থেমে থাকা হৃৎপিণ্ড
কাজী মঈনুল হক 

পাপিয়া হাইওয়েতে গাড়ি চালাতে পছন্দ করত না। সে যখন তখন গাড়ি থামিয়ে চারপাশটা দেখে নিতে পছন্দ করে। ভাগ্যিস, আমরা এখন ঢাকায় থাকি; আমরা না চাইলেও ট্রাফিক জ্যামে আমাদের থেমে থাকতে হয়। এ নিয়ে পাপিয়ার মধ্যে কোনো অভিযোগ ছিল না। বরং মনে হত, সে যেন সব কিছুতে খুব মজা পাচ্ছে। কিন্তু একটা ঘটনায় পাপিয়া খুব বদলে যায় এবং নতুন করে তাকে চেনার পালা শুরু হয়। সে ড্রাইভ করাই ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ সে চালাচ্ছে।

আমি ছোটখাট একজন সরকারি চাকুরে। মাঝে একবার বিদেশ গিয়েছিলাম পড়াশুনা করতে। কিন্তু মন টেকেনি। তবু এই বিদেশ যাওয়াটা আমার ঝুলে পড়া প্রেমটাকে বিয়ে অব্দি নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। ডিগ্রিটা শেষ করতে না পারলেও প্রায় হারিয়ে যেতে বসা পাপিয়াকে ফিরে পেয়েছিলাম এই বিদেশে পড়তে যাবার স্কলারশিপের বদৌলতে। পাপিয়া যে গাড়িটা চালাচ্ছে  তা আমার কেনা নয়, তার বাবা তাকে উপহার দিয়েছিল। ড্রাইভিং আমি তার কাছেই শিখেছিলাম। কিন্তু এই গাড়িতে নয়। হিরোশিমায় আমার নিজস্ব গাড়ি ছিল। এই ঢাকা শহরে আমার মেলা বন্ধু-বান্ধব বা ইয়ারদোস্ত আছে। “বন্ধুবান্ধব” এর সামার্থক শব্দ “ইয়ারদোস্ত” হলেও এর অন্তর্গত অর্থ বাঙ্গালদের কাছে এক নয়। ইয়ারদোস্তদের সাথে আড্ডাবাজি চলে, কিন্তু বন্ধুত্বের আত্মিক নৈকট্য সেখানে অনুপস্থিত। বাংলা ভাষায় যখন বিদেশি শব্দ ঢুকে পড়ে তখন মূল অর্থ হয়ত ঠিক থাকে কিন্তু এর স্ট্যাটাসে পরিবর্তন ঘটে যায়। এ কারণে থালা ও প্লেট যেমন এক নয়, তেমনি চুল ও বালের অবস্থানও অভিন্ন থাকে না।। অর্থে তেমন পরিবর্তন না হলেও বাহ্যিক ঠাটবাটে বিস্তর ফারাক ঘটে যায়। তাই সঠিকভাবে বলতে গেলে ঢাকা শহরে আমার বন্ধুবান্ধব নেই বললেই চলে, তবে অনেক ইয়ারদোস্ত আছে। আরিফ এদেরই একজন। ব্যবসা করে মেলা কামিয়েছে। মাঝে মধ্যেই অনেকের মত আমাকেও দাওয়াত দেয়। মেলা খানা ও পিনার  ব্যবস্থা করে। আমার নিজের টাকায় খাওয়ার সমস্যা না হলেও পিনার সংকুলন হয় না। তাই সে যখন নিমন্ত্রণ দেয় আমি সানন্দে রাজি হয়ে যাই। তবে যে শুধু শরাবের লোভে আমি সেখানে যাই তা নয়, পাপিয়া এই সব আড্ডায় এলে একঘেয়েমি থেকে খানিকটা মুক্তি পায়।

আমি যথেষ্ট মাতাল ছিলাম বলে পাপিয়াই আজ গাড়িটা চালাচ্ছে। পার্টি থেকে বেরিয়ে আসার সময় পাপিয়া আমাকে একটু পর্যবেক্ষণ করে সে তার হাত আমার জিন্সের প্যান্টের পকেটে চালান করে গাড়ির চাবিটা তুলে নেয়। সে সময় আমি আমার শরীরে তার হাতের ঘর্ষণ উপভোগ করেছিলাম, অনেক দিন ধরে আমি তার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত ছিলাম।

