বীর
ইকরাম কবির
আদিলের জন্মভূমিতে বীর তৈরি করার এক প্রকল্প আছে। দেশের জন্যে বীর নির্মাণ করে অনেক উপায়ে ব্যবহার করার প্রায় দুই যুগ পার হয়েছে। এই সৃষ্ট বীরেরা মানুষের চাইতেও আরও বেশি মানুষ। প্রায় অতিমানব। তবে এদেরকে মহাপুরুষ বলা যাবে না। মহাপুরুষ এরা চায়ও না; অতিমানব চায়। এই বীরেরা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি অগ্রসর, তাদের বুদ্ধি অনেক বেশি, নৈতিক দৃঢ়তায় শ্রেষ্ঠ ও শারীরিক শক্তি অতুলনীয়।
অনেক চিন্তা-ভাবনা করে এদেরকে বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। যুদ্ধ, অপরাধ দমন, দুর্যোগে সাহায্য করা ও অবিচার রোধ করার জন্যে। এই বীরেরা অনেক বছর ধরে ভালো সেবা দিয়ে যাচ্ছিলো। কেউ কখনও এদের নির্মাতাদের কাছে কোনো প্রশ্ন করেনি।
আদিল সেই বীরদের একজন। সে শক্তিশালী, উদ্যমী, সাহসী ও সহজাত দক্ষতা সম্পন্ন লড়াকু। তাকে প্রস্তুত করাই হয়েছে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে, সবাইকে উৎসাহ দিতে এবং জয়ী হতে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে তার প্রস্তুতকারী ড. কবীর চৌধুরী আদিলের মনে কিছু এলোমেলো চিন্তার আনাগোনা লক্ষ্য করছিলেন। আদিল কি যেনো আরেকটু বেশি চায়। তার মনে প্রশ্ন আছে, সন্দেহ আছে – সে বুঝতে চায়।
একদিন একা পেয়ে আদিল ড. চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেই বসে – ‘ড. চৌধুরীঃ আমরা যুদ্ধ করি কেনো?’
ড. চৌধুরী বেশ অবাক হলেন। ভ্রু কুঁচকালেন। এমন প্রশ্ন তিনি কখনও আর কারও কাছ থেকে শোনেননি। তার বেশ রাগও হলো; নিজের কাজ নিয়ে সন্দেহ জাগলো। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন – ‘আদিল, যুদ্ধ করা আমাদের স্বভাব।’
‘স্যার, কেনো এটা আমাদের স্বভাব? এ কেমন করে আমাদের স্বভাবের ভেতরে এলো?’
‘এটা এমনই, আদিল; নিজের কাজ করো’।
‘আমার প্রশ্নের উত্তর তো দিলেন না, স্যার; একটু বুঝিয়ে বলুন, ডক্টর’।
‘এইই আমার উত্তর; আমরা এমনই; আমিও তোমার মতোই’। ডক্টর তাকে সান্ত করার চেষ্টা করেন।
অনেক বছর ধরে আদিল সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়েছে, যুদ্ধে জিততে সাহায্য করেছে। সে সবার কাছে এখন জয়ের প্রতীক – বীর। জন্মভূমির সবাই তার মতো হতে চায় – সবাই আদিল হবে। কিন্তু নিজেকে নিয়ে প্রশ্নগুলো তার মন থেকে সে দূর করতে পারছে না; সে বেশ চেষ্টা করেছে কিন্তু দূর হচ্ছে না; প্রশ্নগুলো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে, তাকে গিলে ফেলছে; উত্তরগুলো না পেয়ে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে।
আদিলের কমান্ডার জামিল বেশ ক’দিন ধরে তাকে লক্ষ্য করছিলেন। তিনি বললেন – ‘আদিল, তুমি বোধ করি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছো; এতো চিন্তা করলে তোমার কাজে ব্যাঘাত ঘটবে; মন দাও।‘
কমান্ডার নিজেও তুখোড় তারকাখচিত বীর।
‘জ্বী, কমান্ডার; আপনি ঠিক ধরেছেন’।
‘তুমি কি নিয়ে চিন্তিত? হোয়াট ইজ ব্লাডি বদারিং ইউ?’
