দুই ঘণ্টার বৌ
ইকরাম কবির
প্রীতুল রেস্তোরাঁর টেবিলে জড়সড় হয়ে বসে আছে। সে বুঝতে পারছে তার স্নায়ুগুলো ভীষণ উত্তেজিত। আঙ্গুল দিয়ে টেবিলে রাখা কাঁটা-চামচগুলো নাড়াচাড়া করছে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে কাজটি সে করেই ফেলেছে; জীবনেও কখনও ভাবেনি এমন কাজ তাকে করতে হবে। সে একজন বৌ ভাড়া করে ফেলেছে। আর কোন উপায় ছিল না। আপিসে একই পদে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছে কোন পদন্নোতি ছাড়াই। তার কোন পদন্নোতি হয়নি তার কারণ সে বিয়ে করেনি। তাদের আপিসের এক আজব নিয়ম আছে। পদে উন্নতি হবে শুধুমাত্র বিবাহিতদের। পরিবার প্রথা অনুপ্রাণিত করার জন্যেই এমনটা করা হয়েছে বলে তারা সবাই জানে। প্রীতুল তার বসকে দেখতে পাচ্ছে খানিকটা দূরে আরেকটা টেবিলে তার স্ত্রীকে নিয়ে বসে আছেন। প্রীতুলের ঘন হৃৎস্পন্দন আরও ঘন হয়।
পেশাজীবী হিসেবে প্রীতুল বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী; অনেক দূর যেতে চায় সে; অনেক উপরে উঠতে চায় – সর্বোচ্চ পদে। তবে অনেকগুলো বছর একই আপিসে কাজ করে কোন পদন্নোতি না হওয়ায় এখন সে ক্লান্ত, বিরক্ত। সে জানে আহামরি কোন কিছু না দেখাতে পারলে সে তার বসদের চোখে পড়বে না। তবে সে সব সময়ই বিশ্বাস করেছে ভালমতো কাজ করে গেলেই তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হবে। এমন নীতিমালার কোন মানে আছে? একটা পদন্নোতিই পারে এখন তার জীবন বদলে দিতে। তাই না পেরে সে আজ বৌ ভাড়া করেছে।
প্রীতুল মেয়েদের সাথে সখ্যতায় পটু নয়; দূরে সরে থাকার প্রবণতা তার মধ্যে আছে। নিজেকে তার বেশ লাজুক মনে হয়। অনেকেই তার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে কিন্তু সে কেন যেন সাড়া দেয়নি। তার এমন কোন মেয়েবন্ধুও নেই যাকে সে বৌ বলে চালিয়ে দিতে পারে। এই শহরে অনেক কিছুই ভাড়ায় পাওয়া যায় কিন্তু বৌ ভাড়া পাওয়া যায় তা তার জানা ছিল না।
খোঁজাখুঁজির পর একটা কোম্পানি পাওয়া গেলো যারা সহধর্মিণী-সেবা দেয়। প্রীতুল অনেক সময় ব্যয় করে অনেকগুলো প্রোফাইল দেখলো। রূপা নামের একজনের প্রতি সে আকর্ষিত হলো। ঘন কালো চুল, বড় বড় জল-টলটল চোখ, তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। একবার মনে হয় এই মেয়েটাকে কোথায় যেন সে দেখেছে। রূপাকেই বৌ বানাতে ইচ্ছে করলো তার।
রূপা এলে সে কেমন করে তার সাথে কথা বলবে, রূপাই বা তার সাথে কেমন আচরণ করবে – এইসব চিন্তা নিয়ে বেশ ত্রস্ত মনে সে রেস্তোরাঁ বসে আছে। ভাড়া করা বৌয়ের কাছে থেকে কি আশা করা উচিৎ তাও ঠিকমত বুঝতে পারছে না প্রীতুল। রূপা যখন হেঁটে এসে তার টাবিলের পাশে দাঁড়ালো, প্রীতুলের মনটা মুগ্ধতায় ভরে গেলো। ছবিতে যা দেখেছে, তার চাইতেও রূপা অনেক বেশি সুন্দর। সে তার প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণে দুর্বল হয়ে গেলো। রূপা নিজেই তার পরিচয় দিলো।
