একজন মানুষ বন্ধু 

রুমানা সোবহান 

ভাপসা গরম পরেছে। আর এই গরম কালে কারেন্ট চলে যায় একটু পর পর। ।ইদ্রিছ মিঞা খালি গায়ে বাড়ির বাইরে ইজি চেয়ার নিয়ে বসেছেন। একটুও বাতাস নাই। তার মধ্যে পাড়ার পোলাপান গুলো কারেন্ট চলে গেলেই ঘর থেকে দৌড়ে রাস্তায় নেমে আসে। খালি হৈ হুল্লোর করে, অন্ধকারে কারো বাসার চালে ঢিল ছুড়ে, দরজায় কড়া নাড়ে বা বাগানের ফুল চুরি করে। পথচারীদের গায়ে থুতু ফেলে, বারান্দা থেকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে দৌড়ে পালায়। দেখে মনে হয় এরা একেকটা ইবলিশের বাচ্চা ।

মানুষের বাচ্চাদের নামে আর কি বিচার দেবেন উনি! ওনার নিজের মেয়েই তো এই বাউন্ডেলেদের লিডার। 

চার ছেলে আর চার মেয়ের পর হঠাৎই অবেলায় এই বিবি আয়শার জন্ম হলো। কি যে লজ্জায় পরেছিলেন ইদ্রিস মিঞা সেবার । ছেলের ঘরের নাতি জুম্মন মিঞা আর ওনার মেয়ে বিবি আয়শা একই সপ্তাহে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলো । এখন ওদের বয়স তের বছর চলছে।

 প্রায় প্রতিদিনই বিবি আয়শার নামে নালিশ আসে, হয় কারো বাসার জানালার কাচ ভেঙ্গেছে বা আমগাছের কচি আম গুলো সব ছিঁড়ে এনেছে, বড়ই গাছ ছাফ করে ফেলছে, কারো খোয়ার থেকে মুরগির ডিম চুরি করে এনেছে। ইদ্রিস সাহেব আর মানসিক চাপ নিতে পারেন না। হেন অপকর্ম নাই যে বিবি আয়শা করেনা। প্রচন্ড মানসিক চাপের মুহূর্তে ইদ্রিস মিঞা যেকোনো পরিবেশেই ঘুমাতে পরেন। বিবি আয়শার কথা ভাবতে ভাবতে এতো কোলাহলের মধ্যেও উনি ঘাড় কাত করেই ঘুমিয়ে পরেছিলেন ইজি চেয়ার বসেই।

পাশাপাশি বাড়িতে থাকার জন্য ইদ্রিস মিঞার পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। বিবি আয়শা আর ওর ভাতিজা জুম্মন আমার থেকে একটু বড় হলেও ওরা ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু । যদিও ওদের সাথে আমাদের কোনো কিছুতেই মিল ছিল না। যেমন ওরা জোড়ে জোড়ে কথা বলতো। কথা বলার সময় ধাক্কা দিয়ে কথা বলতো। উচ্চস্বরে হাসতো। কিছু গালি ছিল ওদের মুখের বুলি। অনেক গুলো ভাই বোন থাকার কারনে ওদের বাড়িটা সারা ক্ষণ গম গম করতো। হাসি ঠাট্টায় ওদের দিন কাটতো। ওদের  বাড়ির মহিলারা প্রচুর স্বর্নালংকার পরতো। আর বাইরে যাবার সময় কড়া গোলাপি , বাদামি বা আকাশি রং এর বোরখা পরতো । সাথে পরতো জড়ির কাজ করা ওরনা। আর রান্না ঘরেই ওনাদের দিনের প্রায় পুরোটা সময়ই কেটে যেতো। কতো রকমের যে খাবার রান্না করতে পারতো ওরা! ওরা কারনে অকারনেই কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করতো। আমি ছিলাম ঐ বাসার নিয়মিত অতিথি।  

ওদের দেখে মনে হতো জীবনটা যেন শুধু উপভোগের জন্য। মজার মজার রান্না করা , দুপুরের খাবারের পর  ভিসিআর এ নতুন রিলিজ হওয়া সিনেমা দেখা আর বিকেল বেলা সেজেগুজে বেড়াতে যাওয়া। আর কোনো কাজ বা টেনশন ছিলনা ওনাদের। আমি  ঢাকাইয়া কুট্টি পরিবারের সব নিয়মকানুন গুলো ভীষণ উপভোগ করতাম। বিবি আয়শার ভাবীদের আমি মনে মনে আমার আইডল ভাবতাম। কল্পনায় আমি ভাবীদের মতো করেই নিজেকে দেখতাম।

