সমস্যা

সুজয় দত্ত

নাঃ, থালায় ভাত ফেলে উঠে যাওয়ার জো নেই। একজনের শ্যেনদৃষ্টি আমার পাতের ওপর। পেটে জায়গা থাক আর না থাক, বাকি ডালমাখা ভাত আর তরকারিগুলো শেষ করে তবে নিষ্কৃতি। নাহলেই বকুনি। ওদিকে খাবার ঘরের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি পাশের ফ্ল্যাট থেকে চিড়ে আর দই ডাকছে হাত নেড়ে। এখুনি ফ্ল্যাটবাড়ির সামনের একচিলতে মাঠটায় দুপুরের বলখেলা শুরু হবে আমাদের, চলবে যতক্ষণ না বিকেলে বড়রা ইস্কুল থেকে ফিরে মাঠের দখল নেয় ততক্ষণ। চিড়ে আর দই হল আমার দুই প্রাণের বন্ধু, মুখার্জিবাড়ীর সেজো আর ছোট ছেলে। আসল নাম চিরন্তন আর দ্বৈপায়ন, আমরা পাড়ার ছেলেরা ঐ বলে ডাকি। কী মজা ওদের ! চার ভাই দুই বোনের গাদাগাদি দু-কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট, এগারোটায় ইস্কুল ছুটি হলেই সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো, কে কখন খেলো না-খেলো কারুর কোনো নজর নেই, শাসন বারণের কোনো বালাই নেই। চেহারাও সেরকম — ডিগডিগে রোগা সবকটা। কিন্তু দম আছে চার ভাইয়েরই, দৌড়ে পারা যায়না ওদের সঙ্গে। পায়ে বল পড়লে কারুর ক্ষমতা নেই আটকানোর — সোজা গোল। আর আমি? দিনের পর দিন পেট ঠেসে ভাত গিলে গিলে নাদুসনুদুস চেহারা হচ্ছে, বন্ধুরা আড়ালে মোটা বলে, মাঠে গোলকীপার হয়ে স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকতেই রীতিমতো হাঁসফাঁস অবস্থা। এই সব কিছুর জন্য দায়ী ওই একজনই।  শুরুতে যার কথা বলছিলাম।

সেই একই ব্যক্তি আবার ছুটিছাটার দিনে, এমনকি গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতেও কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি ধরে দুবেলা পড়তে না বসলে অথবা হোমওয়ার্ক আদ্ধেক ফেলে রেখে রেডিওতে খেলার রিলে শুনতে বসলে এমন চীৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেবে যে আশপাশের প্রতিটা ফ্ল্যাটের প্রত্যেকে জেনে যাবে কী আমার অপরাধ। শুধু কি তাই? কয়েকবার হাতপাখার ডাঁটি আর রুটি বেলার বেলনের বাড়িও পড়েছে আমার পিঠে, স্রেফ রান্নাঘর থেকে আমার জোরে জোরে মুখস্থ করার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল না বলে। আশ্চর্য তো! ইস্কুলে পড়াটা দিয়েছে কাকে — তোমাকে না আমাকে? এমন চেঁচিয়ে পড়তে হবে আমায় যাতে তোমারও মুখস্থ হয়ে যায়? আবার নিজে দুধ উথলে পড়ার বা তরকারি পুড়ে যাওয়ার ভয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরোতে পারেনা বলে বাবাকে পাহারাদার রেখে দেয় যাতে আমি সুযোগ পেয়ে ফাঁকি না দিতে পারি। বাবা এমনিতে ঠান্ডা মেজাজের মানুষ, বিশেষ বকেঝকে না।  কিন্তু রান্নাঘর থেকে যদি ক্রমাগত কেউ বলে যায়, “তোমার প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে ছেলেটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে”, তাহলে কার না পৌরুষে ঘা লাগে? ব্যস, ছেলেকে একটু রগড়ানি দিয়ে অভিভাবকসুলভ দায়িত্ববোধের প্রমাণ রান্নাঘরে পেশ করে তবে শান্তি। আর এর ফলে পাড়ার বন্ধুবান্ধবের কাছে আমার প্রেস্টিজ যে কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে, সেকথা আর কে ভাবে? এইতো সেদিন, বাথরুমের দরজার পাল্লায় হাতটা একটু চিপ্টে গিয়ে কালশিরে পড়েছে, বিকেলে মাঠে দেখা হতেই লাল্টু দাঁত বার করে হেসে বলল, “কিরে, মাসীর কাছে খেয়েছিস তো আবার? কি করেছিলি?”। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে প্রতি বছর ডিসেম্বরে অ্যানুয়ালের রেজাল্ট বেরোবার দিনে যখন ফার্স্ট-সেকেন্ড প্রাইজ নিয়ে ফিরি, তখন দরজায় একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে ঠায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকা মানুষটাকে বলি, “দেবোনা এগুলো তোমাকে, যাও! মোটেই তোমার বকুনি আর পিটুনির জন্য হয়নি এসব”। কিন্তু আবার ওগুলো হাতে নিয়ে এমন ছলছল চোখে পরম যত্নে বুকে আঁকড়ে ধরে, মায়াও হয়।