ওরা একসাথে টেবিলে বসে। প্রীতুল প্রথমেই প্রসঙ্গটি তোলে। তাকে বোঝায় কেমন করে তার বসের সাথে অভিনয় করতে হবে। শুধু এই দুই ঘণ্টার জন্যে; বস এই দুই ঘণ্টাই এখানে থাকবেন। প্রীতুল যে বিবাহিত এই বিষয়টি তার বস বুঝলেই হলো। রূপা হেসে রাজী হয়; বলে – ‘এ এমন কী আর কঠিন কাজ; তুমি কী চাও আমি উঠে গিয়ে ওনার সাথে পরিচিত হয়ে আসি?’ প্রীতুল সঙ্গে সঙ্গে না বলে। ‘না, না; উনি এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ই আমাদের কাছে আসবেন; তখনই পরিচয় হবে।‘
দুজনে পছন্দ করে খাবারের মেন্যু ঠিক করে দেয়। তারপর একে অপরের পরিবার নিয়ে গল্প করে। নিজ-নিজ পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে আলাপ করে। প্রীতুল নিজের প্রাণবন্ততা দেখে বেশ অবাক হয়। ভাবে, কী সহজেই না সে রূপার সাথে এতোগুলো বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, তারা দুজন দুজনকে অনেক বছর ধরে চেনে।
কিছুক্ষণ পর প্রীতুলে বস খাওয়া শেষ করে, বিল মিটিয়ে তাদের কাছে আসেন। প্রীতুল তার স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দেয়। বস বলেন – ‘তোমার যে সংসার আছে তা তুমি আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছো কেন?’ সে উত্তর দেয় – ‘বস, আমি একটু চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি’। বস তাদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বেরিয়ে যান।
এক সময় দুই ঘণ্টা শেষ হয়। সময় আসে দুজনে দুদিকে চলে যাবার। প্রীতুল খাবারের মূল্যের শোধ করে রূপার পাওনাটুকু তাকে দিতে চায়। সে দুই ঘন্টা তার সাথে কাটিয়েছে। রূপা নিতে চায় না। প্রীতুল অবাক হয়। বলে – ‘কেন নেবে না?’ রূপা তাকে বসতে বলে। প্রীতুল চেয়ারে বসলে রূপা তার হাত ধরে। প্রীতুল বোঝে যে সে কিছু বলতে চায় এবং রূপার ছোঁয়া তার ভাল লাগে।
‘প্রীতুল, একটা বিষয় তোমাকে জানাতে চাই; সে কারণেই আমার তোমার কাছে আসা; এই পরিকল্পনা আমি গত কয়েকমাস ধরে করেছি।‘ রূপা তার হাতটা ধরেই আছে। প্রীতুল তার দিকে তাকিয়েই আছে। সে এক বিহ্বলতায় ভুগছে। ‘বলো, আমিতো শুনছি’।
‘তুমি আসলে যা ভাবছো আমি তা নই; আমি ভাড়া করা বৌ নই।‘ রূপা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর আবার বলে – ‘আমি এসেছি ভবিষ্যৎ থেকে – ধর ২০৬৬ সাল থেকে। সেখানে এখন তোমার বয়স ৮৫ এবং আমি তোমার কেয়ার-গিভার। তোমাদের এই শহরে যে ঋতুরাজ হোটেলটা আছে না? ঐটা আমার সময়ে ওটা একটা এ্যাসিস্টেড কেয়ার ফ্যাসিলিটি। আমি ওখানেই কাজ করি; আমি একজন নার্স; তোমার দায়িত্ব আমার কাছে।‘