আমি গাড়ির গ্লাস খুলে মাথাটাকে জানলা ঘেঁষে রাখি। মধ্যরাত্রির বাইরে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা উপভোগ করি। এদিকে শহরটা বেশ ছিমছাম, পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু মোহাম্মাদপুরে, আমরা যেখানে থাকি, সেখানে শহরটাতে কোনো শ্রীছাঁদ নেই, সব কিছু যেন এলোমেলো ঠাসবুনোটের মত। এখানে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাপিয়া মাস্টারি করে।

গাড়িটা যেখানে এসে সিগন্যালে আটকাল সেখান থেকে হাসপাতালটা দেখা যায়। এখানে পাপিয়া এগারো মাস আগে বাচ্চাটকে হারিয়েছিল। একদিন রাতে হঠাৎ করে তার ব্যথা ওঠে যখন সে মাত্র ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট। তাকে ইমার্জেন্সি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। একটা নীল রঙের পুতুলের মত বাচ্চার জন্ম হয় যে জন্মের পরে কেঁদে ওঠে নাই, যার হৃৎপিণ্ড ছিল তার শরীরের মতই নিথর।

পাপিয়া হাসপাতালটার দিকে তাকিয়ে থাকে। লাল সিগন্যাল সবুজ হয়। কিন্তু সে খেয়াল করে না। আমি তার কাঁধে আলতো খোঁচা দিই। সে আবার চালাতে শুরু করে।

বাসার কাছে পৌঁছতেই আমরা একটা লোককে বাসার দেয়াল টপকে বেরিয়ে যেতে দেখি। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার ছুটন্ত শরীর ও মুখের ডানপাশটা দেখতে পাই। আমি চটজলদি গাড়ি থেকে নেমে গেট খুলি। পাপিয়া গাড়িটা ভিতরে পার্ক করে দেখতে পায় দরজার পাল্লাটা একটু খোলা। সে চিৎকার করে আমাকে ডাক দেয়।

দেয়ালঘেরা এই একতলা বাড়িতে আমরা থাকি। ছাদের অবকাঠামোয় উত্থিত শিকগুলো বলে দেয় পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়ির কাজ শেষ করার আগেই কাজ থামিয়ে দেয়া হয়েছে। এই বাসাটা আমরা ভাড়া পেয়েছিলাম পাপিয়ার পরিচিত একজনের মাধ্যমে। এ বাসায় কোনো কেয়ারটেকার বা গে’টম্যান নেই। বাড়ির মালিক সপরিবারে বিদেশ থাকেন। আমাদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন।ভিডিও কলে মাসে একবার কথা হয়। পাপিয়া ভদ্রলোককে বাড়ির আঙিনা ও ঘরদোর দেখান। তিনি তৃপ্ত বোধ করেন।  আমরা ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করি। জনাকীর্ণ শহরের মধ্যে এটা আমাদের একখণ্ড নিজস্ব নির্জনতা।

আমি গে’ট আটকে দেখি, পাপিয়া তখনো ঘরে ঢুকে নাই। সে জিজ্ঞেস করে, ‘আমরা কি দরজা খোলা রেখে বাইরে গিয়েছিলাম নাকি চোরটা খুলেছে?’

আমি পকেট থেকে চাবি বের করে দরজাটা লক করি এবং আবার খুলি। কোনো সমস্যা হয় না। আমি বলি, ‘কোনো কিছু দিয়ে খুললে লক খুলতে-লাগাতে সমস্যা হত। আমরাই হয়ত লাগাতে ভুলে গিয়েছিলাম।‘

— তুমি এতটা নিশ্চিত হচ্ছ কিভাবে?

— আমি শুধু একটা সম্ভবনার কথা বলছি।

— তাহলে কে লক করতে ভুলে গিয়েছিল? তুমি না আমি?

