কলুর বলদ

শিশিরকন্যা জয়িতা

দেশের অর্থনীতিকে বছরের পর বছর উজ্জীবিত করে আসছে যে শ্রমিক শ্রেণী, দেশের মানুষেরা গর্ব করে তাদের ডাকে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’। নিজেদের সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে, হাড় ভাঙ্গা খাটুনি করে বেতনের প্রায় সবটুকুই দেশে পাঠিয়ে দেয় এরা। বিদেশের মাটিতে মুখ গুঁজে পরে থাকে, প্রিয়জনদের সুখের কথা ভেবে, আরাম আয়েসের কথা ভেবে। বিদেশের মাটিতে খুবই অল্প চাহিদায়, অল্প খরচে, একসাথে অনেকজন মিলে থেকে, যাতে টাকা জমাতে পারে। পরিবার আর সংসারের কথা ভেবে কোনো মাসে সেই টাকা পাঠাতে এদের ভুল হয়না।

এরা তো অবশ্যই রেমিট্যান্স যোদ্ধা। কিন্তু বদলে এরা কি পায় দেশের মানুষদের কাছ থেকে? সরকারই বা কতটুকু ভাবে তাদের কথা?

কোনো এক রোজার ঈদে, ‘কলুর বলদ’ নামে টেলিভিশনে চ্যানেল আই এর একটি নাটক দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। পরিবারের আপনজনেরা কি করে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে, আর বহু দিন পরিবার থেকে দূরে থাকার কারনে বিদেশ থেকে আসা মানুষটির সরলতার সুযোগ নেয়, তা ছিল আমার চিন্তার অতীত। ষড়যন্ত্র করে সম্পত্তি থেকে বাদ দেয়া, বিয়ে করতে চাইলে বিয়ের কথাবার্তা এগুতে না দেয়া, স্থায়ী ভাবে দেশে ফিরতে চাইলে চাপ দিয়ে আবার বিদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া, এমন অনেক কিছু দেখেছিলাম নাটকটিতে।

খুব সম্ভবত নাটকটি দেশে বিদেশে দর্শকের কাছ থেকে দারুণ সাড়া পেয়েছিল। সেই বছরেরই কোরবানি ঈদে পেয়েছিলাম তাদের আরও একটি চমৎকার পরিবেশনা, ‘কলুর বলদ ২’। যা কিনা আগের নাটকটির সিকোএল। সেখানে দেখিয়েছিল, আপন মানুষদের চেহারা এবং চিন্তাধারা কত সহজে বদলে যেতে পারে শুধু মাত্র অর্থের লোভে। এতই বদলে যায় যে তারা আপন মানুষটিকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। 

বাংলায় কলু শব্দের অর্থ, তৈলকার ব্যাক্তি যে ঘানিতে তেল তৈরি করে। আর কলুর বলদ হোলো এমন ব্যাক্তি বা প্রানী যার নিজের ইচ্ছাশক্তি বা স্বাধীনতা নেই, কেবল অন্যের ইচ্ছা অনুসারে যাকে সর্বদা খাটতে হয়। আমি যাদের নিয়ে কথা বলছি, তারা বাস্তবের কলুর বলদ। বাস্তবের কলুর বলদরা অনেক বেশী অসহায়। তারা এমনই এক ভাগ্যচক্রে আটকা পড়ে যার ভেতর থেকে ভালো না লাগলেও তাদের বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। তারা অবিরাম ঘানি টেনে যায়। অনেক সময় তারা পরিবারের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। আবার অনেক সময় পরিবারের সদস্যের অভাব, অনটন আর সমস্যাগুলোই তাদেরকে বাধ্য করে বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করতে, পারিবারিক অবস্থার উন্নতি করতে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, বিয়ের খরচ, যৌতূক, ভাইএর ব্যবসার উন্নতি, বাবামার চিকিৎসা, পাকা দালান তৈরি, এমন আরও অনেক যুক্তিযুক্ত কারন তাদের আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে এক অদৃষ্ট নিয়তির বেড়াজালে।  

এক গ্রীষ্মের ছুটিতে আমি আমার পরিবার এর সাথে ফ্রান্সের প্যারিস এ বেড়াতে গিয়েছিলাম। দেখতে গিয়েছিলাম, শহরের সবথেকে উঁচু পয়েন্টিতে এক পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত একটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ। যার নাম Sacre-Coeur Basilica। সেই স্থানটি থেকেই দেখতে পাওয়া যায় পুরো প্যারিস শহরের এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। হাজার হাজার টুরিস্ট সেখানে আসে, ছবি তোলে, লাইভ ভিডিও করে, ফটো শুট করে। কেউ কেউ পাহাড়ের মাথায় বসে ঐতিহাসিক ফরাসী নগরীটির সৌন্দর্য উপভোগ করে। কেউ কেউ আবার চার্চের ভিতর ঢুকে হাজার বছরের পুরনো নির্মাণ শৈলী আর স্থাপত্যকলার নিদর্শন দেখে।