‘জামিল স্যার; আমি বুঝতে পারছি না আমায় কেনো বীর হতে হবে; বীরের অর্থ কি।‘
‘এই যে তুমি; তুমিই একজন বীর – আমাদের হিরো। এই যে আমি, আমি একজন বীর; বীরত্বই আমাদের অর্থ’।
‘কিন্তু তার অর্থ কী? বীর আসলে করবেটা কী?’
‘অর্থ হচ্ছে তুমি-আমি নেতৃত্ব দেবো, উৎসাহ দেবো – আমরা জিতবো’।
‘কিন্তু কেনো? জিতবো কেনো; কার বিরুদ্ধে জিতবো?’
‘কারণ তোমাকে সেই জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। ডোন্ট ফাকিং থিংক এনি মোর; গো উইন দ্য ফাকিং ওয়ার’।
আদিলের জয়গুলো চল-চল করে ঝাঁপিয়ে-ঝাঁপিয়ে চলে। তার ভালো লাগে, সে আনন্দিত হয়। সে বুঝতে পারে সে একজন বীর। কিন্তু প্রশ্নগুলো তার পিছু ছাড়ে না।
ড. চৌধুরী আদিলকে বলেন – ‘তুমি বদলে গেছো।‘
‘জ্বী, ডক্টর; আমিও বুঝতে পারছি; আমি আসলে ইচ্ছে করে বদলাচ্ছি না; এ আমার মাঝে এমনি এমনিই ঘটছে’।
‘তোমার মনে কী চলাফেরা করছে আমায় বলবে?’
‘আমি সত্য জেনে গেছি, ডক্টর’।
‘কিসের সত্য? আমাদের আবার সত্য আছে নাকি? যা করছি, তাইই সত্য।’
‘আমি জেনেছি আমি সত্য নই, বাস্তব নই; আমি এক শিল্পজাত পণ্য; আমাকে পরীক্ষাগারে তৈরি করা হয়েছে।‘
‘তুমি বাস্তব, আদিল; তুমি বীর; আমার মতোই বাস্তব’।
‘বাস্তবের অর্থ কি, স্যার?’
‘অর্থ হচ্ছে তুমি তোমার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করছো; লক্ষ্যে পৌঁছুচ্ছ’।
‘আমার উদ্দেশ্য কি? লক্ষ্য কি?’
‘নেতৃত্ব দেয়া, উৎসাহ দেয়া – জয় করা’।
‘কিন্তু কেনো?’
‘কারণ তোমাকে সেই জন্যেই তৈরি করা হয়েছে; তোমাকে তাইই করতে হবে!‘
‘এ কথা আমি আগেও শুনেছি, স্যার; এসব শুনতে আর ভালো লাগছে না’।
আদিল যুদ্ধবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে চলে যায়; জয়ের আনন্দ, মানুষের স্তুতিবাক্য তার আর ভালো লাগে না। যে সত্য সে জেনেছে তা আরও ভালো করে বুঝতে চায়, সত্যের বাস্তব একটা পরিস্থিতি চায়, উপলব্ধি চায়।
দেশের উত্তরে শামেরান নামের এক ঋষি বাস করেন। আদিল তাঁর আশ্রমে যায়। ‘তুমি কিসের আশায় আমার কাছে এসেছো?’ শামেরান জানতে চান।
‘বুঝতে এসেছি, দীক্ষাগুরু’।
‘কী বুঝতে চাও?’
‘বীর হওয়া, হতে পারা, হতে চাওয়া – এসবের অর্থ কী?‘
‘তোমার কাছে কি মনে হয়, বাবা?’
‘আমি জানি না, গুরু’।
‘তাহলে তুমি কী খুঁজতে বেরিয়েছো?’
‘অর্থই তো খুঁজছি’।
‘অর্থ তো শুধু একটা ধারণা।‘
‘তাহলে সত্য কী? বাস্তব কী?’
‘তুমিই সত্য’।
‘কিন্তু আমাকে তো নির্মাণ করা হয়েছে! আমাকে বাজারে বিক্রিও করা যায়!’