ইস্কুলের গন্ডী পেরিয়ে বারো ক্লাস পাশ করে কলেজে যাব — সেখানেও নিস্তার আছে? পুরো আঠেরোটা বছর আমাকে বাড়ীর নাড়ুগোপাল করে চোখে চোখে রেখে দেওয়ার পর এখন বায়না — কলেজ হস্টেলে থাকতে দেবে না। সেখানে গেলে নাকি আমার শরীরের বারোটা বাজবে আর পড়াশোনার চোদ্দটা। মহা মুশকিল তো! তোমার কোলের খোকন হয়ে থাকার জন্য আমি এরকম একটা নামকরা কলেজে স্কলারশিপ পেয়েও ছেড়ে দেব? যাইহোক, শেষে অনেক জেদাজেদি করে তাকে চোখের জলে নাকের জলে ভাসিয়ে ভর্তি হলাম সেই আবাসিক কলেজেই। বাড়ী থেকে ট্রেন বদলে বদলে যেতে লাগে ঘন্টা দেড়েক, বাসে গেলে আরোই বেশী। কাজেই হস্টেলে না থেকে উপায় কি? ওমা, একদিন বিকেলে কলেজ করে হস্টেলে ফিরে দেখি আমার ঘরের দরজাটা ভেজানো, তালা ঝুলছে কিন্তু খোলা অবস্থায়। দেখেই বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল — আমি কি আজ তালা দিয়ে যেতে ভুলে গেছি? ভেতরে বইখাতা আর সাধারণ জামাকাপড় ছাড়া বিশেষ কিছু না থাকলেও একটা নতুন ক্যালকুলেটর আছে, আর আছে আমার এ-মাসের স্কলারশিপের টাকা। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা ঠেলে দেখি ও হরি — আমার বিছানায় বসে পাখার তলায় হাওয়া খাচ্ছেন সেই তিনি। কী ব্যাপার? না, বাড়ীতে কাল অনেকদিন বাদে লোকজন এসেছিল বলে চিংড়ির মালাইকারি আর নলেনগুড়ের পায়েস রাঁধা হয়েছে, আমার তো খুব প্রিয় জিনিস, তাই কৌটো করে আমাকে একটু দিয়ে যেতে মন চাইল। হস্টেলে তো দুবেলা ছাইপাঁশ খাওয়ায়, আজ যেন ওসব না খেয়ে এগুলোই খাই। বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চাইলাম, ঘরে ঢুকলে কিভাবে? উত্তর পেলাম আমার রুমমেট দুপুরে লাঞ্চব্রেকে হস্টেলে খেতে এসেছিল, সে-ই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুলে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন, “তুই দুপুরে খেতে এলিনা যে?” আমি আর কী করব, যাহোক একটা মিথ্যে অজুহাত দিলাম। আসলে লাঞ্চের পরের পিরিয়ডেই একটা শক্ত পরীক্ষা ছিল, আমি ওই একঘন্টার ব্রেকে শেষমুহূর্তের পড়াটা একটু ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম। ব্যস, সেই যে একদিন দুপুরে না খাওয়ার “অপরাধ” ধরা পড়ে গেল, তার পরের চার বছর আমার হাজার বারণ সত্ত্বেও বাড়ী থেকে মাঝেমাঝেই চলে এসেছে শিমবেগুন-পোস্ত থেকে শুরু করে পমফ্রেট মাছের ঝাল, আমের আচার থেকে শুরু করে পিঠেপুলি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করেই খেতাম সেগুলো, কিন্তু মনে মনে কী লজ্জা যে লাগত। হস্টেলে আমার নামই হয়ে গেছিল ‘রাজভোগ দত্ত’।

