চিঠি
কাজী মঈনুল হক
সে লিখেছিল,
“আমার অনেকগুলো দিন তোমার কাছে গচ্ছিত থেকে যাবে। তোমার অনেকগুলো
দিন আমার কাছে সযত্নে থেকে যাবে। আমাদের অনেকগুলো দিন সবার আড়ালে
আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।“
তাকে রাখা ‘সঞ্চয়িতা’র পাতাগুলো উইপোকায় কাটতে কাটতে ‘যথাস্থান’ পর্যন্ত
পৌঁছে গিয়েছিল — ঠিক যেখানটাতে চিঠিটা রাখা ছিল।
আমি যদি বাড়িতে আর ক’টা দিন পরে আসতাম
কিংবা আমি যদি কয়েকটা দিন পরে ‘সঞ্চয়িতা’র ধুলো ঝাড়তে
মনস্ত করতাম, তবে এই বইয়ের অর্ধ সংখ্যক কবিতার মতো
এই চিঠিটাও ঝুরঝুরে মৃত্তিকা হয়ে যেত!
রবির গোটা বইটা যদি উইপোকায় হজম করেও ফেলত
তাতে আমার কোনো দুঃখবোধ থাকত না;
কারণ এই বইটার হাজার হাজার কপি ধর্মগ্রন্থের মতো
আরো কয়েক শতাব্দী ধরে হাজার হাজার বাঙালির কাছে থেকে যাবে।
কিন্তু এই চিঠিটা না পেলে নিজের অজান্তে আমার বিষম ক্ষতি হয়ে যেতঃ
সারা দুনিয়ায় এই চিঠির একটিমাত্র কপি
যা কেবল আমার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল!
যদিও এই চিঠিটা না পেলেও
আমার অনেকগুলো দিন তার কাছে গচ্ছিত থেকে যেত,
তার অনেকগুলো দিন আমার কাছে গচ্ছিত থেকে যেত,
আমাদের অনেকগুলো দিন আমাদের কাছে গচ্ছিত থেকে যেত।
তবু এই চিঠিটার অক্ষরে অক্ষরে যেমন আমার নিঃস্বতা লেপ্টে ছিল
তেমনি অলৌকিক প্রাপ্তির সুগন্ধও ছিল।
তবু জানি, বাসা বদলাতে বদলাতে
এক ট্রেন ছেড়ে অন্য ট্রেনে চড়ে বসতে বসতে
কিংবা এক বিমান থেকে অন্য বিমানে উড়তে উড়তে
এই চিঠিটাও একদিন হারিয়ে যাবে। তবু
আমার অনেকগুলো দিন তার কাছে গচ্ছিত থেকে যাবে,
তার অনেকগুলো দিন আমার কাছে গচ্ছিত থেকে যাবে
নীরবে নিভৃতে সবার আড়ালে।
একদিন বৈশ্বিক উষ্ণতায় অনেক বরফ গলে যাবে,
অনেক আলোকিত জমি নোনা জলে ডুবে যাবে
আর আমাদের নিউরনে উইপোকা বাঁধবে বাসা;
তখন তুমি ওই ‘সঞ্চয়িতা’র মতো ঝুরঝুরে হয়ে যাবে
আমিও একটু একটু করে মৃত্তিকা হয়ে যাব।
তবু আমার অনেকগুলো দিন তোমার কাছে গচ্ছিত থেকে যাবে,
তোমারও অনেকগুলো দিন আমার কাছে গচ্ছিত থেকে যাবে,
আমাদের অনেকগুলো দিন আমাদের কাছে গচ্ছিত থেকে যাবে
নীরবে নিভৃতে সবার আড়ালে।