আহত প্রজাপতির আরেকটি ভোর
ফরিদ তালুকদার
একটি লাইট পোস্ট আমাকে দেখে। একটি নক্ষত্র আমাকে দেখে। একটি নেড়িকুকুর ক্রমশঃ আমার বন্ধু হয়ে যায়।…
বেশ কেটে যায় আমাদের সফলতার দূরবীনের বাইরে এমন একেকটি রাত। এক পৃথিবীর বাসিন্দা নই আমরা সবাই। তবুও কী নিবিড় পারস্পরিক এই নির্ভরতা। আতংকহীন, শঙ্কাহীন এর বিনুনি, ছুঁয়ে থাকে অনুভূতির চারপাশ!
একটা নীল ডানার প্রজাপতি খানিকটা আহত। কোথা থেকে উড়ে এসে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে জানাতে বলল, এক তক্ষকের আক্রমণ থেকে কোনোরকমে বেঁচে এসেছে সে। তার ধারণা মানুষের এমন ভয় নেই তাই তারা খুব সুখী!
বললাম সেখানেও কিন্তু কিছুটা ভুল রয়ে গেছে তোমার। মানুষ এখন মানুষের থাবার ভয়েই সদা তটস্থ! বিস্ফারিত চোখে সে বলে উঠলো, বলো কী? কবে থেকে?
— সে তো বেশ পুরনো ইতিহাস। মানুষেরা যেদিন তোমাদের সবার উপরে কর্তৃত্ব স্থাপন করে ফেললো তারপর থেকেই তারা সেই চর্চাটি তাদের নিজেদের গোত্রের উপরেই চালু করে দিলো!
তোমার ডান ডানার চোটটা তো মারাত্মক! খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই! কিন্তু এর শুশ্রূষার পদ্ধতি যে আমার জানা নেই। একটু পানি দিয়ে পরিস্কার করে দেই ক্ষতটা?
— না না তার আর দরকার হবে না। ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমার ডেরায় আজ আর পৌঁছাতে পারবো না। তোমাদের সাথে রাতটা কাটাতে পারি?
—অবশ্যই। আরে এ আবার জিজ্ঞেস করতে হয়? সকাল হলে দৃশ্য বদলে যাবে। তবে এখন এ জায়গাটুকু হ’লো হৃদয়ের খোলা প্রান্তর। যতোক্ষণ ভালোলাগা, যতোক্ষণ ভালোবাসা, যতো ইচ্ছে থেকে যাও। যখন মনে হবে নির্দিধায় চলে যাবে। তুমি কি একাই গিয়েছিলে ওখানটায়?
— না আমরা বেশ কয়েকজনই ছিলাম। কিন্তু একটু বেশি উৎসাহী হয়ে বুশটার আরেকটু গভীরে দূরের ফুলটার কাছে যেতেই…
নিচে পড়ে ছিলাম। কতক্ষণ ঠিক জানি না। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে কোনোরকমে বেরিয়ে এসে দেখি আশেপাশে কেউ আর নেই!
— মাটির উপরে তো বেশি স্বস্তিতে থাকতে পারবে না। আমি কি ডাল বা কঞ্চি জাতীয় কিছু একটা নিয়ে আসবো?
— না না এ অবস্থায় মাটির ওপরেই আমি ভালো থাকবো। তুমি যা বলছিলে বলে যাও আমি শুনতে চাই।
— ওহ্। না, তেমন আর কিছু বলার নেই। তবে বিষয়টা হ’লো মানুষ তাদের চরিত্র থেকে প্রভূত্ববাদের এ বিষয়টাকে কখনোই বাদ দিতে পারেনি। ভাগ্যিস তারা জন্ম-মৃত্যু এবং সময়টাকে কখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না এবং পারবেও না। এটাই যা সুখবর। তা নাহলে তারা ঈশ্বরের উপরেও তাদের প্রভুত্ববাদী মনোভাব চালিয়ে দিতো! লড়াইটা এখানেই। শান্তিও তাই…
— কিন্তু যেকোনো সমাজে একজন নেতার তো প্রয়োজন। সব প্রাণীদের মাঝেই এটা লক্ষ্য করা যায়।
— তোমার পর্যবেক্ষণ সঠিক। কিন্তু নেতা বা নেতৃত্বের সাথে প্রভূত্ববাদের একটু তফাৎ আছে। এখানে অনেক সময়ই তারা নিজের স্বার্থের জন্যে অন্যের উপরে একতরফা দমননীতি চালিয়ে যায়। মানুষের সমাজে এখন বিষয়টা এমন রূপ নিয়েছে যে ‘তারা নেতা হওয়ার জন্যে প্রভু হয় না বরং প্রভু হওয়ার জন্যে নেতা হতে আসে। তাই এ প্রভুরা কোনো গুনমানের প্রভু নয়। এরা হ’লো স্বৈরাচারী প্রভু! মানে সেবা নয় আত্ম লোভটাই এখানে মূখ্য!
