ভূতপ্রেত উৎসব
শিশিরকন্যা জয়িতা
নিকষ কালো অন্ধকার। গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে সরু একটা রাস্তা বাড়িটার সামনে দিয়ে পেছন দিকে বাগান বা ব্যাকইয়ার্ডের দিকে চলে গিয়েছে। সেই রাস্তা দিয়ে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল হনহন করে হেঁটে চলেছে। তাদের পড়নে রূপকথার রাজ্যের পোশাক আশাক। সিনড্রেলা, স্নো হোয়াইট, সুপার ম্যান, ডাইনোসর, জলদস্যু, আলিবাবা। তাদের হাতে ছোট ছোট ক্যান্ডি ব্যাগ বিভিন্ন রং এর ক্যান্ডি দিয়ে টইটুম্বুর। কারো কারো ব্যাগ একদম উপচে পড়ছে।
বাড়ীর প্রধান দরোজার সামনে এসে মাকড়সা, লম্বা লম্বা ঝুল, ভাঙ্গাচোরা বাক্স, আর পোকামাকড়ের স্তূপ সরিয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো দরোজার কলিং বেল চাপলো। একটু পরেই দরোজা খুলতেই ছেলেমেয়েগুলো তাদের স্বভাবসুলভ অভ্যাসবশত জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘ট্রিক অর ট্রিট’ – যার মানে, হয় আমাকে দিয়ে খুশি করো অথবা আমাকে জব্দ করো। আস্তে আস্তে দরোজার ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো, অতিকায় লম্বা, জীর্ণশীর্ণ, হাড্ডিগুড্ডি অস্থি সম্বলিত একটি মানব কঙ্কাল যার হাতে একটি বিশাল ক্যান্ডি ভর্তি বস্তা এবং সে হাত বাড়িয়ে সেখান থেকে ক্যান্ডি দিতে প্রস্তুত।
ভয়ে, আতংকে, বাচ্চাগুলো জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। কেউ কেউ ক্যান্ডি ব্যাগ ফেলে দিয়ে প্রাণপণে রাস্তা দিয়ে দৌড় দিলো। আর যেতে যেতে পেছনে শুনতে পেলো, খিক খিক করে কঙ্কালের অট্টহাসি।
ছোটবেলা থেকেই আমার গল্পের বই পড়ার দারুণ অভ্যাস ছিল। ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব, ডাইনি বুড়ি, পিশাচ, ড্রাকুলার গল্প অসংখ্য বার পড়েছি। ১৯৯২ সালে প্রথম আমেরিকায় এসে জেনেছিলাম যে এগুলোকে স্মরণ করার জন্য বিশেষ দিবস পালন করা হয়। শুধু মাত্র স্মরণ করা নয়, রীতিমত ঘটা করে উৎসব পালন করা হয় – ভূতপ্রেত উৎসব বা হ্যালুইন ডে।
আমার দেখা প্রথম হ্যালুইন ডে এর কথা এখনো মনে আছে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এরা এমন করে ভূতের বাড়ি সাজায়, বাড়ি সাজাতে অনেক বুদ্ধি ও অঢেল অর্থ খরচ করে। ছোটো ছেলেমেয়েরা রংবেরং এর কস্টিউম বা পোশাক পড়ে বাড়িতে বাড়িতে যায় ক্যান্ডি বা চকোলেট নিতে। তাদের হাতে থাকে রংবেরং এর ক্যান্ডি ব্যাগ। অনেকটা মাস্তান বাহিনী নিয়ে মহল্লায় চাঁদা তোলার মত ব্যাপার। তার উপর কেউ যদি ভয়ংকর ভূত প্রেতের কোনো পোশাক পরিহিত থাকে তাহলে তো কথাই নাই। তারা এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি যায় আর বলে উঠে, ট্রিক অর ট্রিট। এক বাড়ি থেকে ক্যান্ডি পেলে তার পরেরটাতে হানা দেয়।
হ্যালুইন ডে আমেরিকা ও কানাডার সংস্কৃতিতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে। তবে এর শুরু কিন্তু প্রথম নর্থ আমেরিকার মাটিতে হয়নি। প্রায় দুই হাজার বছর আগে থেকেই ইংলিশ ও আইরিশ জাতিরা এই উৎসব পালন করতো। তারা বিশ্বাস করতো, অক্টোবরের ৩১ তারিখে অন্ধকার রাজ্য থেকে মৃত জগতে বিচরণকারীরা তাদের জীবিত স্বজনদের দেখতে ফেরত আসে। এছাড়াও যত ভুতপ্রেত, ডাইনি, পিশাচ, অশরীরী আত্মা আছে, তাদেরকে যথাযথ মন্ত্র পড়ে কোনো প্রাণী বিসর্জনের মাধ্যমে রক্ত বলি দিয়ে যদি ডাকা হয়, তাহলে তারা আবার জেগে উঠে। মাটির তলা থেকে বেড়িয়ে আসে। সে সময়কার ক্যাথলিক চার্চ সমাজে এটা অনুমোদনও করে।
