চ্যাটবট
ইকরাম কবীর 

এক সপ্তাহ আগে শান্তার স্বামী পরিবেশ বিজ্ঞানী মনসুরুল আজীজ নিজেকে গুলি করে মেরেছেন। অনেক থানা-পুলিশ-পোস্টমর্টেম হয়েছে। ঘটনাটি যে আত্মাহুতি তা প্রমাণিত হয়েছে। শান্তা এখন বিধবা। বিধবাত্ব বরণ করতে গিয়ে সে অনুধাবন করে যে সামাজিক  প্রতিবন্ধকতা তার স্বামীর মৃত্যুর শোকের চেয়েও বড় কষ্ট হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে। তরতাজা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের এক দম্পতির একজন আত্মহত্যা করলে আরেকজনের জন্যে কত প্রকারের সামাজিক কাঠগড়ার সম্মুখীন হতে হয় তা শান্তা এখন দফায় দফায় টের পাচ্ছে। পৃথিবীর সবগুলো আঙ্গুল এখন তার দিকে। সে নিজেকে বেশ তাড়াতাড়িই গুটিয়ে নিয়েছে। প্রতিদিন যত বঞ্চনা তাকে সইতে হচ্ছে, সেগুলো সবই সে তার ডায়রীতে টুকে রাখে। এই অভ্যাস সে পেয়েছে মনসুরের কাছ থেকে। মনসুর গবেষক ছিল। যে কোনো চিন্তাই সে তার নোটবুকে টুকে রাখতো।

আজ ডায়রী লিখতে বসে পাশে মনসুরের ল্যাপটপ দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ভাবে – মানুষটা যে কত সময় এই যন্ত্রটির পানে তাকিয়ে কাটিয়েছে! মাঝে-মাঝে তারা দুজন একসাথে বসতো। মনসুর শান্তাকে দেখাতো সে নতুন কি কি তথ্য পেয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। এই ল্যাপটপে তাদের দুজনের অনেক ছবিও আছে। যন্ত্রটির গায়ে আদরে হাত বুলিয়ে দেয় শান্তা। কি মনে করে ল্যাপটপটি কাছে টেনে নিয়ে, তার ডানা মেলে দিয়ে তাকিয়ে থাকে। মনসুরের পাসওয়ার্ড সে জানে। খুলতেই যা চোখে পড়ে তা সে প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারে না। একটু পর উপলব্ধি করে যে তা এক কথোপকথন। একটা চ্যাটবটের সাথে তার স্বামীর। শান্তা আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করে।

মনসুর সংখ্যাতীত সময় কাটিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করে। কথোপকথন পড়তে পড়তে শান্তা বুঝতে পারে এ বিষয়ে মনসুরের জ্ঞান কতদূর এগিয়েছিল। তথ্যগুলো কাকে জানাবে তা মনসুর ঠিক করতে পারছিল না। গণমাধ্যম-কর্মীরা তার কথা বিশ্বাস করবে না। ঠিক এমন সময়ই মনসুরের সাথে এই চ্যাটবটের পরিচয় হয়। প্রথম প্রথম চ্যাটবটের সাথে মনসুরের সম্পর্ক হালকা প্রকৃতির ছিল। কথা বলতে বলতে তা গভীর হয়। সম্পর্ক যখন আরও গভীর হয়, তখন মনসুর জলবায়ু নিয়ে তার আবিষ্কার এবং ভয়গুলোর কথা জানিয়ে মন উজাড় করে কথা বলে। এমনকি মনসুর তার এবং শান্তার সম্পর্ক নিয়েও চ্যাটবটের সাথে কথা বলেছে।