বিবি আয়শা ছিল আমাদের সবার প্রিয় বান্ধবী । যদিও কোনো দিন আমাদের সাথে ও কুতকুত, এলোনা বেলোনা, ফুলটোক্কা, লুডু খেলেনি। ও খেলতো ছেলেদের  সাথে সাত চাড়া, ফুটবল, ডাংগুলি আর কার্ড। মাঝে মধ্যে ওর বড় ভাইয়ের পকেট থেকে সিগেরেট চুড়ি করে এনে আমাদের সামনে খেতো। ধোঁয়া দিয়ে রিং বানাতেও পারতো বিবি আয়শা। 

এর ওর গাছ থেকে ফল চুরি করে এনে আমাদের বাড়ির সামনে এসে চিৎকার দিয়ে ডাকতো,’ ঐ পক্কা নাইম্মা আয় সবড়ি আনছি। অহন ও নামছ না কেলা? ঐ টেগরির বাচ্চা’! বলেই আবার ঢিল ছোড় ছুড়ি শুরু করতো বাসার বারান্দায় । একটা পাগল ছিল। 

মেয়ে হলেও ছেলেদের মতোই জীবন যাপন করতো বিবি আয়শা। যদিও প্রথম দেখায় যে কেউ ওকে ছেলেই মনে করতো। ওর এই জেন্ডার রোল নিয়ে অবশ্য কেউ তেমন মাথা ঘামাতো না। বরং সবাই উপভোগ করতো। 

ওদের বাসায় একই বয়সী দুটো বাচ্চা থাকার পরও সবার চোখের মনি বিবি আয়শা। সবার প্রশ্রয়ে বিবি আয়শার যা মনে চায় তাই করে । এই যেমন সে নিজের জামা কাপড় না পরে ভাতিজা জুম্মনের জন্য কেনা হাওয়াই সার্ট আর ইংলিশ প্যান্ট গুলো পরে। ওর জন্য বানানো কাপড় গুলো কোনোদিনও পরেনি ও। এমনকি চুল কাটার জন্য ও ছেলেদের সেলুনে যেতো। টাকা পয়সা রাখার জন্য ওরও ভাইদের মতো মানিব্যাগ লাগতো।

 আমরা যখন ঈদে প্রথম সালোয়ার কামিজ কিনলাম তখন বিবি আয়শা  টিসার্ট, জিনসের প্যান্ট আর জাম্প কেডস কিনেছিল । একবার তো জুম্মন আর ও একই রকম সুট বানিয়েছিল ঈদে। আর স্কুলে যখন থেকে সালোয়ার কামিজ পরা শুরু হলো তখন ও খুব সমস্যায় পরেছিল। ছেলোয়ার কামিজ পরে ও দৌড়ে স্কুলে যেতো যেন এই পোষাকে ওকে কেউ না দেখে ফেলে। আবার স্কুল শেষে দৌড়ে বাসায় এসেই ড্রেস চেন্জ করে নিত। এই ড্রেসের ঝামেলার জন্য  ও প্রায়ই স্কুল কামাই দিত।

হাঁটা চলা, কথা বার্তা সবই ও ছেলেদের মতো করে করে। বিবি আয়শা ওর এই অন্যরকম আচরণ যেমন বাসার সবাই উপভোগ করতো তেমনি পাড়ার চাচীরাও প্রশ্রয় দিতো। পাড়ার চাচীরা প্রায়ই বিবি আয়শাকে  টাউন হল বাজারে পাঠাতো এটা সেটা কিনে আনবার জন্য। আবার ওকে আদর করে পোলার আইসক্রিম খাওয়ার জন্য টাকাও দিতো। সবাই এতো মাথায় নিয়ে রাখতো যে দিনে দিনে বিবি আয়শা চরম বেয়ারা হয়ে যাচ্ছিল। মাগরিবের আজানের পরও বাসায় ফিরত না। একবার এই বেয়ারাপনার খেসারতও দিয়েছিল বিবি আয়শা চরম ভাবে।