রূপা একথাগুলো বলার সময় প্রীতুলের মুখটা হা হয়ে গেল। ‘অসম্ভব! এ হতেই পারে না; তুমি কল্পকাহিনী বলছো’।
রূপা বললো – ‘হ্যাঁ, প্রীতুল; পাগলামি মনে হতে পারে, কিন্তু ঘটনা সত্যি। এই যে রেস্তোরাঁয় আমরা এখন বসে আছি, এটা আর তখন নেই; এখানে এক’শ তলা এক ভবন তৈরি হয়েছে। তুমি চাইলে আমি এখনি তোমায় দেখাতে পারি।‘
বলেই রূপা তার ডান হাতটা উঁচু করে। সেখান থেকে এক আলোর চ্ছটা বেরিয়ে একটা হলোগ্রামে রূপ নেয়। সিনেমার মত। প্রীতুল দেখে যে এক থুত্থুরে বুড়োকে রূপা গোছল করাচ্ছে; বুড়োর গায়ে কোন কাপড় নেই। লোকটি একটা বিছনায় শুয়ে আছে, রূপা তার গা মুছে দিচ্ছে।
প্রীতুল এবার রেগে যায়। বলে – ‘এটা আমি নই; তুমি মিথ্যে কথা বলছো; আমায় ধোঁকা দিতে চাইছো; আমি উঠি এখন।‘ সে উঠে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায় রেস্তোরাঁ থেকে। বেরুনোর দরজা খুলে এদিক-ওদিকে তাকায়। আবার ভেতরে এসে রূপার সামনে বসে।
রূপা বলে – ‘তোমার সাথে আমার প্রথম যেদিন দেখা হয়, সেদিনই আমার ভেতরে এক অপরূপ অনুভূতি ঝংকার দিয়েছিল। এক অনুভূতি যা আগে কখনও আমার বোধে আসেনি। আমি তোমার সাথী হতে চাই, প্রীতুল। এখানে, এই সময়ে। তোমার জীবন আমি বদলে দিয়ে চাই যেন ঐ ৬৬ সালে গিয়ে তোমার এমন করে ভুগতে না হয়। একটা কেয়ার হোমে ধুঁকতে না হয়’।
প্রীতুল আর কথা বলতে পারে না। সে জানে না কী বলবে। ভবিষ্যতে বসবাসকারী এক নারী তার প্রেমে পড়েছে এবং এখন এসে বলছে সে তাকে ভালবাসে – পুরো বিষয়টিই তার কাছে অতি-হাস্যকর মনে হয়।
‘আমি জানি না আমি বলবো’ – প্রীতুল ফিসফিসয়ে বলে।
রূপা আবারও তার হাত ধরে। বলে – কিছু বলতে হবে না এখন; তুমি চিন্তা করো।‘
প্রীতুল এবার একাবারেই দিশেহারা হয়ে যায়। সে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যায়। সে জানে এই ঘটনার তল তাকে পেতে হবে। যেই কোম্পানি রূপাকে তার কাছে পাঠিয়েছিল তাদের আর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেলো না সে; ফোন বাজছে কিন্তু কেউ ধরছে না; পুরো ইন্টারনেটে তাদের কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। রূপার সাথে যেই লিংকে যোগাযোগ হয়েছিল সেটাও কাজ করছে না। রূপা একাবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মহাসাগরিক এক হতাশা ভর করে তার মনে। একটা বিভ্রান্তিকর আবহ তাকে জাপটে ধরে। তবে তার কাছে মনে হয় রূপা নিশ্চয়ই আবার আসবে – যোগাযোগ করবে।
দিন যায়; সপ্তাহ যায়; অনেকগুলো মাসও পেরিয়ে যায়। প্রীতুলের পদন্নোতি হয়, মায়না বাড়ে। তবে প্রীতুল একটা ঘোরাচ্ছন্ন সময় কাটায়; রূপার চিন্তায় সে আসক্ত হয়। সে অনেক গবেষণা করে – এক সময় থেকে আরেক সময়ে কেমন করে ভ্রমণ করা যায়, কোয়ান্টাম বিদ্যা পড়ে, মহাশূন্য নিয়ে পড়ে। তারপর সে রূপার কথা বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং ভাবে যে তাদের দুজনের মিলন একদিন হবেই।