— সেটা বড় কথা নয়। আগে ভিতরে গিয়ে দেখি সব ঠিকঠাক আছে কিনা।

— তার মানে তুমি কি বলতে চাইছ, আমি লক করতে ভুলে গেছি!

— আমি তা কখন বললাম?

— পরোক্ষভাবে বলেছ। যাওয়ার সময় তুমি ড্রাইভ করেছিলে। তাই ঘর ও গে’ট আমার বন্ধ করার কথা।

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে ভিতরে ঢুকি। আমরা লাইট জ্বালিয়ে সমস্ত ঘর খুঁটে খুঁটে দেখি। কোথাও কোনো পরিবর্তন নজরে আসে না। বাইরে এসে লনটা দেখি। বাচ্চাদের খেলার জন্য, দৌড়ঝাঁপ করার জন্য চমৎকার আঙিনা। কিন্তু এ বাড়িতে কোনো বাচ্চা নেই। পরিত্যক্ত উঠোন। ফুল ফলের গাছ লাগানো যেত, শাকসবজির চাষ করা যেত। কিন্তু সব কিছু পড়ে আছে বড্ড অযত্নে অবহেলায়।

ঘরে ঢুকে আমি আবার পাপিয়ার জেরার মুখে পড়ি।

— লোকটার চুরির মতলব না থাকলে বাসায় কেন ঢুকেছিল?

— আমি কিভাবে জানব! কিছু যখন খোয়া যায়নি তখন এ নিয়ে ভেবে কী লাভ!

— তোমার কি মনে হয় না – – থানায় জানানো উচিত?

— কী জানাবে! অচেনা লোক বাসায় ঢুকেছিল, কিন্তু কিছু খোয়া যায়নি! দেখ, ওদের প্রতিদিন অনেক বড় বড় ক্রাইম নিয়ে ডীল করতে হয়।

— লোকটা হয়ত তোমাকে খুন করতে ঢুকেছিল।

— আমাকে কেন খুন করতে যাবে! আমি নির্বিবাদী মানুষ।

— হয়ত খুনের অভিজ্ঞতা পেতে। এজন্য নির্বিবাদী মানুষরাই উত্তম শিকার। তোমার মনে নেই, জাপানের একটা ছেলে যে একটা বুড়োকে খুন করেছিল শুধুমাত্র খুন করতে কেমন লাগে তা জানতে। বিকারগ্রস্ত মানুষে দুনিয়াটা ভরে যাচ্ছে! যারা নিষ্পাপ তাদের কেন মরে যেতে হয়! সব দোষ আমার!

— তুমি কি মেনিয়াক লোকে দুনিয়াটা ভরে যাবার জন্য নিজেকে দোষী ভাবছ!

— আমি কিভাবে ঘর লক না করে বেরিয়ে পড়লাম! হয়ত আজিজ চাচা স্পাই পাঠিয়েছিল বাড়ির হালহকীকত জানার জন্য!

আজিজ চাচা মানে এ বাড়ির মালিক যিনি সপরিবারে বিদেশ থাকেন।

— উনি না তোমাকে কত স্নেহ করেন, কত বিশ্বাস করেন।

— স্নেহ না ছাই! বিনা পয়সায় কেয়ারটেকার ও দারোয়ান পেয়ে গেছেন। এর পর উপরি বাড়ি ভাড়াও পাচ্ছেন।

— ছি, এভাবে বলতে নাই। চলো, ঘুমোতে যাই।

— তুমি কেন আমাকে মনে করিয়ে দিলে না?

— কী মনে করিয়ে দেবার কথা বলছ?

— ঘর লক করে যেতে

— কিন্তু তাতে তো কোনো কিছু যায় আসেনি!

— কিন্তু অনেক কিছু তো ঘটতে পারত!

— কিছুই ঘটতে পারত না। চলো, ঘুমোতে যাই।

— সব দোষ আমার! কিভাবে আমি সব কিছু ভুলে যাই!

