আমার বন্ধু লাভলীর কাছে বাবা মানে…
রুমা বসু
আমার এলিমেন্টরী স্কুলের মিষ্টি বন্ধু লাভলী। প্রিপারেটরী স্কুলের সেই বেবী ক্লাসের মুখটা এখনও আমার মনে আছে। লাভলী আমাদের সাথে মাত্র তিন বছর পড়েছে। তারপর হঠাৎ লাভলী লাপাত্তা হয়ে গেল। ওর আর কোনো খবর আমি কখনও পাইনি।
লাভলীর একটা মন তোলপার করা ইতিহাস আছে। ওর বাবা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে লক্ষ্মীনারায়ণ জুট মিলের ইন্জিনিয়ার ছিলেন, আর ওর মা মানে মাসিমনি ১৯৭০ এ তোলারাম কলেজে বি. এস. সি. পড়তে শুরু করেন। আমি লাভলীদের বাড়িতে মাসিমনি আর মেসোর ছবি দেখেছি। সেই পাঁচ ছ বছর বয়সে দেখা ওই ছবিগুলোতে যেন ওনাদেরকে আমার চোখে রূপকথার রাজকন্যা রাজপুত্রর বিয়ের মতো মনে হয়েছে। মাসিমনি ছিপছিপে ফরসা মতো ছিলেন, সব সময় মুখে একটা বিসন্নতার ছাপ লেগে থাকত। আমি তিন চার বছরে মাসিমনিকে কখনও হাসতে দেখিনি। জীবন যেন তার কাছ থেকে সব আনন্দ আহলাদ শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে মুছে ফেলে দিয়েছে। অথচ তাদের বাড়ির এ্যলবামে মেসোর সাথে মাসিমনির কী সুন্দর হাসি খুশী ছবিগুলো জ্জ্বলজল করছিল। আর সেই সব ছবির অত সুন্দর হাসি আমি মাসিমনির মুখে কখনও দেখিনি।
৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় মাসিমনির মেসোর সাথে বিয়ে হয়। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা তখন একদম ভালো না। মাসিমনির ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পরই ওঁদের বিয়ে হয়ে যায়। মেসোর বাড়ি যশোহরে, আর চাকরীর কারণে উনি তখন নারায়ণগন্জে থাকতেন। আর মাসিমনি নারায়ণগন্জের টানবাজারের চক্রবর্তী বাড়ির একমাত্র মেয়ে। সংস্কৃতের প্রভাসক বাবার কোলে পিঠে করেই মাসিমনি বড়ো হয়েছেন। ওর জন্মের সময়ই মা পরলোকগত হন। তাই বিয়ের সময় মাসিমনির বাবাকে ছেড়ে যেতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তবুও একই শহরে আছে বলে একটু নিশ্চিন্তে বরের বাড়ি রওনা হলেন। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মাসিমনির প্রচন্ড শরীর খারাপ হলো। বাবা এবং স্বামী দুজন পুরুষ মানুষই তখন প্রচন্ড চিন্তায় পড়ে গেলেন। এদিকে নির্বাচন চলে এসেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। তাই নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী ঢাকাতে বড়ো ডাক্তার দেখাতে না নিয়ে নারায়ণগন্জে পাড়ার ডাক্তারকেই দেখাতে গেলেন। ডাক্তারের কথা শুনে তো দুজন পুরুষ খুশি হবেন, না কি চিন্তা করবেন সেটাই ভেবে পেলেন না। মাসিমনি ছাড়া অন্য নারীর উপস্থিতি নেই বলে সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেসো একবার ভাবলেন ওঁনার মাকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু বাইরের যা পরিস্থিতি, তাতে এটাও সাহস পাচ্ছেন না।
আসলে ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের ফলে ততকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটলে, তার স্থলাভিষিক্ত হলেন আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। এবং পূর্ব পাকিস্তানে(বাংলাদেশ) আন্দোলনের ফলে ২৬ মার্চ ১৯৬৯ সালে তিনি ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হোন।
পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের (১৯৬৯-১৯৭১) সামরিক শাসনামলে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ইতিহাসে ১৯৭০-এর নির্বাচন নামে পরিচিত।এদিকে পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচনের দশ দিন পর ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের অক্টোবরে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বন্যার কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১৯৭১-এর জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির ৩০০টি আসনের ২৮৮টি জিতে নেয়।