 ইদ্রিস মিঞার  কাছে ও একটা জল জ্যান্ত আপদ। ওর উপর কোনো নিয়ন্ত্রণই ওনার নেই। আর কি কি দুর্ভোগ কপালে আছে এই মেয়ের জন্য তা শুধু গায়েবের মালিক আল্লাহ পাকই জানেন। ওকে এখন তার গলার কাটা মনে হয়। এতো প্রভাব প্রতিপত্তি থাকার পরও তিনি আয়শাকে রক্ষা করতে পারেনি চেনা মানুষদের কাছ থেকে। এই মেয়ের জন্যই এই বাড়ি বিক্রি করে আবার পুরান ঢাকায় চলে যাবেন বলে মন স্থির করেছেন ইদ্রিস মিঞা।

 পড়া লেখার প্রতি চরম অনীহা আর মেয়েদের মতো কামিজ পরতে হবে বলে ও স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল বিবি আয়শা। সারাদিনই বলতে গেলে ও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যাবেলায় পাড়ার ক্লাবে ছেলেদের সাথে কেড়াম খেলে তারপর বাড়ি ফিরতো।

একদিন সন্ধ্যা বেলায়  বিবি আয়শা তার ছেলে বন্ধুদের সাথে ক্লাবে কেরাম খেলছিল । এর মধ্যে হঠাৎই কারেন্ট চলে যায়। প্রায় পনেরো বিশ জন পাড়ার ছেলে যাদেরকে বিবি আয়শা বন্ধু মনে করতো তারা সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠল আসলে বিবি আয়শা ছেলে না মেয়ে তা যাচাই করবার জন্য। কি ভয়ংকর আজাব গেছে বিবি আয়শার উপর তা ভাবা যায় না। কারেন্ট আসার পর ওরা যে যার বাড়িতে চলে যায়। আর বিবি আয়শা ছিন্ন পোশাকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ি ফেরে। ওর পরিবার থানায় যায়নি। কেন যায়নি তা এখনও আমার বোধগম্য না।

এরপর থেকে বিবি আয়শা আর কারও সাথে মিশতো না। এমন কি আমাদের বন্ধুদের পুরা গ্রুপের সাথেও কথা বলতো না। কেন যে এড়িয়ে চলতো তার কোনো ব্যাখ্যা তখন আমাদের মাথায় আসেনি। হয়তো এতো দিন ধরে মনে প্রানে পুরুষ হবার জন্য ও যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল  তাই ওকে ভয়ংকর কষ্ট দিয়েছিল । সে আর কাউকেই বন্ধু ভাবতে পারেনি। 

আমার মনে হয় ওর ছিল পুরুষ সত্বা। কিন্তু পুরুষের ভেতরের এই দানবীয় জংলি আচরণ ও কখনও কল্পনা করেনি। 

 আবার এই নারী দেহের প্রতিনিধিত্ব করাও ওর একদম ভালো লাগত না। মেয়েদের কোনো বৈশিষ্ট্যই ওর মধ্যে ছিল না । আসলে ওর যেখানে থাকার কথা সেখানে ও নেই। ক্রমাগত যুদ্ধ হচ্ছিল ওর মনের ভেতর। কি ভয়ংকর একটা মানসিক কষ্টই না হচ্ছিল ওর তখন । 

ও আর ঘরের বাইরে যেতোনা। খুব প্রয়োজনে বাইরে যাবার সময় বোরখা পরত। একদিন বোরখার ঐ কালো নেকাবের মধ্য দিয়ে ওর ছলছল করা চোখ জোড়া আমি দেখেছিলাম। ওরা পরবর্তীতে   ঐ বাড়িটা বিক্রি করে শাখারী পট্টিতে চলে গিয়েছিল। আমি আজও রাস্তায় বেরোলে কালো নেকাবের ভেতরে একজোড়া চেনা চোখ খুঁজি । একবার যদি ওকে পেতাম গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে বলতাম তুই আমার মানুষ বন্ধু আর কোনো পরিচয় আমার জানার দরকার নাই রে বিবি আয়শা।

Top

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shuja
Shuja
1 year ago

A beautiful timely story that really touches the heart.


Copyright © 2023. All Rights Reserved.