উপহার
সুজয় দত্ত

আজকাল আর জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে না মেয়েটা। সোজা ঝাঁটা আর ঝুলঝাড়ু হাতে ঘরে ঢুকেই পাখাটা বন্ধ করে আলোটা জ্বেলে দেয়। তারপর খাটের তলা, টেবিল-চেয়ারের তলা, আলমারির তলা — সর্বত্র সপাসপ ঝাঁটা চালাতে থাকে দ্রুতহাতে, যেন ঘোড়ায় জিন দেওয়া আছে। দরজা-জানলার পাল্লার পেছনে, দেয়ালের কোণে, পাখার ব্লেডের গায়ে ঝুল ঝাড়ে লম্বা ডাঁটিঅলা পালকের ঝাড়ুটা দিয়ে। ডাঁটির অন্যপ্রান্তটা ইজিচেয়ারে খবরের কাগজ বা বই হাতে আধশোয়া সুধাময়কে খোঁচা দিচ্ছে কিনা বা ঝুলগুলো খসে খসে তাঁর জলের গ্লাসে পড়ছে কিনা — সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। মাঝে মাঝে উনি “অ্যাই মালতী! কী হচ্ছে কী?” বলে মৃদু ধমক দিলে তখন টনক নড়ে, ঝাঁটাঝাঁড়ু সামলে “কী আবার? কাজের সময় কাজ করবনি?” বলে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায়। পাখাটাও চালিয়ে দিয়ে যায়না, মনে করিয়ে না দিলে। বৌদিমণির আস্কারা পেয়ে পেয়ে আজ এই অবস্থা মেয়েটার — ভাবেন সুধাময়। তাঁর অবসরজীবন শুরু হওয়ার আগে অবধি এ-বাড়ীতে যারা কাজ করেছে, তাদের সাহস হতো এমন আচরণের? চিরকাল এই পুরোনো আমলের তিন-কামরার ফ্ল্যাটবাড়ীতে সব ব্যাপারে তাঁর কথাই ছিল শেষ কথা। সেসব দিনগুলোকে এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। গত বারো বছরে সবকিছু কেমন বদলে গেল — ভেবে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।
বদলের শুরুটা অবশ্য অবসরের সঙ্গে সঙ্গে হয়নি। পঁয়ষট্টিতে পা দেওয়ার সাত দিন বাদে যখন বিরাট সংবর্ধনা আর প্রচুর উপহার-টুপহার পেয়ে শেষবার অফিস থেকে বাড়ী ফিরলেন, সুরঞ্জনা তখনও বেঁচে। দিব্যি স্বামী-ছেলে-বৌমা-নাতনী নিয়ে সংসার করছেন, সবদিকে তীক্ষ্ণ নজর। হেঁশেল সামলানো, ঠাকুর পুজো, সুধাময়ের যত্নআত্তি, ছেলে-বৌ কাজে বেরিয়ে গেলে নাতনীকে আগলে রাখা — কোনোকিছুতেই খামতি নেই। তার পরের তিন বছরে কী যে হয়ে গেল! সুরঞ্জনার যখন বেশ কিছুদিন ধরে খিদে হচ্ছিল না, সারাক্ষণ পেট ভারভার, এমনকী পালপার্বণে উপোস-টুপোসের পরেও কোনোকিছু মুখে দিতে রুচি নেই, সেটাকে হালকভাবেই নিয়েছিল বাড়ীর সবাই। বয়স হলে মানুষের খাওয়াদাওয়ায় আসক্তি এমনিতেই কমে যায়। ভুল ভাঙল যেদিন অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হল পেটে। কোনো ওষুধেই কমে না। পাড়ার ডাক্তার নানাভাবে চেষ্টাচরিত্র করে ব্যর্থ হয়ে শেষমেষ স্পেশালিস্টের কাছে যখন পাঠালেন, অনেক দেরী হয়ে গেছে। মারণব্যাধি ছড়িয়ে গেছে অগ্ন্যাশয় থেকে যকৃৎ আর ফুসফুসে। এই অমোঘ মৃত্যুপরোয়ানার কথা জানার পরও হাল ছাড়েননি সুধাময়। প্রায় চল্লিশ বছরের জীবনসঙ্গিনীকে কর্কটরোগের নিষ্ঠুর থাবা থেকে ছিনিয়ে আনতে কম লড়াই করেননি। ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালের সেই দুঃসহ দিনগুলো আজও মাঝে মাঝে ফিরে আসে তাঁর দুঃস্বপ্নে।