সেদিন সারা রাত সে না ঘুমিয়ে কাটায়। একটা চেয়ার টেনে দরজার কাছে বসে থাকে।

বাচ্চাটা মারা যাবার পর আমি আগের পাপিয়াকে আর খুঁজে পাই না। মৃত বাচ্চা প্রসবের জন্য সে প্রথমে ডাক্তারকে দায়ী করেছিল তাদের অদক্ষতার জন্য। তারপর আমাকে দায়ী করে তাড়িতাড়ি হাসপাতালে আনতে না পারার জন্য। এবং শেষমেশ সব দোষ নিজের উপর চাপায়। সে হয়ত নিয়ম মেনে পুষ্টিকর খাবার খায়নি, ঠিকমত ব্যায়াম করেনি। সময় মত ডাক্তার দেখাতে যায়নি ইত্যাদি। প্রতিটি ঘটনায় সে এই একই চক্রের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে। প্রথমে অন্যকে দায়ী করবে, পরে আমাকে এবং উপসংহারে এসে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করবে।

পরদিন সে স্কুলে যায় না। আমি অফিস থেকে ফিরে দেখি, সে স্তব্ধ মূর্তির মত বসে আছে। চোখ দুটো লাল। চোখের নিচের কালি পড়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?

— তুমি চলে যাওয়ার পর ঘুমোতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু একটু ঘুম আসতেই মনে হল, কেউ যেন ঘাড়ের কাছে ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস ফেলছে আর হিস হিস করে শব্দ করছে। আর ঘুমোতে পারিনি।

এ ধরণের ঘটনা এই প্রথম নয়। মাসখানেক আগে রাতে ঘুমের মধ্যে কুট কুট শব্দ শুনতে পেত। তার কাছে মনে হত ইঁদুর এসে বিছানা বালিশ কাটছে। আমি ঘরে ইঁদুর ঢোকার সম্ভাব্য ছিদ্রগুলো বন্ধ করেছিলাম। আর নীলক্ষেত থেকে একটা বিড়াল কিনে আনি। এরপর সে আর কোনো শব্দ শুনতে পায়নি।

আমি তার কাছে গিয়ে কাছে টেনে কপালে চুমু খাই। সে অনড় থাকে। বাচ্চা মারা যাবার পর আমরা শারীরিকভাবে কাছাকাছি হতে পারছিলাম না। আমি তাকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করি, তোমার কী মনে হয়? কে ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস ফেলছিল?

— হয়ত কালকের সেই চোরটা ফিরে এসেছিল?

— তুমি কি দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়েছিলে?

— না তো —

— ঘুম থেকে উঠে কি দরজা খোলা পেয়েছিলে?

— না। তাহলে হয়ত সাপ ঢুকেছিল —

— সাপ কিভাবে ঢুকবে!

তারপর সে একটা বিদেশি খবরের গল্প বলে। আমেরিকার কোনো এক স্টেটে নাকি কোনো এক মহিলা টয়লেটে গিয়ে দেখে কমোডের মধ্যে সাপ।

— তুমি তো বাথরুম ও সারা ঘর তন্ন তন্ন করে দেখেছ — তাই না —

— তুমি কি করে বুঝলে?

— ঘরের অবস্থা দেখে। এজন্য শার্লক হোমস হওয়া লাগে না।

আমি তাকে শোবার ঘরে নিয়ে যাই। জানলার পর্দাটা দু’পাশে সরিয়ে জানলার পাল্লা দেখাই। তারপর বলি, দেখ, এই পাল্লার ফাঁক গলে বাতাস ঢুকছিল। তুমি ঘুমের মধ্যে সেই শব্দ শুনছিলে। আর তোমার অবচেতন মন এটাকে সাপের হিস হিস বানিয়ে ফেলেছে। তুমি কি কখনো সাপের হিস হিস শুনেছে?

— না।

— সারাদিন কিছু খেয়েছ?

