মৃত্যুর সাথে বেঁচে থাকা মনের দ্বন্দ্ব
রুমা বসু
ষোলই জুলাই সকাল থেকেই দিয়ার খুব কাশি হচ্ছিল, বিকেল থেকে গলাটা কেমন জানি করতে শুরু করল। সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পর সতের তারিখ সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল গলার ভেতরে যেন কিছু আটকে গেছে। আস্তে আস্তে অস্বস্তিটা বারতেই লাগল। শনিবার নিমন্ত্রণ ছিল, তাই সপ্তাহের রান্নাও করা হয়নি। তাই রবিবার সকাল থেকে শরীর খারাপ নিয়েই দিয়া সপ্তাহের রান্নাটা শেষ করে ফেললো। দুপুর থেকেই কাশির সাথে আলজিবটা মনে হচ্ছিল বের হয়ে যেতে চাইছে, আর বিকেল থেকে মনে হচ্ছিল কেউ যেন দিয়ার গলার ভেতরে আস্তে আস্তে একটা চোঙ্গাকার বেলুন ফোলাচ্ছে। গত জানুয়ারিতে কোভিড হওয়ার পর থেকে গত তিন মাসে দিয়ার সাতবার মুখের বিভিন্ন জায়গা ফুলে উঠেছিল, যেটা ডাক্তারদের ভাষায় এন্জিওএডিমা বলে। সাধারণত এটা জেনেটিক disorder বা কারও কারও একদম ছোটবেলা থেকে হয়, আবার কখনও কখনও ঔষধের প্রতিক্রিয়া থেকেও হতে পারে। দিয়ার প্রথম দুটোর কোনোটাই ছিল না। কোভিড হওয়ার আগে ওর কখনই এমন কিছু হয়নি। তাই ওরা ভাবছে, এটা কোভিড ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়া হতেই পারে।
যাই হোক গত দু মাসে বার বার এটা হওয়ার জন্য ডাক্তার Rupall 10 mg আর Prednisone On demand প্রেসক্রিপ্শন দিয়ে রেখেছিল। কোন রকম মুখ ফোলা বোঝার সাথে সাথেই তিনটা করে Prednisone খেতে বলে দিয়েছিল। তারপর পাঁচদিন ধরে সেই স্টেরয়েড চলতে থাকবে। সেজন্য বিকেল বেলাতেই দিয়া তিনটা তিনটা Prednisone খেয়ে নিয়েছিল।
কিন্তু রাত নটার দিকে দেখল বেলুনটা মনে হয় কেউ খুব বেশি করে ফুলিয়ে ওকে প্রায় শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে। দিয়ার অসুখ বিসুখ খুব খারাপ অবস্থায় না গেলে সাধারণত কাউকে কিছু বলে না। তাই যখন শ্বাস নেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল, তখন ওর বর অগ্নিকে বলল যে—শুনছ আমার মনে হয় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এক্ষুণি হসপিটালে যেতে হবে।
অগ্নি আর এক মুহূর্তও দেরি না করে তক্ষণি বললে –
চলো আর সময় নষ্ট না করে এক্ষুণি বের হয়ে যাই।
অগ্নি গাড়ি বের করে দশ মিনিটের মাথায় দিয়াকে কুইনস ওয়ে কার্লটন হসপিটালে হাজির করল।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দিয়া মনে মনে ভাবছে-
আমরা যেন এক মৃত্যু উপত্যকায় বসবাস করছি,
প্রতিদিন কত যে পাশের মানুষকে হারাতে দেখছি।
হারানো জনের নাম্বার গোনা ছাড়া কিছুই করতে পারছি না,
ছোট্ট এক জীবাণু এতোদিনেও কারও কাছে হার মানছে না।
প্রতিদিন সকালে ভাবি আজকে আবার কার নাম যোগ হবে,
কখনও ভাবি আমিও এ টালির খাতায় সংখ্যা হব কবে?