১৮৪০ এর দশকে আইরিশ ও ইংলিশ ইম্মিগ্র্যান্টরা যখন কলোনি গড়ার উদ্দেশ্যে প্রথম আমেরিকায় আসে তখন থেকে আমেরিকায় এর প্রচলন শুরু হয়। যার প্রথম শুরু নিউ ইংল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে যেখানে কিনা অক্টোবারের শেষ দিনে ভূত তাড়ানোর উদ্দেশ্যে গ্রামবাসীরা বিভিন্ন ধরনের পোশাক পড়ে মিলিত হতো এবং তাদের হারভেস্ট বা নবান্ন উৎসব পালন করতো। আমেরিকায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবার মাস বিভিন্ন ফল-ফসলাদি উৎপাদনের মাস। নবান্ন উৎসবে আগুন জ্বালিয়ে তার চারিদিকে বসে তারা বিভিন্ন ধরনের ভয়ংকর গল্পও পাঠ করতো।
আমেরিকায় হ্যালুইন ডে’তে প্রধানত পাঁচ ধরনের রীতি অনুসরন করা হয়।
১)জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন তৈরি করা। এটা করার জন্য আমেরিকানরা পাম্পকিন বা মিষ্টি কুমড়ার ক্ষেতে দিয়ে সবচেয়ে উপযুক্ত কুমড়াটি বেছে নেয় অথবা দোকানে গিয়ে একটা পছন্দ মত কুমড়া কিনে আনে। এরপর গর্ত করে কুমড়ার ভেতর থেকে সব শাস চেঁচে ফেলে দিয়ে কুমড়ার গায়ে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে চোখ, নাক, মুখ খোদাই করে এবং তার ভেতর একটা মোমবাতি বসিয়ে দেয়। রাতের বেলা এই মোমবাতি যখন জ্বলে তখন আলো আধারির খেলায় সেটি একটি ভয়ংকর দানবের মুখে পরিণত হয়।
২)অন্ধকার জগতের বাসিন্দাদের মুখ বা চেহারা সম্বলিত কোনো পোশাক পড়া। তা হতে পারে কোনো ভুতপ্রেত, মনস্টার, ডাইনি বুড়ি, ড্রাকুলা, রক্তপায়ী পিশাচ, ড্র্যাগন, বাদুড় বা বিড়াল এর মুখওয়ালা কোনো কস্টিউম বা পোশাক। খুব ছোট বাচ্চারা ভয়ঙ্করের পরিবর্তে কোনো রুপকথা গল্পের চরিত্রের পোশাক পড়ে থাকে।
৩)ছোট বাচ্চাদের সবচাইতে প্রিয় কাজ – পাড়ার ভেতর বাড়ি, বাড়ি গিয়ে চকলেট বা ক্যান্ডি সংগ্রহ করা। ঘোরাঘুরি শেষে বাড়ি ফেরে তারা প্রবল আনন্দে চকলেট গুনতে বসে এবং প্রিয় বন্ধুদের সাথে আদান প্রদান করে। তারপর সারা সপ্তাহ ধরে তাদের সংগ্রহ থেকে মনের আনন্দে ক্যান্ডি খায়। ৪)পাড়ার মধ্যে যতগুলো ভূতের বাড়ি সাজানো আছে সেগুলো পরিদর্শনে যাওয়া। ৫)বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে কোনো হরর মুভি বা পিলে চমকানো সিনেমা দেখা।
কানাডার হ্যালুইন কালচারে স্পাইডার বা মাকড়সা একটা বড় ভূমিকা পালন করে। যখনি কোনো বাড়িতে মাকড়সা দিয়ে সাজানো হয় তখন মনে করা হয় ঐ বাড়িতে কোনো মৃত ব্যাক্তির আত্মা তাদেরকে সর্বদা দেখে রাখছে। টরন্টোয় অনুষ্ঠিত হ্যালুইন ডে প্যারেড তাদের সর্ববৃহত, যেখানে অসম্ভব ভয়ংকর কস্টিউম পরিহিত মানুষেরা যোগ দেয় এবং দূর্বল চিত্তের মানুষদের সেখানে আসতে নিষেধ করা হয়। অন্যদিকে, ক্যুবেকের বাসিন্দারা বিভিন্ন ধরনের থিম ট্যুর আয়োজন করে যেগুলো কবরস্থান বা পরিত্যাক্ত প্রাচীন দূর্গ পরিদর্শনে যায়। ভ্যাঙ্কুভারের বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাকইয়ার্ডে বসে ফায়ার ওয়ার্কস বা আতশবাজি দেখা হ্যালুইন ডে’তে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি ব্যাপার।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে টেলিফোন আবিষ্কারের আগে, আমেরিকায় হ্যালুইন কার্ড পাঠানোর প্রচলন ছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চকলেট প্রস্তুতকারক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলো, অ্যাডভার্টাইজিং এর মাধমে হ্যালুইন উৎসবে চকলেট বিতরণের অভিনব পন্থা মানুষের মনে ছড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে সময়ের বিবর্তনে, আমেরিকান সংস্কৃতিতে হ্যালুইন একটি অত্যন্ত জাকজমনপূর্ণ ও ব্যবসাভিত্তিক দিবসে পরিণত হয়।