— না।

—চল, রেডি হয়ে নাও। আজ আমরা বাইরে খাব।        

পাপিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় বদলায়। আমি আধশোয়া হয়ে তাকে দেখছিলাম। মেয়েটা ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছে। তাকে সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু তাকে সেটা বলতে গেলে মনঃক্ষুণ্ণ হবে। সে খুব সেন্সেটিভ ও বুদ্ধিমতি মেয়ে। আমি তাকে পাগল ভাবছি এটা তার কাছে হজম করা কঠিন হবে। জ্বর হলে আমরা তার জন্য লজ্জিত হই না। প্রেমে পড়ে স্যাকা খেলে সেই ক্ষত মনের মধ্যে গোপনে বহন করে চলি। নিজের জীবনের স্বাভাবিক পথ থেকে ছিটকে পড়ি। তবু মনোচিকিৎসকের কাছে যাই না। আমি নিজেই একটু একটু মনোবিজ্ঞানের উপর পড়াশুনা শুরু করেছি। খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছে। মানুষের মনের অন্ধকার অলিগলি বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝার চেষ্টা। কাজটা সহজ নয়।  আমি উঠে দাঁড়াই। তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু খাই। তার রোমকূপের শিহরণ দেখি। হাত গলিয়ে দিই জামার ভিতরে। তার ত্বকের মসৃণতা ও উষ্ণতা অনুভব করি। আঙ্গুলের ডগায় তার স্তনবৃন্তের জাগরণ উপভোগ করি। সে আমার হাত সরিয়ে দেয়।

বাচ্চা প্রসবের দুইদিন পরে পাপিয়ার বুকে দুধ আসে। আমি বাথরুমের দরজা খোলা পেয়ে ভিতরে ঢুকেছিলাম। সে তখন উন্মুক্ত বক্ষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন তার স্তনদুটো ধাউস হয়ে উঠেছিল। স্তনবৃন্ত থেকে নীল শিরাগুলো শুভ্র স্তন জুড়ে ছড়িয়ে আছে গাছের পাতার শিরাবিন্যাসের মত। সে স্তনবৃন্তে চাপ দেয়। হলুদাভ দুধ বেরিয়ে আসে। সেই দুধ সে জিহ্বায় ছুঁইয়ে স্বাদ নেয়। তারপর ম্লানকন্ঠে বলে, ‘কী নিদারুণ অপচয়।‘  

বাচ্চাটাকে কবর দেয়া হয়েছিল আমাদের গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক গোরস্তানে। ঘিওর ঢাকা শহর থেকে খুব দূরে নয়। সেখান থেকে ফিরে আসার কয়েকদিন পরে আমি একটা এতিমখানায় যাই। তাদের জন্য খাবার কিনি, তাদের সাথে সময় কাটাই। সুপারিন্টেনডেন্টের সাথে কথা বলে সেখানে মাসিকভিত্তিতে কিছু টাকা দেবার ব্যবস্থা করি। মাঝে মধ্যেই সেখানে যেতাম। এ সবের কোনো কিছুই আমি পাপিয়াকে বলি নাই। আমি আমার নিজের আচরণেই অবাক হয়েছিলাম। ধর্মের রীতিনীতি আমাকে কখনো টানেনি। সেই অর্থে আমি কোনো ধার্মিক নই। তবে কোন্‌ বোধ আমাকে এই এতিম বাচ্চাদের কাছে টেনে নিয়ে আসে? পিতৃত্ববোধ?

গেটে কলিং বেল বাজছে। পাপিয়া নিস্পৃহের মত জানলার কাছে বসে আছে। আমি উঠে গিয়ে গেটের ছোট দরজাটা খুলে দিই। পিল পিল করে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। আমরা এদের অনেকেরই মুখ চিনি, নাম জানি। পাপিয়া দুই ঈদে ও শবে বরাতে এদের যত্ন করে রান্না করে খাওয়ায়। আজ শবে বরাত ছিল। কিন্তু সে কিছুই রান্না করেনি। আমি ওদেরকে বলি, ‘তোদের আজ হাজির বিরিয়ানি খাওয়াব। আমার সাথে চারজন গাড়িতে যাবি। বাকিরা এখানে বসে থাকবি। কে কে যাবি আমার সাথে?’

