শৈশবের দিনলিপি 

রুমানা সোবহান 

উনিশশো পঁচাশি সালের ঘটনা। আমরা তখন মোহাম্মদপুরের আজম রোডে সালেক খান সাহেবের তিনতলা বাসার একতলায় ভাড়া থাকি। আমরা তিন বোন। দাদা আর আব্বা আম্মা সহ আমাদের মোট ছয় জন সদস্যের পরিবার। বড় দুই বোন মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে পড়ে আর আমি মেরিল্যান্ড কিন্ডার গার্টেন স্কুলে পড়ি। সেখানে ভালই যাচ্ছিল আমাদের জীবন।

এরই মধ্যে একদিন আব্বা অফিস থেকে ফেরার সময়  আলাউদ্দিনের এক কেজির এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে বাসায় আসলেন। ভরাট গলায় আম্মাকে ডেকে বললেন,’মুক্তি ভাড়া বাসায় থাকার কষ্ট দূর হলো এবার। আমার নামে অফিসের কোয়ার্টার এলোট হয়েছে। আল্লাহ বাঁচালে রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত থাকতে পারবো ওখানেই । খুব  সুন্দর এলাকা । মানিক মিয়া এভিনিউতে সংসদ ভবনের উল্টা দিকে  আমাদের অফিসের কোয়ার্টার । তোমার অনেক ভালো লাগবে। আমার সব কলিগদের স্ত্রীদের সাথে তোমার বন্ধুত্ব হবে। আজকে এপ্রিল মাসের পাঁচ তারিখ, আমরা আজকে সন্ধ্যায় গিয়ে বাড়িওয়ালি খালাম্মাকে নোটিশ  দেব। আর বাচ্চাদের স্কুলও ঐ দিকে শিফট করবো ইনশাআল্লাহ ।

 যাই হোক নতুন বাড়ি যাওয়া উপলক্ষে আমরা সবাই বেশ উত্তেজিত হয়ে দিনগুলো পার করেছি । মে মাসে সোবহানবাগ জুট কোয়ার্টারে আমরা শিফট করলাম;খুবই আনন্দিত আমরা। বিশেষ করে আমি বেশি আনন্দে ছিলাম। কারণ এই বাসা শিফট উপলক্ষে আমার পড়ার দিকে কারোও তেমন নজর ছিল না। 

এই নতুন বাসায় সবাই এডজাস্ট করে নিলেও আম্মার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। প্রতিদিন আমাদের নিয়ে সোবহান বাগ থেকে মোহাম্মদপুররে স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা করতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে আমাদের  প্রতিবেশী এক চাচী আমাদের বাসায় এসে সব শুনে আম্মাকে অনেক বকলেন। বললেন,’ পরাগের মা শোন, পড়ালেখা হচ্ছে নিজের কাছে। ভালো স্কুল বলে কোনো কথা নাই। এখানে দুইটা স্কুল আছে বেতন কম আবার পড়ালেখাও ভালো হয়। একটা গার্লস স্কুল আরেকটা মডেল স্কুল। দুটো স্কুলেই আমার পরিচিত লোক আছে।  আমি ভর্তি করায় দিতে পারবো। এই চাচী  ভীষণ বুদ্ধিমতি এবং জনদরদী।  উনি আমাদের স্কুলে ভর্তির কাজে ঝাপিয়ে পরলেন।

সপ্তাহ খানেকের মধ‍্যে  আমরা তিন বোনই মডেল স্কুলে ভর্তি  হয়ে গেলাম। আমি তখন ক্লাস ফোর এ পড়ি।  আমি ভীষণ খুশী, এই স্কুলটা আমার কিন্ডার গার্টেন স্কুলের চাইতে অনেক বড়। এখানে ক্লাসে পড়ানোর পরিবেশটা আমার খুবই ভালো লেগেছে।  টিচার রা হাতে একটা বেত নিয়ে রাউন্ড দেন আর পড়া না পারলে বা ক্লাসে বেশি কথা বললে শপাং শপাং করে ঐ বেত দিয়ে হাতের তালুতে বারি মারেন। আর স্টুডেন্ট রাও বেতের বারি হাতে বা  পিঠে পরার আগেই বাবাগো মাগো বলে আর্তচিৎকার দিয়ে একটা তুলকালাম বাধিয়ে ফেলে। প্রতিটা ক্লাসেই এ রকম দাঙ্গা হাঙ্গামা চলতেই থাকে। তবে  এতো মার পিটের পরও স্বস্তি ছিল যে তারা ডায়েরিতে কমপ্লেন লিখে গার্ডিয়ান কে দিয়ে সই করিয়ে আনতে বলতেন না। ছাত্র শিক্ষকের মধ‍্যেই ঝামেলা শেষ হয়ে যেতো । স্কুলের প্রতিটা দিনই ছিল আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর।