২০২১ সালে করা এক জরীপ অনুযায়ী, একেকজন আমেরিকান নাগরিক এই হ্যালুইন উৎসবে পোশাক, চকলেট এবং গৃহসজ্জার সামগ্রী বাবদ প্রায় একশো থেকে পাঁচশো বা হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করে থাকে। বিভিন্ন মহল্লা ও এলাকায় সবচেয়ে আকর্ষনীয় বাড়ি সাজানোর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। স্কুলে, অফিসে, কর্মক্ষেত্রে হ্যালুইন পোশাক পরিধানের প্রতিযোগিতা হয়। জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন তৈরিরও প্রতিযোগিতা হয়। ২০২০ সালের অক্টোবারে ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিত সর্বোচ্চ ভারী জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরুষকার পাওয়া কুমড়াটির ওজন ছিল দুই হাজার তিনশ পঞ্চাশ পাউন্ড।
মজার ব্যাপার হল, যেই আইয়ারল্যান্ডে এই উৎসবের উৎপত্তি, সেখানে কিন্তু মিষ্টি কুমড়ার পরিবর্তে টারনিপ বা শালগম ব্যবহার করার প্রচলন ছিল। আর হ্যালুইন এর দিনে আইরিশ জাতিরা কস্টিউম পড়ার পরিবর্তে আকাশে ফায়ারওয়ার্ক্স দেখতো এবং ক্যান্ডির বদলে ফ্রূট কেক খেত। এই ট্র্যাডিশনটি যখন আমেরিকায় শুরু হয় তখন দেখা যায় যে শালগমের পরিবর্তে মিষ্টি কুমড়া অনেক সহজলভ্য এবং এটা খোদাই করা অনেক সহজ। আমেরিকান জাতি বরাবরই কোনো উৎসবকে পুঁজি করে সর্বোচ্চ ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনের কৌশল খুব সহজে বের করে ফেলে।
সবসময়ই দেখেছি হ্যালুইন ডে’তে কমলা ও কালো এই দুটো রং এর আধিক্য। কমলা রং হেমন্ত বা নবান্ন উৎসবকে প্রতিফলিত করে। আবার এই কমলা রং মিষ্টি কুমড়ারও রং। অন্যদিকে কালো রং, জগতের যা কিছু অশুভ এবং অন্ধকার তারই জোরালো প্রতীক। অনেক আমেরিকানের মতে, এই হ্যালুইন উৎসব মানুষের মৃত্যুর পুর্বের এবং পরের দুটো বিপরীত জগতের কথা মনে করিয়ে দেয়। কারন এই একটা উৎসব যেখানে মৃতেরা এসে জীবিতদের সাথে দেখা করে।
তবে গোঁড়া ক্রিশ্চিয়ান ও ইহুদি ধর্মাবলম্বীর মানুষেরা এবং মুসলমান ধর্মের অনুসারীরা এই উৎসব পালনে বিশ্বাসী নয়। তার মূল কারন হল, এই উৎসবের উৎপত্তি হয়েছে এমন এক সময়ে যখন পেগান সম্প্রদায়ের মানুষেরা এক বা একাধিক দেবতায় বিশ্বাস করতো বা তাদের পূজা করতো। শুধুমাত্র একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস বা সুনির্দিষ্ট কোন ধর্মের সুচনা সে সময় পৃথিবীতে হয়নি।
আমেরিকান প্রাইমারি স্কুলগুলোতে হ্যালুইন উপলক্ষে বিশাল কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়। আমার ছেলেরা পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত খুব জোরেসোরে এটা পালন করেছে। এরপর হাইস্কুল ও কলেজ শুরু হতেই হ্যালুইন এর উৎসাহ তাদের মধ্যে থেকে কমে যায়। এখন অক্টোবার মাস এলেই আমার আর দুশ্চিন্তা শুরু হয়না যে কনকনে ঠাণ্ডার ভেতর ছেলেদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি ক্যান্ডি চাইতে যেতে হবে। হ্যালুইন আসার আগেই কিছু ক্যান্ডি কিনে রাখি আর সেদিন সন্ধ্যা হলেই দরোজার সামনে জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন জ্বালিয়ে অপেক্ষা করি।
এই বুঝি ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল এলো। কলিং বেল চাপতেই আমি দরোজা খুলবো আর শুনবো, অসীম সাহস ও গভীর আনন্দ মেশানো তাদের মিষ্টি কণ্ঠস্বর…’ট্রিক অর ট্রিট’।
‘