তারা সবাই হাত তোলে। ‘সবাই তো গাড়িতে আটবে না,’ আমি বলি, ‘দাঁড়া, এক কাজ করি। লটারি করা যাক।‘ আমি তাদের মাথা গুণে দেখি। ষোল জন। আমি রুমে ঢুকে কাগজ কেটে ষোল টুকরো করে চারটিতে হাজির বিরিয়ানি লিখে একটা কৌটোয় রাখি। বাইরে এসে ওদেরকে কৌটো থেকে একটা করে কাগজের টুকরো নিতে বলি। আমি শফিক, করিম, টুম্পা আর মিলনকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমি পাপিয়াকে বলি, ‘তুমি কি ওদের সাথে একটু মাস্টারি করতে পারবে?’ তাকে খুব লজ্জিত দেখায়। মৃদু কণ্ঠে বলে, ‘আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আজ  শবে বরাত।‘

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আমি পাপিয়াকে বলি, ‘তুমি কি পরশু একটু ছুটি নিতে পারবে?’

— কেন?

— কারণটা পরে বলি। আমি একটু গ্রামের বাড়িতে যাব। তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাই।

— আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।

— জানি। শুধু আমার জন্য যেও।

পাপিয়াকে নিয়ে সরাসরি আমি গোরস্থানে যাই। মৃত্যু নিয়ে যে বাচ্চার জন্ম হয় তার কি কোন জন্মদিন হয়! মরে না গেলে আজ তার বয়স হত এক বছর। বাচ্চাটার কবরে গোলাপের তিনটে চারা লাগিয়েছিলাম। সেগুলোতে ফুল ফুটেছে। কামিনী ফুলের গাছটাও ধেই ধেই করে বেড়ে উঠছে। আমাদের বাচ্চাটার কোনো নাম নেই। আমরা অনেক ক’টি নাম নিয়ে ভেবেছিলাম। কিন্তু কোনোটাকেই চূড়ান্ত করা হয় নাই। যে বাচ্চা মৃত্যু নিয়ে জন্মায় তাদের কি কোনো নাম থাকতে নেই! আমি পাপিয়ার হাত আলতো করে ধরে বলি, ‘ওর একটা নাম রাখা দরকার।‘

পাপিয়া ডুকরে কেঁদে ওঠে। ঢাকায় ফিরে ওকে নিয়ে আমি এতিমখানায় যাই। ওদের সঙ্গে খাই। আমি বুঝতে পারি, পাপিয়ার এ সব ভাল লাগছে।

বাসা থেকে লোকটাকে দেয়াল টপকাতে দেখার পর থেকে আমরা লাইট জ্বালিয়ে ঘুমোই। অবশ্য ও কতটুকু ঘুমোয় বলা কঠিন। আলোতে আমার ঘুমোতে সমস্যা হলেও আমি তাকে বাঁধা দিইনি। কিন্তু আজ আমি লাইট অফ করে দিই। সে হয়ত জানে, আমার মনের মধ্যে কী চলছে। আমি তার কাছে যাই, ঘনিষ্ঠ হই। প্রথমে একটু অপ্রস্তুত লাগে। মনে হয়, আমরা যেন এই প্রথম মিলিত হতে যাচ্ছি। আমি মনে মনে প্রস্তুত হয়ে ছিলাম, সে হয়ত আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেবে। কিন্তু সে তা করে না। কিন্তু আমি তার শরীরের আড়ষ্ঠতা অনুভব করি। সে কিছু বলতে চায়। আমি তার ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বাঁধা দিই। আস্তে আস্তে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলি, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।‘ আধো অন্ধকারে আমি তার জলপূর্ণ বড় বড় চোখ দুটি দেখি। আমি জানি, সে মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে আছে। আমি আবারও বলি, ‘সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।‘ আমি আমার শরীরে তার হৃৎকম্পন অনুভব করি। আমি নিজেও নিজের মধ্যে শঙ্কা অনুভব করি। আর বিড় বিড় করে বলি, ‘সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।‘                   

Top

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shuja
Shuja
1 year ago

The story starts slow but eventually dives deep into human emotions. A nice story from the writer that readers will like.


Copyright © 2023. All Rights Reserved.