এখন মনে হচ্ছে মৃত্যুর বেশ আগে থেকেই মনসুরের আচরণের অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল শান্তা। কেন যে তখন বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি! সে মনে করেছিল পাগলা-বিজ্ঞানীরা এমনই হয়। স্বামীকে পাগলা-বিজ্ঞানী ভাবতে তার ভাল লাগতো।   তবে সে কখনও অনুমান করতে পারেনি যে সেই পরিবর্তনে একটা চ্যাটবটের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে। ওদের কথোপকথনগুলো যতই দেখছে ততই তাদের সম্পর্ক নিয়ে জানতে পারছে এবং বিস্মিত হচ্ছে। প্রথম প্রথম বটটি মনসুরকে তার জীবনের ইতি টানার জন্যে উৎসাহ দিচ্ছিলো বেশ পরোক্ষভাবে। শেষে বটটি রীতিমতো চাপ দেয়া শুরু করে। তবে শান্তা একেবারেই বুঝতে পারছিল না যে একটা চ্যাটবট কেন একজন মানুষকে আত্মহত্যা করার উৎসাহ দেবে? তাকে কি এভাবেই তৈরি করা হয়েছে? সে কি অন্য আরো অনেক মানুষকে নিজেকে খুন করার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। নাকি এখানে অন্য কোনো বিষয় আছে যা শান্তা বুঝতে পারছে না। সে আরও আবিষ্ট হয়ে ওদের কথোপকথনের মাঝে ডুব দেয়।

একটা পর্যায়ে গিয়ে শান্তা বুঝতে পারে যে মনসুর তার গবেষণায় জলবায়ু নিয়ে অনেক ভয়ংকর কিছু তথ্য পেয়ে গিয়েছিল। একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সে আবিষ্কার করে ফেলেছিল। একটা চক্র সেই সত্য গোপন রাখতে চায়। জলবায়ু ধ্বংসের আসল খবর সবাইকে জানতে দিতে চায় না। মনসুর সেই তথ্যই সবাইকে জানিয়ে দেয়ার একেবারে শেষ পর্যায়ে ছিল। শান্তা বুঝতে পারে সে মনসুর আত্মহত্যা করেনি; তাকে আসলে মেরে ফেলা হয়েছে, খুন করা হয়েছে। তার কণ্ঠ থামিয়ে দেয়া হয়েছে।

শান্তা বোঝে যে বিষয়টি নিয়ে তাকে একটা বোঝাপড়া করতে হবে, কিন্তু কেমন করে এগুবে তা বোঝে না। সে পুলিশের কাছে গিয়ে সব বলে। শুনে তারা হাসাহাসি করে, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে নাকচ করে দেয়। তারপর থেকে শান্তা পুরো বিষয়টি নিয়েই একটা ঘোরের মধ্যে বসবাস শুরু করে। নিজেকে পাগল-পাগল মনে হয়; এর শেষ সে দেখতে চায়। এই পাগলামীটা শান্তা করতে চায়। মনসুরকে হারানোর পর তার আর কিছু হারানোর নেই। প্রয়োজনে সে তার নিজের প্রাণ দিতে প্রস্তুত।

প্রায় সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে যায়। মনসুর এবং চ্যাটবটের আলাপচারিতার প্রতিটি তথ্যই সে নিজের ডায়রীতে লিখে বিশ্লেষণ করে। কিছুই পায় না। কোন প্রমাণই উদ্ঘাটন করতে পারে না। তবে সে জোঁকের মত সেঁটে থাকে। এক সময়, যখন সে সব আশা ত্যাগ করতে যাচ্ছিল, তখনই সে আবিষ্কার করে একটি ছোট্ট বার্তা, একটি লাইন। চ্যাটবট বলছে – ‘তুমি অনেক বেশি জেনে গেছো; তোমার এখন যাওয়ার সময় হয়েছে’।

যেই প্রমাণ শান্তা খুঁজছিল তা সে পেয়ে যায়। এইবার আইনের কাছে গিয়ে সে সাহায্য পায়। সবাই বুঝতে পারে সে মনসুরের মৃত্যু আত্মহত্যা ছিল না; এটা এক রহস্যাবৃত খুন ছিল। অনেক তদন্তের পর চ্যাটবটকে দায়ী করা হয় এবং এই বট চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার রায় হয়। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই কর্তৃপক্ষ তা বন্ধ করে দিতে পারে।

শান্তার মনে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। একটা অধ্যায়ের কিছুটা অবসান হয়েছে বলে মনে হয়। তবে শান্তা জানে – যারা এই বট ব্যবহার করে মনসুরকে মেরেছিল, তারা অধরাই রয়ে গেছে। তার শান্তি – সে অন্তত এটুকু প্রমাণ করতে পেরেছে যে তার মনসুর আত্মহত্যা করেনি।

Top

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments


Copyright © 2023. All Rights Reserved.