— ওহ্, তাই বলো। এটা খুবই দুঃখজনক। কিন্তু তোমরা সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হয়েও এটা করো কেন?
— এর সঠিক কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। অথবা বলতে পারো এর ব্যাখ্যা অনেক দীর্ঘ এবং অনেক কিছুই এর সাথে এখন জড়িত।
— ছোট্ট এই জীবনে শান্তিটাই তো মূখ্য চাওয়া। এটুকু তো সহজ বুঝ! এ করেতো তোমরা তা পাচ্ছো না?
— তুমি একদম ঠিক বলেছো। কিন্তু তারপরও আমরা সারা পৃথিবী উত্তপ্ত করে রাখি সবসময়। এটাই বর্তমান বাস্তবতা। ভোগের নেশা এখন আমাদের মজ্জাগত!
ব্যাথায় তোমার শরীরটা কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছে প্রজাপতি! আমি দেখতে পাচ্ছি। আমি আর তোমার কথা শুনছি না। আমার কাছে পানি আছে ঐ স্থানটা আমি আস্তে করে পরিস্কার করে দিবো।
— আচ্ছা তাই দাও।
— কেমন অনুভব করছো এখন?
— একটু আরাম বোধ হচ্ছে। কেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব।
— আমরা এখন আর কোনো কথা বলবো না। কথায়ও শক্তি ক্ষয় হয়। তুমি একটু ঝিম মেরে থাকো।
— আচ্ছা।
— প্রজাপতি—
ও প্রজাপতি তুমি কি জেগে আছো? প্রজাপতির কোনো সাড়া নেই। নক্ষত্রের যাত্রায় রাতটা শেষ প্রহরে নেমে এসেছে। আলতো করে স্পর্শ করতে একটু নড়ে উঠে বললো—
— ওহ্, তুমি ডাকছো? দুঃখিত আমি শুনতে পাইনি। আমি যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না!
শোনো—
‘নিস্তেজ হয়ে যেতে যেতে আমি একটি প্রার্থনায় ডুবে যাচ্ছিলাম। আমি আশা করি তোমরা মানুষেরা শান্তির সঠিক পথটি উপলব্ধিতে নিতে পারবে। বুদ্ধিমত্তায় ঈশ্বর তোমাদেরকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে। সবসময় স্বার্থান্বেষী যুদ্ধে লিপ্ত থাকার জন্যে নয়। আমি প্রার্থনায় ছিলাম এটুকু উপলব্ধি করার ক্ষমতা ঈশ্বর যেন আরও একটু বাড়িয়ে দেন তোমাদের। তাতে তোমাদের যেমন মঙ্গল, আমাদের সবারই তেমন মঙ্গল।
আমি আর কথা বলতে পারছি না। আমাকে আর ডেকো না’!
পূব দিগন্তে ঊষা তার আগমনী সংকেত ছড়িয়ে দিতে ব্যাস্ত। পশ্চিমের কোনো এক স্থান থেকে মুয়াজ্জিনের আজান ভেসে আসছে। আমি অদূরে একটুখানি মাটি খুঁড়ে নীল প্রজাপতির দেহটাকে দাফন করে আসলাম মাত্র!
‘বেঁচে থাকলে নক্ষত্রটির সাথে আগামীকাল আবারও দেখা হবে। নেড়ি কুকুরটাও হয়তো গুটিগুটি পায়ে পাশে এসে বসবে। লাইটপোস্টটা তাকিয়ে থাকবে নির্বিকার। এই রাত আর নীল ডানা প্রজাপতির শেষ কথাগুলো মনের মধ্যে অনুরণিত হবে আমৃত্যু। কিন্তু জানি, তার বাস্তবায়ন কোনোদিনই দেখে যাবো না’!!
“এটাই বর্তমান বাস্তবতা। ভোগের নেশা এখন আমাদের মজ্জাগত!” — সশ্রদ্ধ ভালোবাসা ভাইয়া, 🙏