গ্র্যাজুয়েশন করার পর পোস্টগ্র্যাজুয়েট পড়ার সময় সেই সুযোগ আর রাখিনি অবশ্য। চলে গেলাম দিল্লীর এক নামী ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে আবার অন্য গল্প। দেখতে শুনতে আমি ফিল্মি হীরোর মতো না হলেও চার বছর হোস্টেলজীবন যাপনের পর খুব একটা খারাপও না। আর পড়াশোনায় ফাঁকি না দিয়েও মোটামুটি মিশুকে। তাই অচিরেই বসন্তের বাতাসে ফুল ফুটতে শুরু করল মধুকুঞ্জে। আর আমি এইসব ‘খেলার’ কথা গোপন রাখতে চাইলেও লোকে দেবে না রাখতে কিছুতেই। চারপাশে সব ‘উপকারী’ বন্ধুরা ঘুরঘুর করছে, তাদের অ্যান্টেনা চব্বিশ ঘন্টা খাড়া। রসালো খবর সংগ্রহ আর সম্প্রচার — দুটোতেই সমান আসক্তি। তাদেরই কারুর মাধ্যমে কথাটা চালান হয়ে গেল আমার কলকাতার বাড়ীতে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনাঘাত। ওপ্রান্তে রীতিমতো হাউমাউ করে আর্জি — আমি যেন এক্ষুণি দিল্লী ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসে যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সীতে ভর্তির অ্যাপ্লিকেশন করি। একটা বাইশ-তেইশ বছরের ছেলের চেয়ে একটা বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে কত বেশী সেয়ানা আর পরিণতমস্তিষ্ক হয় সেই জ্ঞানগম্যি তো আমার নেই। তাই বুঝতেও পারছিনা কী মারাত্মক রাস্তায় পা বাড়িয়েছি ! আমার সরলতা আর অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অচিরেই আমার সর্বনাশ করে ছাড়বে ওই — । বলে যে বিশেষণটা দিয়ে তিনি শেষ করলেন সেটা বিশেষ প্রীতিকর নয় বলে এখানে আর লিখছি না। আমি তো হতভম্ব, বাকরুদ্ধ, ফোনের রিসিভার কানে নিয়ে চুপ করে আছি। ওপ্রান্ত থেকে “কী হল কী, কিছু বলছিস না কেন?” বলে প্রবল ধমক ভেসে আসতেই আমতা আমতা করে বললাম যা শোনা যাচ্ছে ওসব গুজব ছাড়া আর কিচ্ছু না। আমি দিল্লী এসেছি মন দিয়ে এম এস সি-টা শেষ করে এম ফিলে ভর্তি হতে। ওটাই আমার পাখীর চোখ, আর কোনো দিকে চোখ বা আড়চোখ — কোনোটাই নেই। এই মিনমিনে গলার স্তোকবাক্য শুনে কি আর তিনি আশ্বস্ত বা নিরস্ত হন? সেই সেমিস্টার চলাকালীনই সোজা দিল্লী এসে হাজির বাবাকে জোর করে অফিস ছুটি নিইয়ে। সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে হবে না? বন্ধুমহলে যারা আমার দুরবস্থার খবর রাখে তাদের রাতের আড্ডা আর সপ্তাহান্তের গুলতানির আমি হয়ে উঠলাম মুখরোচক স্ন্যাক। স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের একটা ছেলের ‘গার্জেন’ কলকাতা থেকে ছুটে এসেছে তাকে তার প্রেমিকার হাত থেকে আড়াল করার জন্য — ইউনিভার্সিটির অবাঙালী ছাত্রছাত্রীদের কাছে এর চেয়ে মনোরঞ্জক বিনোদন আর কী হতে পারে?

সেই শেষ নয়, এরপর কয়েক বছর ধরে প্রতি সেমিস্টারে চললো আমার ওপর নজরদারি, হাজার মাইল ট্রেন ঠেঙিয়ে দিল্লী এসে এসে। কিন্তু ততদিনে আমার সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার সম্পর্কটা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে অভিভাবকের সতর্কবাণী বা চোখরাঙানিতে আর পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ব্যাঙ্গালোরে বেড়ে ওঠা সেই স্মার্ট, অনাড়ম্বর মেয়েটি আমার জীবনে জড়িয়ে গেছে গভীরভাবে, আমরা যুগল পথচলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। কলকাতায় আমার বাড়ীর লোকজন তো আর ঘাসে মুখ ডুবিয়ে থাকে না, তারা আঁচ পাচ্ছিল সবই, কিন্তু যখন দেখল আমি খুব ভালভাবে স্নাতকোত্তর পাশ করে এম ফিলে বেশ নামকরা এক গবেষকের কাছে কাজ শুরু করেছি, অন্ততঃ প্রেমের হাঁড়িকাঠে ক্যারিয়ার বলি যাওয়ার ভয়টা কাটল। এম ফিলের দ্বিতীয় বছরে গরমের ছুটিতে আমরা পুরো ব্যাপারটাকে প্রকাশ্যে এনে ফেললাম। ও আমাকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে গেল ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে, আর আমি ওকে কলকাতায়। ভাগ্য ভাল আমার, ব্যাঙ্গালোরের উচ্চবিত্ত পরিবারের সচ্ছলতা আর আধুনিকতায় মানুষ হয়েও প্রিয়াঙ্কা কলকাতার আধা-রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত মানসিকতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জাদু জানত। সে জাদু এমন জাদু যে তিন বছরের সব সন্দেহ আর আশংকা ধুয়ে যেতে তিন সপ্তাহও লাগল না। ছুটি শেষে যখন আবার আমাদের দিল্লী ফিরে যাওয়ার সময় এল, তখন কে কার বাবা-মা আর কে কার আঙ্কেল-আন্টি — বোঝা মুশকিল।