খুঁজতে খুঁজতে প্রীতুল একদিন এক অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছ থেকে বার্তা পায়। বার্তায় আছে একগোছা স্থানাঙ্ক এবং একটি সময়। সে বুঝে যায় এইই হচ্ছে রূপাকে খুঁজে পাওয়ার উপায়। ঠিক সময়মত জ্যামিতি নির্ণয় করে সে সেই স্থানে যায়। দেখে এক বিশাল মরুপ্রান্তর। সময়টা রাত তাই একবার মনের ভেতর অবিশ্বাস বাসা বাঁধে; মনে হয় কেউ তাকে ফাঁশিয়ে দিয়েছে। সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে তার অদূরেই এক আলোকরশ্মি দেখতে পায়; সেখানে একটা মানুষের অবয়ব দেখা যায়। রূপা! প্রীতুল দৌড়ে গিয়ে তাকে শক্ত করে জাপটে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আলোকরশ্মিটা রাতের আকাশে মিলিয়ে যায়। রূপা এবার তাকে সব খুলে বলে। প্রীতুল আবেগাচ্ছন্ন হয়; রূপার জন্যে এক প্রগাড় ভালবাসায় আপ্লুত হয়। সে রূপার অনন্তকালের সাথী হতে চায়। তবে সে প্রতিবন্ধকতাগুলোও বোঝে। দুজনে ভিন্ন সময়ের মানুষ; ভিন্ন সময়ের মানুষেরা বেশিক্ষণ একসাথে বসবাস করতে পারে না। অন্তত এই গ্রহে নয়; তাদের পান্থশালা হবে এক সময় থেকে আরেক সময়ে। কিছুদিন রূপা প্রীতুলকে নিয়ে তাইই করে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখার অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হয় তাদের। তবে তারা জানে তাদের এই মিলন সীমিত সময়ের। রূপাকে তার নিজের সময়ে ফিরে যেতে হবে। প্রীতুল আবারও একা। তাহলে রূপা যে বলেছিল সে তার জীবনে পরিবর্তন আনবে! ২০৬৬ সালে যেন তার কষ্ট না হয় তেমন করে বাঁচতে শেখাবে! রূপা কি তা ভুলে গেল? কথাগুলো সে রূপাকে বলে।
রূপা বলে – ‘আমি তোমায় ফেলে কোথাও যেতে চাই না; আমি সময় এবং মহাশূন্যের বিধি অমান্য করতে চাই; যাই হোক না কেন; তোমার পাশেই থাকতে চাই।‘ রূপা তাকে নিয়ে মহাবিশ্বে একাবারে কিনারে চলে যায়। সেখানে গিয়ে প্রীতুলের কাছে নিজেকে তরল ও নমনীয় মনে হয়। তবে তরল অবস্থায়ও তারা একে অপরকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে পারছে। তারা দেখলও তাদের আশেপাশে তাদের অতীতের ছবিগুলো ঘোরাঘুরি করছে।
তারপর তারা দুজনেই উবে গেল; হারিয়ে গেল।
কেউ জানে না রূপা ও প্রীতুলের কি হয়েছিল; তারা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। অনেকে বলে তারা এখন দুই সময়ের মাঝে ফাঁকা এক স্থানে বসবাস করছে। আবার কেউ কেউ বলে তারা এখন সময় এবং মহাশূন্যের বাইরে চলে গেছে।
A interesting futuristic story by prolific writer Ekram Kabir. Must read.