মৃত্যু স্তূপ দেখে মনে পড়ছে হাজার চুরাশির মায়ের কথা,
নামের বদলে সংখ্যা হয়ে যাওয়াটাই এখন সবচেয়ে বড় ব্যথা।
লাশের চেয়ে সৎকারের জায়গার অভাব পড়ছে ,
করোনা মহামারী প্রতিক্ষণে কত যে জীবন কাড়ছে!
মৃত্যুদূতেরা আমাদের সহ্যের সীমা ভেঙে দিয়েছে,
প্রতিদিন কত প্রিয় প্রাণকে যে কেড়ে নিয়েছে।
হে দয়াময় তুমি এই করোনার ভয়াল থাবাকে হরো,
স্রষ্টা তুমি তোমার সেরা সৃষ্টিকে এই অতিমারি থেকে রক্ষা কর॥
হসপিটালে নেয়ার আগেই দিয়ার প্রায় কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইমারজেন্সিতে যাওয়ার পর দিয়া আর একটা কথাও বলতে পারল না, শুধু অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলো। হসপিটালে যাওয়ার পর ইমার্জেন্সিতে লিটারেলি ওরা তিন মিনিটের বেশি সময় নেয়নি দিয়ার চিকিৎসা শুরু করতে। দিয়ার কথা বলা বন্ধ হওয়ার পর প্রথমেই মায়ের কথা মনে করে ফোনটা অফ করে রাখল। কারণ মা ফোন করলে যদি রিং হয় আর দিয়া ফোনটা রিসিভ না করে, তবে তো মা খুব চিন্তা করবে। তার চেয়ে ফোন বন্ধ পেলে ভাববে হয়তো চার্য নেই বা অন্য কিছু। সেজন্য চিন্তাটা কম করবে। কারণ জানুয়ারিতে কোভিড হওয়ার পর এই লং কোভিডে তো দিয়া কদিন পর পরই নানা ভাবে ভুগে যাচ্ছে।
ওর এই বেয়ারা টাইপের হঠাৎ শুরু হওয়া এন্জিওএডিমার কারণটা সারা বিশ্বের ডাক্তাররা এখনও বের করতে পারেনি। তাই ওই অবস্থায় ডাক্তাররা ওর বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়ে ওকে সব রকমের এন্টি সুয়েলিং ইন্জেকশনর দিয়ে গলার পেশী, জিব আর আলজিবের বেলুনের মতো ফোলাটা যাতে আর না বাড়ে তার জন্য সব রকম চেষ্টা করতে থাকল। দিয়াকে বাঁচানোর জন্য সব ডাক্তাররা একযোগে সব রকম ট্রিটমেন্ট দেয়া শুরু করল।
পাঁচ রকমের ইন্টারভেনাল ওর দু হাতে সূচ ফুটিয়ে একসাথে দিতে থাকলো। যেহেতু রোগের কারণ জানে না, আর রোগীর শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাই আধ ঘণ্টার মধ্যে ইমিওলজিস্ট, নিওরোলজিস্ট, কার্ডিওলজিস্ট, রেসপেটেরলজ্স্ট, এনেস্থেসিস্ট, ই এন টি- আরো কী কী স্পেসালিস্ট এসে হাজির হয়ে গেল। এখানে ইমার্জেন্সির খুব বদনাম আছে, সাধারণ কিছু হ’লে ইমার্জেন্সিতে গেলে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখে। কিন্তু সত্যিকারের ইমার্জেন্সি হলে যে চিকিৎসা পেতে মিনিটও সময় লাগে না, সেটা দিয়া এবার উপলব্ধি করল। ও একসাথে এত স্পেসালিস্ট জীবনেও দেখেনি। অক্সিজেন মাস্ক আর সব ইন্টারভেনাল ইন্জেকশনের পরও যখন দিয়ার পৃথিবীতে অক্সিজেনের অভাব কমছে না, তখন ও মনে মনে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে থাকে। ও বুঝতে পেরে গেছে যে এর আর জীবনে ফিরে আসা হবে না।