এবং এর পরেই ঘুরে গেল খেলাটা। কলকাতার সেই তিনি এখন আমার ওপর পাহারাদারির এক নতুন রাস্তা পেয়ে গেছেন। ফোনগুলো এখন আর আমার কাছে নয়, বেশীরভাগই প্রিয়াঙ্কার কাছে আসে। আমি যে কয়েকটা পাই, তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ দাম্পত্য জীবন নিয়ে নানা প্রশ্ন, নানা উপদেশ। যেমন, প্রেমকে বেশীদিন অরক্ষিত রাখতে নেই, তাড়াতাড়ি বিবাহবন্ধনে বেঁধে ফেলতে হয়। একটা পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করলে তাদের বাচ্চাকাচ্চার শৈশব বিঘ্নিত হয়। এম ফিল শেষ হলে আমি যেন আবার নতুন কোনো পড়াশোনার লাইন বেছে না নিয়ে চাকরির চেষ্টা করি, কারণ সংসারের পুরুষমানুষকেই আগে স্বাবলম্বী হতে হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি চুপ করে শুনতাম, তর্ক বা প্রতিবাদ করার চেষ্টা বৃথা। আমি আর প্রিয়াঙ্কা তো মনে মনে ঠিক করেই রেখেছি কী করব না করব। এম ফিলের ফাইনাল ইয়ারে তখন দুজনেরই চাকরি খোঁজা চলছে পুরোদমে। যতক্ষণ না দুজনেই কর্মজীবনে সেটল্ড হচ্ছি, বিয়ের প্রশ্নই নেই। ব্যাঙ্গালোরের পূর্ণ সমর্থন আছে এই পরিকল্পনায়, কিন্তু কলকাতা ধৈর্য্য ধরতে নারাজ।

জীবন আর কবে সরলরেখায় চলে? আশা আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক থেকে যায় হামেশাই। আমরাও ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম তেমন হল না। আমি গোটা দুই লোভনীয় অফার পেলাম মুম্বই আর চেন্নাই থেকে, প্রিয়ঙ্কার দেরী হল একটু। শেষে হায়দ্রাবাদের একটা কনসাল্টিং ফার্মে পছন্দসই পজিশন পেতেই ও চটপট “হ্যাঁ” বলে দিল। আমি ততদিনে দিল্লীকে বিদায় জানিয়ে দক্ষিণ মুম্বইয়ের বাসিন্দা হয়ে গেছি। ঘনসোলি-তে একটা খুপরি ফ্ল্যাটে একার সংসার পেতে বসেছি। মনটা হু হু করছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর যে ছিল সব সময়ের সঙ্গী, আজ সে শুধুই ফোনের ওপারে। বলাই বাহুল্য, এতে আমার চেয়ে অনেক বেশী কষ্ট পাচ্ছিল কলকাতায় আরেকজন। প্রথমতঃ, তাকে অনেক বলেও বোঝাতে পারিনি যে আমরা দুজনেই যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম কলকাতায় চাকরি পেতে। যুৎসই কিছু না পাওয়াতেই অন্য শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত — তাকে ইচ্ছে করে দূরে ঠেলে রাখার জন্য নয়। দ্বিতীয়তঃ, যারা দুদিন বাদে বিয়ে করতে চলেছে তারা কি আর শখ করে পরস্পরের থেকে সাড়ে চারশো মাইল দূরে থাকে? নেহাত বাধ্য হয়েছি তাই। এবং এটাই চূড়ান্ত নয়, সুযোগ পেলেই দুজনে একসঙ্গে একজায়গায় সেটল করব। অতএব এত উতলা হবার কিছু নেই। তাছাড়া প্রিয়াঙ্কা খুবই করিৎকর্মা আর স্বনির্ভর, আমাকে ছাড়া সে হিমশিম খাচ্ছে এমন তো নয়। আর ঘনসলি যা জমজমাট জায়গা, আমাকেও রোজ কষ্ট করে হাত পুড়িয়ে আলুসেদ্ধ-ভাত খেতে হচ্ছে না মোটেই — ফ্ল্যাটের নীচে নামলেই একগাদা দোকানপাট। কিন্তু যতই বলি, কে শোনে কার কথা! ফোনের ওপ্রান্তে দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ ঘনীভূত হতে থাকে ক্রমশঃ।