আমাদের হাতে সময় ছিল খুবই কম। এই মনোমুগ্ধকর জায়গাটি দেখে আমাদের স্টেশন এ যাবার কথা আবার ফিরতি পথের ট্রেন ধরতে। অসংখ্য মানুষের ভিড় ছাপিয়ে পাহাড়ের মাথায় একটু জায়গা করে আমরা চটজলদি কিছু ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ কে যেন বাংলায় বলে উঠলো, ‘আপা, প্লিজ আপনাদের ব্যাগগুলো সামলে রাখেন। এই জায়গাটা চোর পকেটমার দিয়ে ভরা।’ পাশে তাকিয়ে দেখি, একজন বাঙালি খেলনা বিক্রেতা চাদর পেতে মাটিতে বসে বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করছে। আমি তাকাতে উনি বলল, ‘আপনি ভাইয়ার সাথে বাংলায় কথা বলছিলেন। তাই বুঝলাম, আপনারা বাঙালি।’ চারিদিকে হাজার হাজার বিদেশী পর্যটকদের রকমারি ভাষার কথোপকথনের মাঝ থেকে নিজের মাতৃভাষা শুনে, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বাঙালি পরিবারকে সাবধান করে দেয়ার কি অসাধারণ দায়িত্ববোধ তার! কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল।  

কথায় কথায় উনার কাছ থেকে জেনেছিলাম, উনি বহু দিন আগে সিলেট অঞ্চল থেকে প্যারিসে এসেছেন। উনার পরিবার সিলেটেই থাকে। দেশে গিয়ে আটকে যাওয়ার ভয়ে আর কখনো দেশে ফেরত যাননি। তবে নিয়মিত টাকা পাঠান পরিবারকে। বলতে বলতে উনার চোখ দুটো ভিজে উঠছিল। উনার কাছ থেকে আমার ছেলেদের জন্য দুটো খেলনা কিনলাম। দাম জানতে চাইলে বলল, ‘আপা, যা মনে হয় দেন। আপনারা বাঙালি, আপনাদের কাছে কি চাবো।’ আরো একবার লোকটার প্রতি দারুণ সহমর্মিতা অনুভব করলাম। প্যারিস ছাড়ার আগে আমাদের কাছে যা ইউরো বাকি ছিল তার প্রায় সবটাই উনাকে দিয়ে দিলাম। উনি অনেক খুশী হলেন। বললেন, ‘আপা, আমার জন্য দোয়া করবেন যেন একবার দেশে যেতে পারি।’ এই লোকটির সাথে আর কোনো দিন দেখা হবে কিনা জানিনা। তবে দেশের প্রতি এই দেশ ছাড়া মানুষটির নিখাদ টান ও ভালোবাসার অবিস্মরণীয় উদাহরণ আজীবন মনে থাকবে।  

এরকম রেমিট্যান্স কর্মীরা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। সৌদি আরব, ইউ এ ই, কাতার, কুয়েত, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউ এস, ইউ কে, ইউরোপ এর বিভিন্ন দেশে। দৈনন্দিন কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে, স্টেশনে, বাসে, চলতে ফিরতে, কোনো বাঙালির সাথে দেখা হলে, পরিচয় হলে, এরা এদের সবটা উজার করে দেয়। বাঙালি ট্যুরিস্টকে পথ নির্দেশনা দেয়া, বাঙালি রেস্তোরার সন্ধান দেয়া, লোকাল কারেন্সি ভাঙ্গিয়ে দেয়া, মালামাল টেনে দেয়া, স্যুভেনিওর এর খোঁজ দেয়া, দর্শনীয় জায়গাগুলো চিনিয়ে দেয়া, এমন অনেক কাজেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি ভাইবোনদের দেখলে। অনেক সময় ফলমূল, পানীয়, চকলেট বিনা মূল্যে দিয়ে দিতে চায়। বেড়াতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা অনেক শহরে আমার অনেকবার হয়েছে।

দেশ ও জাতির প্রতি এতো মমত্ববোধ, এতো উদারতা, এতো টান আর কারা অনুভব করে? সম্ভবত দেশে থাকা কোনো বাঙালি নয়। প্রিয়জনদের ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকার কষ্ট যারা জানে, তারা অনুভব করে। তারাই জানে, যতদিন আয় করতে পারবে দেশে টাকা পাঠাতে পারবে ততদিনই তাদের কদর, প্রিয়জনদের কাছে। তবুও, দেশ মাতৃকার প্রতি তাদের টান এতোটুকুও কমেনা। স্বজনদের প্রতি তাদের দায়িত্ব কর্তব্য এতোটুকুও কমেনা। যারা দেশে যেতে পারেনা, বছরের পর বছর প্রতীক্ষার দিন গুনে আর আশায় বুক বাঁধে, একদিন হয়তো দেশে ফেরা হবে।

দেশে ফিরলেও তাদের বিভিন্ন রকম হয়রানির খবর প্রায়ই খবরের কাগজে আসে। এয়ারপোর্টে মালামাল, দেহ তল্লাশি, টাকাপয়সা ছিনতাই, সুটকেস থেকে দামী উপহারসামগ্রী চুরি, দুর্বিত্তের হাতে মারধোর হেনস্তা, ভিসা নবায়নে ভোগান্তি, চাকুরি হারানো, সুচিকিৎসার অভাব, এমন অনেক ধরনের অন্যায়, অপমান ও অভিযোগের কথা আমরা শুনতে পাই কলুর বলদদের থেকে। দেশের অর্থনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ন এবং অবিরাম অবদানের কথা যেন সরকারী মহলের চোখেই পড়েনা – চোখের পানি মুছতে মুছতে অনেক রেমিট্যান্স কর্মীরা বলেন।      

দেশের মাটিতে অথবা প্রবাসে বসে, সুখী স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে, বাস্তবের কলুর বলদদের কথা আমরা কয়জন ভাবি?


Top

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments


Copyright © 2023. All Rights Reserved.