একাত্তরের জানুয়ারিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো মাসিমনি আর মেসো এসে মাসিমনির বাবার টানবাজারের বাড়িতে থাকবেন, আর মাসিমনিদের বাবার বাড়িতে যে ভদ্রমহিলা রান্নাবান্না দেখাশোনা করতেন, তিনি তখন মাসিমনির দেখভাল করবেন। আর অন্য একজন কাজের লোক রাখা হবে বাড়ির কাজ করার জন্য। এরকম উত্তাল রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে এর চেয়ে ভালো আর কোনো কিছু হতে পরে না বলে মেসো তো নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেনই, মাসিমনিও আবার বাবার কাছে এসে অসম্ভব আনন্দে সময় কাটাতে লাগলেন। মাসিমনির বাবাকে ছেড়ে থাকার যে কষ্টটা এই দেড় বছর ধরে মাসিমনিকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছিল, সেটা একেবারে উড়ে যেয়ে যেন মথ থেকে রঙিন প্রজাপতি বেড়িয়ে এল। সন্তান আসার খবরে মাসিমনির জীবনে যেন সব দিক থেকে সুখ এসে ভাসিয়ে দিলো। এই অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা যেন মাসির জন্য শাপে বর হয়ে এল। দিনগুলো প্রচন্ড আনন্দের মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছে। মাসিমনির আর মেসোর প্রলম্বিত মধুচন্দ্রিমা চলছে। মেসো যখন লক্ষ্মী নারায়ন কটন মিলের বাংলোতে থাকতেন, তখন বাড়ির পেছন দিয়ে শীতলক্ষা বয়ে যেত, আর মাসিমনির সেই সৌন্দর্য দেখতে দেখতে নিজেকে অমরাবতীর বসে থাকা বন্দি রাজকন্যার মতো লাগতো। বাড়িটির অবস্থানের অপার সৌন্দর্যের পরও মাসিমনিকে একাকীত্বে ঘিরে রেখে দিত। আর টানবাজারের এই পুরোনো বাড়ির লোনা ধরা উঁচু দেয়ালের মধ্যেও কী এক স্বর্গীয় সুখ মাসিমনির মুখটাকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে রাখে। একদিকে মাসিমনির সবচেয়ে কাছের মানুষ বাবার লাগামহীন আদর আর নতুন প্রিয় মানুষের অপার ভালোবাসায় মাসিমনির জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনগুলো পার করছিল।
এদিকে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীণ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে ঢ়াকার রেসকোর্স ময়দানে বিকাল৩.২০ মিনিটে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে ১৮ মিনিটব্যাপী যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, তা ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। বাংলাদেশ সৃষ্টির সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে জাতির পিতার অসামান্য অবদান। তাঁর অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভাস্বর ওই ভাষণে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাঙক্ষাকে একসূত্রে গেঁথে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন‘ “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”, যা ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক। স্বাধীকার আন্দোলন থেকে ৭ মার্চের ভাষনে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিনত করে দেয়।
অন্যদিকে আওয়ামিলীগের নির্বাচনের বিপুল জয় পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগেষ্ঠী একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা নানা রকম ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। ফেব্রুয়ারিতেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আর সেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাড়ি- লারকানা হাউজে। তখন পাখি শিকারের কথা বলে বৈঠক ডেকে তিনি লারকানাতেই ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিলেন পাকিস্তানি জেনারেলদের নিয়ে। ইতিহাসবিদ আর গবেষকরা বলছেন- লারকানার সেই ষড়যন্ত্রের এখনও অনেক কিছু অজানা। তবে এটা নিশ্চিত যে বাংলাদেশে গণহত্যার পরিকল্পনা প্রথম জুলফিকার আলী ভুট্টোর মাথা থেকেই আসে।