এভাবে বছর দুয়েক কাটার পর হঠাৎই ঘটনার দ্রুত পটপরিবর্তনের ফলে জীবনের চেনা ছকটা কেমন যেন বদলে গেল। শুরু হয়েছিল ভাল খবর দিয়েই। হায়দ্রাবাদের চাকরিটা করতে করতে গোপনে খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যাচ্ছিল প্রিয়াঙ্কা মুম্বাই-এর আশপাশে। আচমকা একদিন অফার পেয়ে গেল মালাড-এর এক জাঁদরেল কোম্পানী থেকে। দারুণ সুখবর, কারণ আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে তিরিশ কিলোমিটারও নয় ওই জায়গাটা, যাতায়াতের ভাল ব্যবস্থা রয়েছে। এই কথাটা জানিয়ে কলকাতায় সবাইকে চমকে দেব বলে ফোন করেছি, উল্টে নিজেই একটা ধাক্কা খেলাম। শুনলাম সদ্য ষাটে পা দেওয়া বাবার একটু আগেই এক বিরাট হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, এখুনি অ্যাম্বুলেন্স এসে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, প্রতিবেশীরা আমাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করে পায়নি, নাহলে আধঘন্টা আগেই খবর পেতাম। ব্যস, মাথায় উঠল মালাড, সেই রাতেই ট্রেনের টিকিট কেটে রওনা হলাম আমি, পরদিন সকালে হায়দ্রাবাদ থেকে প্রিয়াঙ্কা।

ভাগ্যিস পেরেছিলাম যেতে। কারণ সেই দেখাই শেষ দেখা, আর বাড়ী ফেরেনি বাবা। দিন তিনেক যমে মানুষে টানাটানি চলেছিল হাসপাতালের আই সি ইউতে। আঘাতটা সামলাতে বেশ কিছুটা সময় লাগলেও জীবনের বাস্তবতার প্রয়োজনে মন শক্ত করলাম আমি। কিন্তু আমার সেই তিনি? দীর্ঘ তিন দশকের জীবনসঙ্গীকে এভাবে হারিয়ে বাঁচার সব ইচ্ছেই যেন খুইয়ে বসে আছেন। ভুল বললাম, বসে নয়, শুয়ে। শ্রাদ্ধশান্তি আর নিয়মভঙ্গের সময় তিনি রীতিমতো শয্যাশায়ী, বাড়ীতে দুবেলা ডাক্তার আসছে। এতদিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম সকলে, এবার সবকিছু মিটে-টিটে যাওয়ার পর ঠান্ডা মাথায় ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে বসলাম আমরা তিনজন — প্রিয়াঙ্কা, আমি আর তিনি। প্রিয়া আর আমি একমত — এই অবস্থায় তাঁকে এখানে ছেড়ে মুম্বাই ফিরে যাওয়া অসম্ভব, নিয়ে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে। পৈতৃক ভিটে আপাততঃ থাক তালাবন্ধ, পরে ভাবা যাবে কেয়ারটেকার ইত্যাদির কথা। তবে আমরা বললে তো হবে না, বাড়ীর মালকিনকেও রাজী হতে হবে। সে গুড়ে এক বালতি বালি ছিটিয়ে তিনি বললেন, না, বিয়ে হয়ে এসে অবধি যেখানে থেকেছেন, যেটা ছাড়া আর কোনো আশ্রয়ের কথা কোনোদিন কল্পনাতেও আনেননি, পরতে পরতে স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়ী থেকে তাঁকে উৎখাত করে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি কিরকম জেদী মানুষ, তাই পীড়াপীড়িতে লাভ হবেনা জানতাম। তড়িঘড়ি একজন চব্বিশ ঘন্টার কেয়ারটেকার ঠিক করে একরাশ দুশ্চিন্তা মনে নিয়ে ফিরে গেলাম আমরা যে যার কাজের জায়গায়।