‘হতে পারে, কিন্তু এই নির্মিতাবস্থা তো তোমাকে কম সত্যে পরিণত করেনি, তোমাকে মিথ্যায় পর্যবসিত করেনি; তুমিই তোমার বাস্তবরূপ’।
‘করেনি! আমি অবাস্তব নই? বলছেন আপনি? আপনিই বলছেন?’
‘হ্যাঁ, তুমি সত্যের চেয়েও আরও জটিল হয়েছো,’ ঋষি তাঁর কথা শেষ করেন।
আদিলের আগ্রহ আরও বাড়ে, ঋষির উত্তরে পরও উত্তর খুঁজতে তার ইচ্ছে হয়। সে প্রান্তরে বেরিয়ে পড়ে; অনেক মানুষের সাথে তার দেখা হয়, অনেক অভিজ্ঞতার গল্প সে শোনে, বোঝার চেষ্টা করে।
কাজরী নামের এক নারীর সাথে তার পরিচয় হয়। একদিন কাজরীর সাথে তার দেহ-মিলনের পর আদিল ভাবে – ‘এই মিলনটাও কী কেউ আগে থেকেই নির্ধারণ করে দিয়েছিল? ড. চৌধুরী? মিলনের পর আলাপ করতে করতে তাকে জিজ্ঞেস করে – ‘তুমি কি কিছু খুঁজছো? কিছু হারিয়েছো বলে মনে হচ্ছে’।
‘হ্যাঁ, আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি’।
‘কী, বলো আমায়’। কাজরী জানতে চায়।
‘নিজেকেই খুঁজছি গো’।
‘নিজেকেই যদি খোঁজো, তা আমার মাঝে তুমি পাবে না; আদিল, তোমাকে তো তুমি অন্যদের মাঝে পাবে না’।
‘তাহলে কোথায় পাবো?’
‘তোমার নিজের মধ্যেই পাবে’।
‘কেমন করে?’
‘নিজেকে স্বীকার করে নাও; নিজের অস্তিত্ব মেনে নাও; তুমি কেমন মানুষ খুঁজে বের করো, তার সাথে বন্ধুত্ব করো’।
‘আমি কে?’
‘তুমি একজন বীর’।
‘তোমরা এতোবার বীর-বীর করছো কেনো? বীরের অর্থ কী’।
‘তার মানে হচ্ছে তোমার নিজের ক্ষমতা আছে বাছাই করে নেয়ার, সিদ্ধান্ত নেয়ার।‘
‘কী সিদ্ধান্ত নেবো?’
‘সত্যিই একজন বীর হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করবে।‘
‘তা কেমন করে?’
‘বলি, শোনো। শুধু সৈন্যদের নেতা হলেই বা যুদ্ধ জয় করলেই বীর হওয়া যায় না; নিজেকে জানতে হয়, বুঝতে হয়, নিজের ভেতরের জটিলতাকে মেনে নিতে হয়, নিজের মানবরূপকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে হয়’।
কাজরীর চেহারার দিকে আদিল অনেক্ষন তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয় এই চেহারা সে যেনো আগে কোথায় দেখেছে। মনে করতে চেষ্টা করে। কাজরী কী প্রতিপক্ষের কেউ? একিলিস যেমন ব্রিইসিসকে ট্রয় থেকে তুলে এনেছিল। কাজরী কী তেমনই একজন?
বলে – ‘তুমি এসব জানলে কেমন করে? আমি জানি না কেনো?’
কাজরী উত্তর দেয় – ‘বাঁচতে-বাঁচতেই জেনেছি; বাঁচার উপায় তো একটাই – নিজেকে জানা’।
‘কিন্তু, আমি তো উৎপাদিত; শিল্পজাত; আমি কেমন করে নিজেকে জানবো? আমাকে যা জানানো হবে আমি তো তাইই জানবো।‘
‘সে কারণেই নিজেকে আরো ভালো করে জানতে পারবে’।
কাজরী আর আদিল সারারাত জেগে থাকে। কাজরী তাকে সব বুঝিয়ে বলে। আদিল বোঝে। সে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যায় তবে তার জানার যাত্রা শেষ হয় না। এবার সে যুদ্ধে নেমেছে নতুন দৃষ্টি নিয়ে, নতুন উদ্দেশ্য নিয়ে।
কমান্ডার জামিল বেশ অবাক হন। তিনি জানতে চাইলেন – ‘আদিল, আমি লক্ষ্য করছি তুমি অন্যরকম হয়ে গেছো।
‘জ্বী, স্যার’।
‘তোমার মধ্যে কি পরিবর্তন এসেছে? আমায় বলবে?’