তাঁর আদরের রঞ্জা যেদিন চলে গেলেন, সেটা ছিল সুধাময়ের জন্মদিন। আটষট্টি পূর্ণ হল। যতদিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েননি, ঘটা করে না হলেও স্বামীর জন্মদিনটা প্রতিবছর পালন করতেন সুরঞ্জনা। নিজের হাতে পায়েস করে, পাঁচরকম ভাজা দিয়ে থালা সাজিয়ে, খাওয়ার সময় প্রদীপ জ্বেলে, শাঁখ বাজিয়ে। জীবনের শেষ দুবছর বিছানায় শুয়ে শুয়েও বৌমাকে নির্দেশ দিয়ে করিয়েছেন ওসব। শাশুড়ী মারা যাওয়ার পরের বছর ঐদিন তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয়েছিল বাড়ীতে, তারপর থেকে রূপছন্দাও আর শ্বশুরের জন্মদিন পালনের কথা তোলেনি, আর তুললেও উনি রাজী হতেন না। নীরবে ইজিচেয়ারে শুয়ে টাটকা রজনীগন্ধার মালা পরানো ছবির ফ্রেমটার দিকে সারাদিন তাকিয়ে স্মৃতিরোমন্থনেই বরং অনেক বেশী শান্তি। এই একটা মৃত্যু যে তাঁকে কতখানি একা করে দেবে, প্রথমদিকে বুঝতে পারেননি সুধাময়। বিশেষতঃ, তার বছর দেড়েকের মধ্যেই একটা ফুটফুটে নাতি হল যখন, তাকে নিয়েই কেটে যেত দিন। নাতনীও ছোটবেলায় দাদুর খুব ন্যাওটা ছিল।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল জীবনের রং। ছেলে তার কিছুদিনের মধ্যেই ডেপুটি ডিরেক্টর হওয়ায় কাজের চাপ বেড়ে গেল প্রচন্ড। রাতটুকুই শুধু থাকে বাড়ীতে, ছুটির দিনেও কখনো কখনো অফিসে দৌড়োতে হয়। আর রূপছন্দা চলনে বলনে মানসিকতায় আধুনিকা। গৃহবধূ হয়ে বাড়ী বসে থাকার মেয়ে কোনোদিনই নয়। নাতির জন্মের সময় শাশুড়ীর অনুপস্থিতির দরুণ চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল বৌমা, কিন্তু নাতি মন্টেসরির আপার ডিভিশনে উঠতেই চেষ্টাচরিত্র করে আবার একটা জুটিয়ে নিল। মাইনে যেমন ভাল, কাজের চাপও তার সঙ্গে মানানসই। আপত্তি করেননি সুধাময়। মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনোকিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে বরাবরই তাঁর অনীহা। তাছাড়া বাধা দিতে গেলে সেই চাপা অসন্তোষ যে পারিবারিক অশান্তির রূপ নিতে পারে, তা এই বয়সে তাঁর একেবারেই অভিপ্রেত নয়। ছেলে-বৌকে বলেছিলেন, তিনি তো বাড়ীতেই থাকছেন সারাদিন, তাই দুপুরে অনতিদূরের মন্টেসরি স্কুল থেকে নাতিকে নিয়ে আসা আর বিকেলে নাতনীর স্কুলের গাড়ী তাকে নামিয়ে দিয়ে গেলে জলখাবার-টাবার খেতে দেওয়া — এগুলো ঠিকঠাক সামলে দিতে পারবেন। আর সেইসময় নাতনী নীচু ক্লাসে পড়ত, তার হাজার রকম এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটি বা টিউটরের কাছে কোচিং নিতে যাওয়ার ঝামেলা ছিলনা। