাজমুল! যে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় বিশ বছর পূর্বে প্রথম যখন সে তাকে দেখেছিলো বান্ধবী নীলার প্রেমিক রকিব ভাইয়ের সাথে, একাডেমি বটতলায়! উষ্কখুষ্ক চেহারার ভিতর থেকে ফুটে বেরোনো এক আত্মবিশ্বাসী তলোয়ার! মিতভাষী, কিন্তু যে একাই শ্রাগ (shrug) করে উড়িয়ে দিতে পারে এক পৃথিবী ভঙ্গুর সমাজের তথাকথিত কেতাবী ভদ্রতা! অতি সন্তর্পণে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো ওর পাশে। আরও কয়েকটা মুহুর্ত, তারপর আলতো করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে-

এ পর্যন্তই যখন আসতে পেরেছো দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে কী সমস্যা ছিলো? নাকি চাবি হারিয়ে ফেলেছো? একটু নক করলেও তো হ’তো!? স্বপ্ন কিংবা ঘোর, অদ্ভুত একটা দৃশ্যের মাঝে ডুবে ছিলো নাজমুল। বেশ চওড়া একটা খালের উপরে সাঁকোটা পার হ’তে গিয়ে ওটার মাঝামাঝি এসে দেখে হাতে ধরে ব্যালেন্স রাখার সাপোর্টটা আর নেই! তার বোধ শক্তিহীন অবশ ইন্দ্রিয়-ও কখনো চিনতে ভুল করে না এই উষ্ণতা কোন হাতের, কার হাতের, কোন মমতায় গড়া! তারপরেও জেগে উঠে কয়েক সেকেন্ড কেমন এক আগন্তুকের মতো সে তাকিয়ে থাকে সুশীলার চোখের দিকে। আর একটা কথাও না বলে সুশীলা ওর দু’বাহু ধরে টেনে তুলে বিছানায় নিয়ে এসে বলে শুয়ে পড়ো আমি ‘ময়লাগুলো’ ফেলে আসছি।

কম্বলের নিচে শাওতালীর ঘুম তখনো ভাঙেনি।

Top

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shuja
Shuja
1 year ago

একজন মধ্যবয়সী বিবাহিত পুরুষের টানা-পোড়ন নিয়ে একটি মর্মস্পরশী গল্প। সকলেরই ভালো লাগবে।


Copyright © 2023. All Rights Reserved.