আর এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ শে মার্চ এর গণহত্যার পরই বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। চারিদিকে তখন তরুণ সমাজ দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে শুরু করে। এদিকে মেসোর পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে শুরু করে। মেসো তখন দেশ রক্ষার টানে মানসিকভাবে পাগলের মতো হয়ে গেছেন, কিন্তু অন্যদিকে মাসিমনি অন্তঃস্বত্ত্বা আর নারায়ণগন্জের পরিস্থিতিও খারাপ হোতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় মেসো দেশকে নাকি ওঁনার গর্ভবতী স্ত্রীকে- কাকে প্রাধান্য দিবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। তখন ওঁনার একজন সহকর্মী বললেন ওনারা পরিবার সহ গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন, মেসো যেন ওনাদের সাথে মাসিমনি ও দাদুকে নিয়ে একসাথে বেরিয়ে পড়েন। সেদিন রাতেই ওনারা শীতলক্ষা নদীতে একটা গয়না নৌকো করে দুটো পরিবার মুন্সিগন্জ হয়ে ওই ভদ্রলোকের গ্রামের বাড়িতে পারি জমালেন। তখনও গ্রামের দিকে নিশ্চিন্ত জীবন যাপনই চলছিল। ওনাদের সহকর্মীর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে মেসোর দোটানায় যেন সমাপ্তি ঘটলো। উঁনি বুঝে গেলেন ওঁনার স্ত্রী, অনাগত সন্তান এবং ওঁনার শ্বশুরমশায় এখন নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন, তই এবার ওঁনার মূল দায়িত্ব হলো দেশমাতৃকাকে রক্ষা করা। ওই গ্রামে যাওয়ার সাতদিন পর, মাসিমনি সকালে ঘুম ভেঙে মেসোকে পাশে না দেখতে পেয়ে ভেবেছেন বুঝি বাইরে কোথাও হাটতে গেছেন। বেলা দশটা বেজে গেল, তখনও মেসোর কোনো পাত্তা না পেয়ে বাড়ির সবাই চিন্তিত হয়ে গিয়েছিল।
হঠাৎ মাসিমনির চোখে পড়ে বিছানার পাশে রাখা জলচৌকির উপরের জল খাওয়ার কাঁসার গ্লাসের নীচে কী যেন একটা কাগজ ভাঁজ করে রাখা আছে। তখন গ্লাসটা সরিয়ে দেখেন মেসোর দুটো চিঠি সেখানে রাখা আছে। একটা চিঠি মাসিমনিকে উদ্দেশ্য করে লেখা অন্যটা মাসিমনির বাবাকে। মাসিমনিকে লেখা চিঠিতে মাসিমনির কাছে অনুমতি না নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। আর লিখেছেন এ পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার মহাযজ্ঞে আজ যদি মেসো যোগ না দেন, তবে তাঁদের অনাগত সন্তান পৃথিবীর আলো দেখলে, মেসোকে কখনই সম্মান করতে পারবে না। এই সন্তান যেন স্বাধীন দেশ দেখতে পারে তার জন্যই আজকের দিনে মাসিমনিকে এ অবস্থায় রেখেও মেসো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিলেন। মাসিমনি চিঠিটা পেয়ে যেন পাথরের নতো স্থবির হয়ে গেলেন। স্বামী তাকে এ অবস্থায় ফেলে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কেউ কখনও মাসিমনির চোখে এক ফোঁটাও অশ্রু দেখেনি। তবে সেদিনের পর থেকে মাসিমনির মুখে কেউ কখনও হাসি দেখেনি।
মাসিমনির বাবাকে লেখা চিঠিতে মেসো লিখেছেন যে এ বয়সে মেসোর উচিত ছিল, দাদুর দায়িত্ব নেয়ার। তার বদলে দাদুকেই মাসিমনি আর তাদের অনাগত সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে মেসো দেশমাতৃকার সেবা করতে চলে যেতে বাধ্য হলেন। মেসো দেশ স্বাধীন করে তবেই বাড়ি ফিরবেন। আর যদি মুক্তিযুদ্ধে মেসো শহিদ হন, তবে তাঁর অনাগত সন্তান যেন স্বাধীন দেশে গর্ব করে বলতে পারে যে ওর বাবা ওকে স্বাধীনতা দেয়ার জন্য আর দেশমাতার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন।