এর পরের বছরখানেক আমি আর প্রিয়া মুম্বাই থেকে একটু ঘনঘনই কলকাতা গেলাম। তিনি পথ চেয়ে বসে থাকতেন আমাদের। কাছে পেলে  আর ছাড়তে চাইতেন না — বিশেষতঃ বৌমাকে। প্রিয়ার সঙ্গে সবসময়ই দারুণ জমে ওঁর, এখন একা হয়ে যাওয়ার পর তো আরোই বেশী। বার বার আক্ষেপ — কেন বিয়ের অনুষ্ঠানটা আমরা বাবা থাকতে সেরে নিলাম না, এখন কালাশৌচের জন্য কতদিন পিছিয়ে গেল। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ তো সেই কত আগেই হয়ে গেছে। আমরা বলতাম হবে হবে, আর তো কটা মাস, তারপরেই ঘোষণা করব অনুষ্ঠানটা। কিন্তু হঠাৎ একদিন বুঝতে পারলাম আর এভাবে চালানো যাবে না বেশীদিন — প্রিয়াঙ্কা পেরে উঠবে না। কারণ ওর শরীর সংকেত দিয়েছে আমাদের সংসারে এক তৃতীয় ব্যক্তিকে অভ্যর্থনা করার প্রস্তুতি শুরু করতে। ইতিমধ্যে আমরা সেই ঘনসলির খুপরি ফ্ল্যাট ছেড়ে একটা আরো বড়সড়, সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে উঠে গেছি। সেখানে ব্যাঙ্গালোর থেকে আমার শ্বশুর-শাশুড়িও এসে ঘুরে গেছেন। আর প্রিয়ার শাশুড়ি? ঠাকুমা হতে যাওয়ার খবর শুনে আহ্লাদে আটখানা, আমাদের নতুন ফ্ল্যাটের ছবি দেখে দারুন খুশী, কিন্তু তাঁকে কলকাতার বাড়ী থেকে নড়ায় কার সাধ্যি? “আমার ঠাকুরঘরে রোজ ফল-বাতাসা দেবে কে? ধুপ আর প্রদীপ জ্বালবে কে? গোপালকে চান করিয়ে ভোগ দেবে কে? তুলসীগাছে জল দেবে কে?” ইত্যাদি লম্বা লিস্ট। এর একটার জন্যও কেয়ারটেকারের ওপর নির্ভর করা যায় না। শেষে প্রিয়ার অনেক পীড়াপীড়ি, অনেক ছলছল চোখে আবদার-টাব্দারের পর নিমরাজি হল ওর ডিউ ডেটের কাছাকাছি সময়ে এ-বাড়ীকে অল্প কিছুদিনের জন্য মেজোমাসী আর মাসতুতো দিদির জিম্মায় রেখে মুম্বাই যাবার। এই সমস্যাটা যাহোক একরকম মিটল, কিন্তু নতুন এক সমস্যার চারাগাছ গজিয়ে উঠছিল আমাদের সকলের অলক্ষ্যে। তা হল তাঁর স্বাস্থ্য। ষাট ছুঁইছুঁই শরীরটা যে আর আগের মতো কর্মঠ নেই সেটা অনেকদিন থেকেই দেখছি, কিন্তু বাবা চলে যাবার পর একটু দ্রুতই যেন ভাঙছিল শরীর। খিদে কমে গেছে অনেক, রাতে ভাল ঘুম হয়না, সারাদিন কেমন যেন ক্লান্ত-ক্লান্ত লাগে — এগুলোকে স্বাভাবিক বয়সজনিত লক্ষণ ধরে নিয়ে এতদিন পাড়ার চেনাশোনা ডাক্তারের সাধারণ ওষুধপত্রই চলছিল। এবার কলকাতা এসে যখন দেখলাম দুই পায়ের নীচের অংশ, গোড়ালি আর পাতা বেশ  ফুলে রয়েছে, জোর করে নিয়ে গেলাম একজন স্পেশালিস্টের কাছে। জোর করে, কারণ সেখানেও তীব্র অনীহা, একগুঁয়ে জেদ — “কী হয়েছে কী আমার? এই বয়সে কত মানুষ বাতের ব্যথায় চলতে পারে না, গাঁটের ব্যথায় দাঁড়াতে পারে না, হাঁপানির রোগে কাত হয়ে পড়ে থাকে, ওসব কোনোকিছু দেখছিস আমার মধ্যে?”

সত্যিকে তো আর জেদ দিয়ে ঢেকে রাখা যায়না। স্পেশালিস্টের নির্দেশমতো হওয়া পরীক্ষানিরীক্ষায় বেরিয়ে পড়ল সমস্যার উৎস। কিডনী। দুটোর অবস্থাই তেমন ভাল নয়। বড়োজোর পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ শতাংশ কর্মক্ষমতা তাদের। কীভাবে, কবে থেকে শুরু হল এই নিঃশব্দ অবক্ষয়, বলা মুশকিল। তবে আমার মামাবাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যেহেতু কিডনীজনিত সমস্যার ইতিহাস আছে, বংশগতিও একটা কারণ হতে পারে। মুশকিল হচ্ছে, এরকম একজন রোগীকে বিপদ এড়াতে যে কড়া সতর্কতার মধ্যে থাকতে হয়, সেটা এই ভদ্রমহিলাকে বোঝানো ভীষণ শক্ত। চিরকাল বাড়ীর অন্য দুই সদস্যের সুস্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেকে উপেক্ষা করে আসার যে অভ্যাস শিকড় গেড়ে আছে মনের মধ্যে, তা একটানে উপড়ে ফেলা আমার কম্মো নয়। আর মামাবাড়ীতে তিনিই সবার বড় দিদি, আমার দাদু-দিদার আদরের প্রথম সন্তান, তাই ভাইবোনদের কথায় পাত্তা দেবার প্রয়োজন মনে করেন না কোনোদিনই। একমাত্র ভরসা প্রিয়া। ও যদি ওর স্বভাবসিদ্ধ প্রক্রিয়ায় গলা জড়িয়ে ধরে, কোলে মাথা রেখে, আদুরে গলায় আবদার- টাবদার করে কোনো ম্যাজিক করতে পারে। ও চেষ্টা করল যথাসাধ্য। কিন্তু আমরা থাকি প্রায় উনিশশো কিলোমিটার দূরে মুম্বাইতে। আমাদের অনুপস্থিতিতে তিনি ওষুধপত্র ঠিকমতো খাচ্ছেন কিনা, শরীরের যত্নআত্তি করছেন কিনা — সেসব কে দেখতে আসছে? অতএব ভাগ্যের হাতেই ছাড়া রইল সবকিছু।