‘স্যার, আমি নিজে পুরোটাই বদলে গেছি’।
‘ভালো করে বুঝিয়ে বলো তো!’
‘আমি জেনেছি বীর হওয়ার অর্থ কি, বীরত্বের অর্থ কি’।
‘তা কেমন? বলো শুনি!’
‘আমাদেরকে মানুষ হতে হবে, স্যার’।
‘মানুষ তো আমরা সবসময়েই ছিলাম, মানুষই আছি’।
‘স্যার, আমি নির্দেশিত, চালিত ও পরিচালিত ছিলাম’।
‘তুমি তো এখনো তাইই আছো; তেমন কিছু বদলেছে বলে তো মনে হচ্ছে না’।
‘স্যার, আমি এখন নিজেকে দেখতে পারি, বুঝতে পারি’।
‘আগে তুমি কেমন ছিলে আর এখন কেমন হয়েছো, বলো শুনি?’ কমান্ডার জামিলের কণ্ঠে ঈষৎ ভৎসনার আবেশ।
‘আমার বেছে নেয়ার, নির্ণয় করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, স্যার’।
‘কি নির্ণয় করবে?’
‘কেমন করে বীর হবো তাই ঠিক করবো’।
কমান্ডার হো হো করে হাসেন।
আদিল বলে – ‘আপনি যা দেখছেন তা নয়, স্যার; আমার চেহারা দেখে কিছু বোঝা যাবে না, স্যার। আমি এখন নিজেই নিজের গন্তব্য বেছে নিতে পারি, আমি কি চাই তা চাইতে পারি, আমি কি পছন্দ করি তা বলতে পারি’।
কমান্ডার আবারও হো হো করে হেসে ওঠেন।
আদিল কমান্ডারের হাসির তোয়াক্কা করে না। সে যুদ্ধক্ষেত্রর দিকে এগিয়ে যায়। ঘন যুদ্ধ আরও ঘনীভূত হয়। বৃষ্টির মতো যুদ্ধ চলে। অনেক অনেক বীরের প্রয়োজন হয়। আরও সহস্র বীরকে নির্মাণ করা হয়। দশদিক থেকে বীরেরা আসে। সবাই যুদ্ধ করে; নিজেরা মরে, অন্যকে মারে। কিন্তু আদিল কাউকে মারে না, কাউকে খুন করে না। সে যুদ্ধের অভিনয় করে যুদ্ধক্ষেত্রেই নিজের জীবনের অর্থ অন্বেষণ করে।
পাশ থেকে কে যেন একজন এসে আদিলের বুকে তলোয়ার গেঁথে দেয়।
কমান্ডার যুদ্ধ করতে করতে চকিত দৃষ্টিতে আদিলকে পড়ে যেতে দেখেন। তিনি নিজেও যুদ্ধ করছিলেন তাই সঙ্গে সঙ্গেই তার কাছে যেতে পারলেন না। যুদ্ধে তারা জয়ী হলেন কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আদিলের দেহের কাছে গিয়ে কমান্ডার জামিল বুঝলেন তার দেহের প্রাণ উড়ে গেছে। আদিলের জন্যে কমান্ডারের মনে ভালোবাসা জন্মায়। তিনি মনে মনে বলেন – আদিল নির্মিত ছিলো কিন্তু সে সত্য ও বাস্তব ছিলো; সে সৃষ্ট ছিল কিন্তু জীবনমুখী ছিল; সে বীর ছিলো তবে একজন মানব ছিলো; সে একজন সত্যিকার বীর ছিলো; সে বীর হতে চেয়েছিলো।
ইকরাম কবীরের আরেকটি ভবিষ্যৎ ধর্মী কৌতুহল উদ্দীপক ছোট গল্প। পড়তে পড়তে মনে হয় এমনটাতো কোন একদিন সত্যিই হতে পারে।