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে বাড়ীতেই থাকত, দাদুই দরকারমতো দেখিয়ে দিতেন পড়াশোনা। এখন সে ক্লাস টেনে, দুদিন বাদে আই সি এস ই দেবে, পড়াশোনা আর অ্যাক্টিভিটির চাপে নাওয়াখাওয়ার সময় নেই। স্কুল, বন্ধুবান্ধব, টিউশন — এসবের বাইরে তার যেটুকু সময়, তাও বেশিরভাগটাই যায় স্মার্টফোন নামক এক নতুন আপদের পিছনে। সারাক্ষণ হয় পুটুর পুটুর করে ফোন টিপছে, নয়তো কানে সাদা মটরদানার মতো ইয়ারফোন লাগিয়ে বসে আছে — ডাকলে সাড়া পাওয়া যায়না। ভাবলে অবাক লাগে, এই মেয়েই একদিন বায়না করেছে সে দাদু-দিদা ছাড়া আর কারো সঙ্গে শোবেনা, শুধু দাদুর সঙ্গেই লুডো আর চেকার্স খেলবে, শুধু দিদার কাছেই সাজগোজ করবে। সত্যি, সময় যে নিঃশব্দে কতকিছু ছিনিয়ে নেয় –।
বাড়ীতে নাতিই একমাত্র যার সঙ্গে এই কয়েক বছর আগে অবধিও দিনে অনেকটা সময় কাটত তাঁর। সত্যি বলতে কী, সুধাময় ছিলেন বলেই ছেলেটার ছোট থেকে কার্টুন চ্যানেল বা ভিডিওগেমের নেশা হয়নি। দাদুর কাছে গল্প শুনে, দাদুর সঙ্গে বই পড়ে, দাদুর হাত ধরে পার্কে খেলতে গিয়ে কেটেছে তার শিশুবেলা। কিন্তু যেই সে ক্লাস সিক্সে উঠল, পুরোনো প্রাইমারী স্কুলটা ছেড়ে আরও বড় স্কুলে ভর্তি হল, অমনি দ্রুত বদলে গেল সেসব। সেন্ট্রাল বোর্ডের সেই স্কুলে এই বয়স থেকেই যা পড়ার চাপ আর যেরকম তীব্র প্রতিযোগিতার ইঁদুর-দৌড়, টিঁকে থাকতে হলে তার শৈশবকে ‘গুডবাই’ বলা ছাড়া গতি নেই। আর শুভঙ্কর-রূপছন্দার, মানে ওর বাবা-মার, ছেলেকে নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষাটা দেখা যাচ্ছে মেয়ের ক্যারিয়ার নিয়ে যা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী। তাই এই বয়স থেকেই সে ম্যাথস অলিম্পিয়াডের জন্য বিশেষ কোচিংয়ে যায়। সায়েন্সের জন্য আলাদা টিউটর তো আছেই। তাহলে ওদের ভাষায় যাকে বলে ‘গ্রান্ডপেরেন্টের’ সঙ্গে ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটানো — তার কী হবে? সরি, ওটা তো আই সি এস ই-র সিলেবাসে নেই। কলেজের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতেও ও-নিয়ে প্রশ্ন করে কি? আসলে এই সমাজ, এই দুনিয়া — কোথাও ওই জিনিসটার জন্য কোনো ‘ইনসেনটিভ’ নেই।