কিন্তু কিছুদিন না যেতেই আমার বড় বোনেরা তীব্র প্রতিবাদ জানালো যে তারা আর এই স্কুলে যাবেনা। আব্বা মুখ অন্ধকার করে সবাইকে ডাকলেন। সমস্যা কি তোমাদের? বড় বোন তার প্রবলেম বলা শুরু করলো,’ এই স্কুলে কোনো ডিসিপ্লিন নাই। টিচাররা স্কেল দিয়ে বারি দেয়। পরীক্ষার হলে সবাই নকল করে। বোর্ডে নকল লিখে আনে। টেবিলের ওপর নকল লিখে রাখে। আমি এখানে পড়বোনা বলেই বড় বোন কান্নায় ভেঙ্গে পরল। আব্বা ঠান্ডা মাথায় বললেন তুমি তো কখনই মার খাওনি। তাহলে তোমার সমস্যা কোথায়? যারা নকল করে তারা বেশি দূর যেতে পারেনা। তুমি নিজের মতো পড়ালেখা কর, অন্যদের লাভ লোকসান নিয়ে তোমার ভাবতে হবেনা।

এরপর মেঝো বোন তার সমস্যার কথা বলল,’ ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই খালি পায়ে ক্লাসে আসে। আর টিচার রা তুই তোকরি করে এ্যড্রেস করে, আমি এখানে পড়বোই না’। সে তার সিদ্ধান্তে অনড়। আব্বা কষে ধমকালো মেঝো বোনকে।  তারপর আব্বা তাকে নিজের স্ট্রাগলের লম্বা কাহিনী বললেন। এই কাহিনী আব্বা যে কোনো আলোচনার মাঝেই সূযোগ বুঝে বলা শুরু করেন; যেমন পরিবারের কোন সদস‍্যর বিয়ে কথা পাকাপাকি অনুষ্ঠানে কিমবা কারও গলব্লাডারে স্টোন অপারেশন করার জন্য কোন হাসপাতাল ভালো হবে সেই আলোচনা র  মাঝেও আব্বা খাল বিল নদীনালা সাতড়ে স্কুলে যাওয়ার গল্প ইন করবেন । যাই হোক সেই সময় আব্বার এই কঠিন স্ট্রাগলের কাহিনী এতো বার শুনেছি যে আমিও চোখ বন্ধ করে এর বিন্দু বিসর্গ পরিবর্তন না করে বলতে পারতাম।

 এবার আসল আমার পালা। আমি বললাম; আমি এখানে বেশ কমফরটেবল ফিল করছি। সবাই বেশ ফ্রেন্ডলি। আব্বা খুশী হয়ে আম্মাকে বলল আমার এই মেয়েটা খুব লক্ষী, সে সব জায়গায় এ্যডজাস্ট করে চলতে পারবে, তাকে নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই।

 আমি আরোও উৎসাহ নিয়ে স্কুলের প্রশংসা করতে আরম্ভ করলাম। বললাম আমাদের স্কুলের ভেতর দিয়ে প্রিন্সিপাল স‍্যারের বাসায় যাওয়া যায়। এই তো সেদিন আমি আর আমার বান্ধবীরা মিলে টিফিন পিরিয়ডে স্যারের বাসায় গরুর বাচ্চা হওয়া দেখতে গেলাম। আব্বা জানো গরু যখন লেজটা উপর দিকে তোলে, কথাটা আর শেষ করতে পারিনি আব্বা চিৎকার দিয়ে উঠে  থাক থাক থাক বলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন আর বলতে হবে না। এরপর আম্মাকে ডেকে বললেন, ” মুক্তি কালকে থেকে  এদের কারো স্কুল যেতে হবে না। আমি অন্য স্কুলে ভর্তির ব্যাবস্থা করবো ইমিডিয়েটলি। আপাতত এরা বাসায় পড়ালেখা করুক।

সেবার হঠাৎ স্কুল বন্ধ হওয়াতে আমি আরও বেশি কমফরটেবল ফিল করেছিলাম।

Top

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments


Copyright © 2023. All Rights Reserved.