দশই এপ্রিল মেসো মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলেন। জুনের শুরুতে গ্রামও আর নিরাপদ রইলো না, তাই ওনারা সবাই কুমিল্লা হয়ে আগরতলায় পালিয়ে গেলেন। মাসিমনির এরকম টানা হেঁচড়ার মধ্যে ডেটের থেকে প্রায় একমাস আগে ১৭ই জুন মাসি এক প্রিম্যাচিওর পুতুলের মতো মেয়েকে আগরতলার সরকারি হাসপাতালে প্রসব করেন। আমার বন্ধু লাভলী অন্য একটা দেশে পৃথিবীর আলো দেখল। এদিকে মাসিমনিদের সাথে মেসোর আর কোনো যোগাযোগ হলো না। নানা লোকের কাছে শুনেছেন যে মেসো আগরতলায় ট্রেনিং নিয়ে মুন্সিগন্জের দিকে যুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু মাসিমনিদের সরাসরি মেসোর সাথে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। নভেম্বরের ২০ তারিখে খবর এল যে মেসো বোধয় আর স্বাধীন বাংলাদেশ দেখার সুযোগ পেলেন না। নিজের সন্তানকে স্বাধীন দেশ উপহার দেয়ার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে মানে ২০ শে নভেম্বর, ১৯৭১ সালের রোজার ঈদের দিনে মুন্সিগন্জে রাজাকার বাহিনীর মরণকামড়ে মুন্সিগন্জে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান। মেসো ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ এ মাসিমনি, তার স্বামীর মেয়েকে দেয়া একমাত্র উপহার স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। টানবাজারে বাপের বাড়ি ফিরে এসে দেখেন যে সেখানে একটুকরো সুতোও নেই। রাজাকার আলবদররা ঘরের সব লুটপাট করে নিয়ে গেছে। রান্নাঘরে মাটির উনুনটা শুধু নিতে পারেনি, তাছাড়া সারা বাড়িতে আর কিছু রেখে যায়নি। এমন কি কয়েকটা ঘরে সেগুন কাঠের দরজা ছিল, সেগুলোও খুলে নিয়ে গেছে।
মেসোর লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের কোয়ার্টারে মাসিমনিদের কিছু জিনিষ তখনও পড়ে ছিল। তারমধ্যে মাসিমনির কাছে সবচেয়ে মূল্যবান ছবির কিছু এলবাম ছিল। মাসিমনি সেগুলোকে যত্ন করে নিয়ে এসে আবার বাবার বাড়িতে জীবনের আর এক অধ্যায় শুরু করলেন। সেই সময় থেকেই হয়তো আর কেউ মাসিমনির হাসি মুখটা দেখতে পায়নি। তারপর মাসিমনি আবার পড়ালেখাতে ঢুকে গেলেন। তারপর ঢাকা ইউনিভারসিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করে একটা কলেজে পড়ানো শুরু করলেন। এদিকে লাভলী একটু একটু করে ওর দাদুর কাছে বড়ো হতে লাগলো। ১৯৭৪ এ লাভলীকে ওর দাদু প্রিপারেটরি স্কুলে বেবী ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আর তখন থেকেই লাভলীর সাথে আমার পরিচয়। মাসিমনি সকালে লাভলীকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ওনার কলেজে চলে যান, আবার ফেরার সময় নিয়ে যান।
সাদা শাড়ি পরা মাসিমনি কিন্তু স্বাধীন দেশে ফিরে এসে একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে পারেননি। মাসিমনির সাদা শাড়ির স্নিগ্ধ রূপই জীবনের কাল হয়ে গেল। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে ফিরে আসার পর থেকেই যারা তাদের বাড়িঘর লুটপাট করেছিল, তাদেরই কিছু লোক মাসিমনিকে নিয়মিত উত্তক্ত করতে থাকে। তবে যেহেতু এদের রাজাকার আলবদর পরিচয় আছে, তারা সরাসরি মাসিমনির ক্ষতি করতে পারেনি।
কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পর যখন পট পরিবর্তন হয়, তখন এসব লোকরা আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং মাসিমনিকে এবং দাদুকে নানাভাবে ভয় দেখাতে থাকে। ছিয়াত্তরের নভেম্বরে হঠাৎ লাভলী স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলো। এক সপ্তাহ ক্লাসে না আসার পর আমি ভেবেছিলাম লাভলী হয়তো অসুস্থ, তাই ওর বাড়িতে বেশ কয়েক বার ফোন করলাম কিন্তু কেউ ফোনটা ধরলো না। তারপর লাভলীর এক প্রতিবেশিকে ক্লাসে লাভলীর খোঁজ নিতে বললাম। ও যা বললো তখন সে কথার মানে না বুঝলেও আজ তা বুঝতে পারি। অনাগত সন্তানকে স্বাধীন দেশ উপহার দেয়ার জন্য যে মেসো মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হলেন, তাঁর স্ত্রী – সন্তানের স্বাধীন দেশে জায়গা হলো না। দাদু, মাসিমনি আর লাভলীকে নিয়ে রাতারাতি স্বাধীন দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। আর লাভলীর কাছে বাবা মানে মাকে লিখে যাওয়া একটা চিঠি, আর মা-বাবার একসাথে কিছু ছবি।
চমৎকার একটি লেখা। পড়ে ভালো লেগেছে।