অতএব সুধাময় এখন একা। বাইরে থেকে দেখে বুঝবেনা লোকে। মহানগরের এই জমাটি এলাকায় তিন-কামরার ফ্ল্যাটে পাঁচজনের ব্যস্ত সংসার। সেখানে আবার একা হওয়া যায় নাকি? যায়, ভীষণভাবে যায়। কদিন আগেই এক সোমবার রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তিনি মনে মনে হিসেব করছিলেন গত আঠেরো ঘন্টায় বাড়ীর অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে তাঁর কটা কথা হয়েছে। অবাক হয়ে দেখলেন, আঠেরোবারও বাক্যবিনিময় হয়নি। এই তো, সকালবেলা উঠতে না উঠতেই মালতীর “বৌদিমণি বিছানাটা ঝাড়তি বলতিচে, এট্টু ইজিচিয়ারে গিয়ে বসতি হবে”, তারপর বৌমার “আজ চায়ে চিনি দিয়ে ফেলেছিলাম, তাই সকালে আর আপনাকে দিইনি। এই নিন, নতুন করে করেছি।”, তারপর সদ্য ঘুম থেকে ওঠা গলায় তোয়ালে মুখে টুথব্রাশ ছেলের “কাল কী বলছিলে রাত্তিরবেলা, কোন ওষুধটা ফুরিয়েছে? দেখি, তার অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলটা দাও তো, এখনই ঢুকিয়ে নিই ব্যাগে, পরে ভুলে যাব –“। তারপর অনেকক্ষণের বিরতি — সেই সত্তরের দশকে কলকাতায় নতুন আসা সাদাকালো টিভিতে মাঝে মাঝে টেলিকাস্ট আটকে গেলে যেমন সাময়িক নীরবতা নেমে আসত, খানিকটা সেইরকম, যদিও এক্ষেত্রে “রুকাবট কে লিয়ে খেদ হ্যায়” বলার কেউ নেই। ইতিমধ্যে অবশ্য বাড়ীতে রোজকার নাটক যা যা চলার সবই চলছে — বাথরুমের দখল নিয়ে ভাইবোনের কাড়াকাড়ি, মালতীকে বৌমার দফায় দফায় বকুনি, অফিসের কার সঙ্গে যেন ছেলের লম্বা ফোনালাপ, খবরের কাগজঅলার বেল টিপে কাগজ দিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি। কিন্তু সবই তাঁর ঘরের পর্দাঢাকা দরজার বাইরে। অবশেষে পর্দা ফাঁক করে “চলি, আজ ফিরতে রাত হবে একটু, নিউটাউন মার্কেট ঘুরে আসব, তোমার চ্যবনপ্রাশ টাও নিয়ে আসব” আর “বাবা, আপনার খাবারটা আজ মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ভেতরেই রেখে গেলাম, টেবিলে রাখলে পিঁপড়ে হয় বলেন” বলে ছেলে-বৌমা কাজে বেরিয়ে যাবার পর মালতীর “গেলাম গো দাদু, দোরে চাবি দাও” দিয়ে শেষ হল তাঁর সকালের কোটা। তারপর টানা ছ’ঘন্টা বাড়ীতে আর জনপ্রাণী নেই। পড়ন্ত দুপুরে মুহুর্মুহু কলিং বেলে তাঁর তন্দ্রা ভাঙিয়ে বাড়ী ঢুকেই নাতি বিছানায় ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে টিভির সামনে বসে পড়ল ক্রিকেট দেখতে। “কিরে, খাবারটা গরম করে দিই? খেতে খেতে দ্যাখ?” এর উত্তরে শুধু বিরক্ত গলায় শুনলেন “না না পরে পরে — জাস্ট সেভেন মোর ওভারস রিমেইনিং”। আধঘন্টা বাদে নাতনীর ফেরার পালা। বেল শুনে দরজা খুলে দেখেন যথারীতি সে ডানহাতে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে বাঁহাতে ফোন কানে করে দাঁড়িয়ে আছে। “কিরে, আজ একটু মুখহাত ধুয়ে টিফিনটা খাওয়ার সময় আছে তো, নাকি আবার এক্ষুণি কোনো বন্ধু-টন্ধু এসে হাজির হবে?” বলাতে তার অন্যমনস্ক জবাব, “দ্যাট আই উইল টেল ইউ টুমরো”।
“মানে? এখন খাবি কিনা সেটা কালকে বলবি?”