বাড়ি থেকে হসপিটালে নেয়ার একঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে ওকে লাইফ সাপোর্টে দিয়ে দিল। ওকে কেন লাইফ সাপোর্টে নিতে হচ্ছে, হসপিটালে নেয়ার পাঁচ মিনিট পর থেকে বিভিন্ন ডাক্তাররা তার কারণ ব্যাখ্যা করতে করতে দিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেল। ওর কাছে পুরো ব্যপারটা এত সুন্দর করে ব্যাখ্যা করলেন যেটা দিয়ার মনে হলো ওর এ শারীরিক অবস্থায় এটাই একমাত্র চিকিৎসা।
ওর শ্বাসনালীতে কোনো রকম পরিবর্তন হচ্ছিল না, দিয়া শ্বাসনালীর জন্য শ্বাসের কষ্টে ভুগছিল না। আগেই বলেছি যে ওর গলার সব পেশীগুলো, জিব আর আলজিব বেলুনের মতো ফুলে ওর শ্বাসনালীকে চেপে ধরছিল। বেলুনটা আর কিছুক্ষণ ফুলতে পারলে, ওকে যমের ঘরে পাঠিয়ে দিত। তাই ডাক্তাররা শ্বাসনালীকে সিকিউর করতে গলার ভেতর এই সিকিউরিটি পাইপ বসিয়ে, মানে ওকে ভেন্টিলেট করে যমের বাড়িতে যাওয়া থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করল। যতক্ষণ ফোলাটা না কমেছে ততক্ষণ ওকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে ICUতে ডাক্তার, নার্সরা প্রতিক্ষণ মনিটর করেছে।
ওই সিকিউরিটি পাইপটা ফোলা বেলুনের জন্য মুখ দিয়ে ঢোকাতে যদি না পারে, তার জন্য তৎক্ষনাত ডাক্তারা তাদের অন্য সব প্ল্যানগুলোও দিয়াকে আগে ভাগেই জানিয়ে দিয়েছিল। প্রথম প্ল্যানটা হলো মুখ দিয়ে এই পাইপ ঢুকাবে। আর বিকল্প ব্যবস্থা হলো যদি মুখ দিয়ে পাইপটা না ঢোকাতে পারে, তবে তো গলার কাছে ফুটো করে নল ঢোকাতে হবে। তাই লাইফ সাপোর্ট ICUতে না করে সরাসরি OTতে নিয়ে গেল। দিয়াকে এসব বলতে বলতে দিয়া ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে গেল। ডাক্তারদের শেষ কথাগুলো ওর কানে গেলও না। মনে হচ্ছিল ওকে দূরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে, তাই কথাগুলোর অনুরণন কমতে কমতে একেবারে নাই হয়ে গেল।
দিয়াকে ওই সময় Medical induced coma তে রেখে দিয়েছিল। পরেরদিন বেলা বারোটায় দিয়াকে পোস্ট অপারেটিভ থেকে আই সি ইউতে নিয়ে এসেছে। দুদিন পর বেলা সাড়ে তিনটায় দিয়ার মনে হলো কে যেন অনেক দূর থেকে ওর নাম ধরে ডাকছে। ঘুমের ইন্জেকশনের ঘোর কাটার পর আধো চোখে ও দেখে ডাক্তার ওর নাম ধরে ডাকছে, আর অগ্নি চিন্তায় মুখ কালো করে ওর পাশে বসে আছে। ঠিকমতো জ্ঞান আসতেই ওর হাতটা অজান্তেই গলায় চলে গেল। আর কী যে এক পরিতৃপ্তিতে ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানালো, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। কারণ ওর গলায় ফুটো করার কোনো চিহ্ন নেই, মানে গলাটা কাটেনি। দিয়া মনে মনে বললো- ইশ্ কী এক শান্তি! তবে গলার ভেতর দিয়ে পাইপ দিয়ে ভেনিটিল্টেড করার জন্য গলায় প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল।
তারপর আরও ২৪ ঘণ্টা মোট ৭২ ঘণ্টা ICUতে কাটিয়ে একেবারে ভেঙে পড়া শরীর নিয়ে দিয়া অগ্নির সাথে বাড়িতে ফিরে এল। হসপিটাল থেকেই ইমিওলজিস্টের কাছে রেফার করে দিয়েছে। এখন আসল ট্রিটমেন্ট শুরু হওয়ার আগে সব রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।