সময় গড়িয়ে চলল তার নিজের গতিতে। প্রিয়ার গর্ভে আমাদের সন্তান ক্রমশঃ আরো ঘন ঘন তার অস্তিত্ব জাহির করে জানান দিতে থাকল তার মুক্তির দিন আসন্ন। আর এমনই আমার ভাগ্য, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খারাপ হতে লাগল কলকাতায় একজনের শরীর। প্রিয়ার ডিউ ডেটের কিছুদিন আগে যে তাঁর আমাদের কাছে এসে থাকার কথা, সেই তোড়জোড় করতে যাওয়ার আগেই খবর পেলাম অবস্থার অবনতি হয়েছে,  সর্বশেষ রক্তপরীক্ষায় ইউরিয়া-ক্রিয়াটিনিন সাংঘাতিক বেড়েছে, ডাক্তার ডায়ালিসিসের কথা ভেবে দেখছেন। মরীয়া হয়ে ডাক্তারকে কোনোরকমে ফোনে ধরে জানতে চাইলাম আমার ঠিক কী করা উচিত এই মুহূর্তে, কিন্তু দেখলাম উনি নিজেই একটু দ্বিধাগ্রস্ত। শেষে বললেন সাবধানতাবশতঃ কোনো হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তি করাই ভাল। প্রিয়াকে আমার শাশুড়ির জিম্মায় রেখে ছুটলাম কলকাতা, দেখলাম গা-হাত-পা বেশ ভালরকম ফোলা, একটা প্রাইভেট নার্সিং হোমে ভর্তি করে সঙ্গে রইলাম কয়েকদিন, যতক্ষণ না অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। সে-যাত্রা আর  ডায়ালিসিসের দিকে গড়ায়নি ব্যাপারটা, ওষুধপত্র আর পরিষেবা দিয়েই সামলে দেওয়া গেছিল। কিন্তু শরীর ভীষণ দুর্বল তাঁর, খাওয়াদাওয়ায় প্রবল অরুচি। ওদিকে আমাকে তো দেশের উল্টোদিকে একজনের পৃথিবীতে আবির্ভাবের আয়োজনেও দরকার, সেখানেও যেকোনো দিন ঘটতে পারে ব্যাপারটা।  অতএব তাঁকে বাড়ীতে ফিরিয়ে এনে সকালের আর রাতের শিফটে দুজন আয়া রেখে আমার এক নিকট আত্মীয়কে বললাম কটা দিন আমাদের বাড়ীতে থাকতে। আমাকে বিদায় দেবার সময় হাতটা আর ছাড়তে চাইছিলেন না তিনি।

সেবার কলকাতা গিয়ে যেকটা রাত একা ছিলাম আমাদের বাড়ীতে, একটা বিশেষ কাজ সেরে ফেলার সুযোগ ছাড়িনি। আমার ঠাকুর্দার আমলের কাঠের আলমারি আর বাবার চাকরির প্রথম টাকায় কেনা স্টিলের আলমারির বিভিন্ন তাকের আনাচে কানাচে পুরোনো দিনের অনেক সাদাকালো ছবিভর্তি অ্যালবাম থাকত জানতাম। সেগুলো বার করে বহু বছরের ধুলো ঝেড়ে কয়েকটা আমার ব্যাগে ভরলাম আর বাকিগুলো থেকে কিছু পারিবারিক ছবি সযত্নে খুলে সঙ্গে নিয়ে নিলাম। আমাদের মুম্বাইয়ের নতুন ফ্ল্যাট প্রিয়ার ছোটবেলার আর জামশেদপুরে ওদের পৈতৃক বাড়ীর অজস্র ছবিতে ভর্তি, কিন্তু আমার জীবনের প্রায় কোনো ছবিই নেই সেখানে। যাইহোক, তারপর অ্যালবামগুলো আবার আলমারিতে রাখতে গিয়ে যে আবিষ্কারটা করলাম, তার জন্য মোটেই তৈরী ছিলাম না। স্টিলের আলমারির চাবি দেওয়া ড্রয়ারে খয়েরি মলাটের কয়েকটা ধুলোপড়া ডায়রী। ভেতরে এ কার হাতের লেখা? তিনি যে কোনোদিন ডায়রী লিখতেন, একথা কস্মিনকালেও শুনিনি। পাতার ওপরে তারিখ দেখে বুঝলাম বাবা মারা যাওয়ার পর একাকিত্বের দিনগুলো কাটাবার এটা ছিল একটা উপায়। অদম্য কৌতূহলে পাতা ওল্টাতে শুরু করতেই দেখি প্রথম পাতার প্রথম অনুচ্ছেদে লেখা, “জানিনা এ পণ্ডশ্রমের কী মানে, তবু আজ খুব লিখতে ইচ্ছে করছে। আমার জীবনী তো কেউ কখনো লিখবে না, তাই এই ডায়রীর পাতাতেই নীরবে নিঃভৃতে জমা থাক আমার গল্প।”