“দুত্তেরি, ওটা তোমাকে বলিনি। দেখছো না ফোনে কথা বলছি? ডোন্ট ওরি, আই উইল ওয়ার্ম ইট আপ মাইসেলফ”। বলে সে বাথরুমে ঢোকে। আর সুধাময় গিয়ে বসেন বারান্দার বেতের চেয়ারটায়, হাতে মোটা শরদিন্দু অমনিবাস। কারণ উনি জানেন এর পরের বাক্যালাপ হতে হতে আরো ঘন্টা দুই। সেদিন অবশ্য দুঘন্টার বদলে তিনঘন্টা হল, কারণ বৌমা বাইপাসের বিরাট জ্যামে আটকে গিয়ে ফিরল বেশ দেরী করে। এসেই ছেলেকে টিউটরের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে শুধু একটা প্লেটে দুটো গরম সিঙাড়া হাতে বারান্দায় শ্বশুরকে গিয়ে বলার সময় পেল, “এই নিন। গরম আছে এখনও। চা এখন বসাব, না জিৎকে কোচিংয়ে দিয়ে এসে?” বেচারী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আবার এক্ষুণি বেরোচ্ছে দেখে উনি জানালেন চায়ের কোনো দরকার নেই। অতঃপর বাজার-টাজার হাতে ছেলে বাড়ী ঢোকা অবধি আবার নৈঃশব্দ্য, কারণ নাতনী দরজা বন্ধ করে পড়তে বসেছে আর বাকীরা বাড়ীর বাইরে। সাড়ে নটা নাগাদ ছেলে ফেরার সময় অবশ্য টের পাননি তিনি, ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়তে পড়তে কখন যেন চোখে ঘুম লেগে গেছিল। তাই তাঁকে আর রাতের খাওয়ার আগে ডাকেনি কেউ। রাতে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার সময় প্রতিদিনই সেখানকার টিভিতে নাতি বা নাতনীর পছন্দের চ্যানেলে কোনো “মাস্ট সী” প্রোগ্রাম চলে, নাহলে বৌমার পছন্দের কোনো সিরিয়াল। তাই কথাবার্তা বিশেষ হয়না, হলেও সেটা জিৎ আর জিনিয়ার হাহা-হিহি, ওয়াও বা ও মাই গড। খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকে গেলে বিছানায় আশ্রয় নেওয়ার আগে একবার শুধু শুনলেন ছেলে এসে টেবিলে ওষুধ আর চ্যবনপ্রাশ রাখতে রাখতে বলছে “এবার বড় বোতল এনেছি, অনেকদিন চলবে তোমার”। ব্যস, দিন শেষ।
এভাবেই তাহলে কাটবে জীবনের বাকী বছরগুলো? এরকম অনিবার্য, প্রতিকারহীন মৌনব্রতে? নাহয় কাটলই — কী আসে যায় তাতে? সামনের মাসে আশিতে পা দিচ্ছেন। আর তো বেশী বাকিও নেই। এসব চিন্তা মাথায় এলে রাতে ঘুম আসতে চায়না সুধাময়ের। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকেন। মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁর এ দশা দেখে সুরঞ্জনা ওপর থেকে মিটিমিটি হাসছেন। স্ত্রীকে সারাজীবন বলে এসেছেন “বড্ডো বেশী কথা বল তুমি। বলবে কম, ভাববে বেশী”। আর আজ এমনই পরিহাস — নিজেই নৈঃশব্দ্যের কারাগারে বন্দী। তাঁর বয়সী অন্য অনেকের কাছে এই সমস্যার একটা সহজ সমাধানসূত্র আছে। তার নাম টিভি। চব্বিশ ঘন্টা সেখানে সিরিয়াল, গানবাজনা, ট্যালেন্ট শো, রিয়ালিটি শো — বিনোদনের ফোয়ারা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সুধাময় কর্মজীবনেও খবর আর খেলা ছাড়া টিভির কাছে ঘেঁষতেন না বড় একটা, অবসরজীবনেও সেই অভ্যেসটা তৈরী করতে পারেননি কিছুতেই। তাঁর সারাক্ষণের সঙ্গী হল বই। তাঁর বাবার আমলের কাঠের আলমারিটায় পুরোনো ক্লাসিক্স আর রচনাসমগ্র কম নেই। ভাগ্যিস চোখটা এখনো ভাল আছে। তবে মূল সমস্যাটা রয়েই যাচ্ছে | বই তো আর কথা বলে না।