ডাক্তার বললেন, হয়তো কোভিড ভ্যাকসিন নেয়ার পরও কোভিড হওয়াতে, ঐ ভ্যাকসিনের অনুজীবেরা দিয়ার ইমিউন সিস্টেমকে বার বার এ্যাটাক করছে। কোভিড ভ্যাকসিন অন্য সাধারণ ভ্যাকসিনের মত বায়োলজিক্যাল জীবানু ঢুকিয়ে দেয় নি, বরং মানুষের cell কে genetically modified করেছে।হয়তো ওর IgE ৩৮৯৫ হওয়াতে ডাক্তাররা এরকম ধারণা করছে, তবে এটা ১০০% সত্য কিনা সেটা এখনও বলতে পারছে না। একজন স্বাভাবিক মানুষের IgE সর্বোচ্চ ২৮০ থাকে, সেখানে দিয়ারটা তো ডাক্তারদের চিন্তার বাইরে চলে গেছে। দিয়া কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের একজন, যাকে নিয়ে ডাক্তাররা এখন রিসার্চ করছে। শুরু হচ্ছে ইমিউনিটি ট্রিটমেন্ট, কেউ জানে না এগুলো ওর রোগ নিরাময় করবে নাকি নতুন কোনো অসুবিধার উৎপত্তি ঘটাবে। শুরু হবে ওর গিনিপিগের জীবন। এখন দিয়ার উপর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলবে। হয়তো যমের বাড়িতে যাওয়ার আগে এর সমাপ্তি হবে। তবে এটা ঠিক যে কানাডার চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য এবার যম দূয়ারে পা দিয়েও, দিয়ার যমলোকের ভিসা ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছিল। তাই দিয়া আবার ইহলোকে ফিরে এসেছে।
দিয়া যে হসপিটালে ঢুকেই ফোনটা বন্ধ করে রেখেছিল, সেটা মনে হতেই প্রচণ্ড গলা ব্যথা নিয়ে প্রথমেই ফোনটা অন করে ওর ফেসিয়াল রেকগনিশন দিয়ে ফোনটা আনলক করে একটু ম্যাসেজ চেক করে সেই আনলক ফোনটা পাশের টেবিলে রেখে দিলো। আনলক ফোনটা রাখার সাথে সাথেই অগ্নি ফোনটার স্ক্রিনে একটা আঙুল দিয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে বললো আমি একটু কফি খেয়ে আসি। দিয়া হঠাৎ করে একেবারে আপাদ মস্তক নড়ে উঠল। সদ্য দ্বিতীয় জীবন পাওয়া দিয়া ওর লাইফ সাপোর্টে যাওয়ার আঘাতের চেয়েও অগ্নির এরকম হঠাৎ আচরনে অনেক অনেক বেশি আঘাত পেল। তবে কি ওদের বারো বছরের দাম্পত্য জীবনে কোথাও বিশ্বাসের অভাব ছিল? দিয়ার এত বন্ধু বান্ধবের মধ্যেকার কাউকে কি অগ্নি সন্দেহ করত? তাই কি ওর কোনো গোপন কিছু ফোনে লুকিয়ে আছে কিনা সেটা দেখার জন্য অগ্নি তড়িঘড়ি করে ফোনটা নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল? তবে কি দিয়ার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার আনন্দের চেয়েও ওর আনলক ফোনটা পেয়ে যাওয়ার আনন্দটাই অগ্নির কাছে বেশি বড়ো হলো? দ্বিতীয় জীবন পেয়ে দিয়ার হৃদয়ে দ্বিধা দ্বন্দের ঘূর্ণিঝড়ে শুধু এটাই মনে হলো, জীবনের এ কদর্য রূপ দেখার আগেই কেন ওর জীবনের ইতি হলো না! তবে কি পৃথিবীতে বিশ্বাস, ভালোবাসা এগুলোর চেয়েও সন্দেহ, অবিশ্বাসের পাল্লাটাই বেশি ভারী!
চমৎকার একটি গল্প। পাঠককে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে গল্পটির গতি কোন দিকে যাচ্ছে বোঝার জন্য।