তার পরের গল্প খুব সংক্ষেপে বলি। কারণ বিশদে বলার সময় বা মন — কোনোটাই নেই এই মুহূর্তে। মাত্র গতকাল, মে মাসের এক মেঘলা গুমোট সকালে আমাদের ঘর আলো করে পৃথিবীতে এসেছে যে, সে এখনো মুম্বইয়ের হাসপাতালের ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডেই আছে তার মায়ের সঙ্গে। নাম আয়ুষ্মান প্রিয়াংশু। আধখানা তার ঠাকুমার দেওয়া, বাকি আধখানা দিদিমার। তাহলে আমি এখন এই বারোশো মাইল দূরে কলকাতার হাসপাতালে  বসে কী করছি? আসলে অনেক বছর আগে এইরকমই এক মে মাসে আমিও পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম প্রথমবারের জন্য। সেদিন আমাকে যাঁর পাশে যত্ন করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল, আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে যে আজ তাঁর বিদায়ক্ষণ সমাগত, কিন্তু সমস্ত শরীর-মন সেই চিন্তাটাকে নস্যাৎ করে দিয়ে চীৎকার করে উঠতে চাইছে — না, না, না। অবশ্য আমার মন কী বলল না বলল, তাতে তো কিছু আসে যায় না — আসল কথা বলবে হাসপাতালের আই সি ইউয়ের ওই মনিটর আর যন্ত্রপাতিগুলো। কাল মুম্বইয়ের নামকরা হাসপাতালের ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডে যখন আমার সঙ্গে ন-বছর আগে দিল্লীর ইউনিভার্সিটিতে আলাপ হওয়া এক ব্যাঙ্গালোরবাসী যুবতীর ক্লান্ত শরীরের পাশে শোয়ানো রক্তমাংসের ছোট্ট পুতুলটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়েছিলাম, তখনই একটা ফোন এসেছিল কলকাতা থেকে। সেখানকার হাসপাতালে একজন লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে। ডায়ালিসিস চলছে কিন্তু তার শরীর সে-ধকল নিতে পারছে না। অবস্থার অবনতি হচ্ছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সবকিছু ফেলে ছুটে এলাম যখন কলকাতায়, ততক্ষণে লড়াই পৌঁছে গেছে আই সি ইউতে।

সেই আই সি ইউয়ের বাইরে এখন বসে আছি আমি ভোর-রাতে। খবরের প্রতীক্ষায়। কী থাকবে সেই খবরে? নিয়তিই জানে। আমি বরং বসে বসে একটা কাজ সেরে ফেলি। একজনের জীবনীর জন্য একটা যুৎসই নাম ঠিক করা দরকার। লেখা-ফেখা আমার তেমন আসেনা, কিন্তু তা বলে একজনের আত্মকথা গোপনে নিঃশব্দে ডায়রীর জীর্ণ পাতায় বন্দী হয়ে অন্ধকারে পড়ে থাকবে — এ তো আমি বেঁচে থাকতে হতে দেওয়া যায়না। তবে যে  ভদ্রমহিলা সারাজীবন আমাকে একটুও স্বস্তিতে থাকতে দেননি, তিনি আজই বা সহজে ছেড়ে দেবেন কেন? কিছুতেই একটা উপযুক্ত নাম মাথায় আসছে না। একবার ভাবলাম “স্নেহময়ী” লিখি। পরক্ষণেই মনে হল জীবনের প্রথম দিন থেকে আজ অবধি তাঁর কাছে যা পেয়েছি, “স্নেহ” নামক দু-অক্ষরের শব্দটা তো তার ধারেকাছেও পৌঁছয় না। তারপর মাথায় এল “জীবনদাত্রী”, কিন্তু নাঃ, শুধু আমার শরীরে জীবন দিয়েই  তো তিনি ছেড়ে দেননি এ-পৃথিবীতে। যতদিন পেরেছেন দু-বাহু দিয়ে অপরিসীম যত্নে আগলেছেন সেই জীবনটাকে। আচ্ছা, “জীবনের ধ্রুবতারা” লিখলে কেমন হয়? মন্দ নয় নামটা।

ঠিক তখনই খবরটা এল আই সি ইউয়ের হিমশীতল গহ্বর থেকে নিষ্ঠূর কাচের দরজা ভেদ করে। জানলার বাইরে ভোরের আকাশও অবশ্য একই কথা বলছিল। চাঁদ ডুবেছে। একটা নতুন তারা জ্বলজ্বল করছে সেখানে।  

Top

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shuja
Shuja
1 year ago

লেখাটা পড়তে পড়তে কখন হাসি এসেছে আবার কখন চোখ ভিজে যাবার উপক্রম হয়েছে। মাকে নিয়ে লেখা একটি ব্যাতিক্রমধর্মী, অপূর্ব লেখা।


Copyright © 2023. All Rights Reserved.