আজও বালিশে মাথা দিয়ে খানিক উশখুশ করার পর এক গ্লাস জল খাবেন বলে খাটের পাশের টেবিলটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখেন জলের জগটা নেই। তার মানে ওটা ডাইনিং টেবিলেই পড়ে আছে, আনতে ভুলে গেছেন। আস্তে আস্তে উঠে দরজার পর্দা ফাঁক করে দেখলেন ডাইনিং রুমে তখনও আলো জ্বলছে, দুই ভাই-বোন দুটো চেয়ার দখল করে বসে কীসব গুজগুজ ফুসফুস করছে। ওঁর দিকে পেছন ফেরা, তাই দেখতে পায়নি। একটু অবাক হলেন সুধাময়। মাঝরাত হতে চলল, এখন কী এত জরুরী শলাপরামর্শ? অন্যদিন তো খাওয়া শেষ হতে না হতেই একজন বিছানায় স্মার্টফোন কানে আর অন্যজন বাবা-মার শোবার ঘরের টিভিটায় স্পোর্টস চ্যানেলে মগ্ন। কৌতূহলে কান পাতেন তিনি। এরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে, তাতে মাতৃভাষার ‘ম’-ও থাকেনা। কী আর করা যাবে — ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে তো আজকাল বাংলার দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদাটাও জোটে না অনেকসময়। আজ কয়েকটা শব্দ কানে আসছে বারবার — ইনভিটেশন, সারপ্রাইজ, এইট্টিয়েথ, দাদু, গিফট। ক্রমশঃ ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে আসে তাঁর মাথায়। আচ্ছা, এই ব্যাপার! তাঁর আসন্ন আশিতম জন্মদিনে সারপ্রাইজ পার্টির ষড়যন্ত্র হচ্ছে! নিঃশব্দে এসে আবার শুয়ে পড়েন তিনি। মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে দুটো কথা — “গিফট” আর “লেটস আস্ক হিম হোয়াট হি ওয়ান্টস”। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। একসময় চোখে নেমে আসে ঘুম।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে টিভির সামনে বসার আগে নাতি বলল, “দাদু, আই হ্যাভ এ কোয়েশ্চেন ফর ইউ”।
“কী? ইংলিশ গ্রামার-টামারের কোনোকিছু?”
“না না, সামথিং টোটালি ডিফারেন্ট।”
“আচ্ছা, শুনব’খন। আগে খেয়ে নে। খাবারটা গরম করে দিই?” সুধাময় মনে মনে ভালই আন্দাজ করতে পারছেন কী বলবে ও, কিন্তু মুখে নির্বিকার রইলেন। ওর খাওয়া শেষ হবার আগেই বাড়ী ঢুকল দিদি। কাঁধ থেকে ব্যাগ আর কান থেকে ফোন নামিয়ে বাথরুমে ঢোকার আগে ভাইকে চকিত প্রশ্ন, “হ্যাভ ইউ আস্কড হিম অলরেডি?”। ভাইয়ের নেতিবাচক মাথা নাড়া দেখে “ওকে, আয়াম কামিং” বলে দড়াম করে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিল। সেখান থেকে বেরিয়েই ডাইনিং টেবিলে রাখা খাবারের প্লেটের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা পিছনের বারান্দায়, যেখানে সুধাময় বেতের চেয়ারে বসে আছেন মুখের সামনে খবরের কাগজ মেলে ধরে। ভাইও ছুটে এসেছে খাওয়া অর্ধসমাপ্ত রেখে। সে-ই প্রথম শুরু করল, “দাদু, আর ইউ লিসেনিং?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনছি। কী ব্যাপার?” বলে মুখ থেকে কাগজ নামিয়ে নাতনীকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কী রে, খেলি না? ঢাকা দিয়ে রেখে এলাম তো টেবিলে।”
“খাচ্ছি, খাচ্ছি। আগে একটা ইম্পর্টেন্ট ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা আছে। কিছুতেই ডিসাইড করতে পারছি না।” নাতনী অন্ততঃ দাদুর সঙ্গে কথোপকথনের সময় মাতৃভাষাটা বলার চেষ্টা করে।
“বটে? কী এমন ব্যাপার?”
“নেক্সট মান্থের ফার্স্ট উইকে একটা জিনিস আছে। ইটস অ্যাবাউট ইউ, সো আমরা ভাবলাম তোমাকে জিজ্ঞেস করাই বেস্ট।”
“সামনের মাসের গোড়ায়? আমার আবার কী আছে? ডাক্তার চেক-আপের কথা বলছিস?” সুধাময় খেলাতে থাকেন ওদের, বুঝতে দেন না গোড়াতেই বুঝে ফেলেছেন।
“ধ্যাৎ, ডক্টরস অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা কে বলেছে? বলছি তোমার বার্থডের কথা। দিস টাইম উই আর থিংকিং দ্যাট –” বলে একটু দম নেয় জিনিয়া।
“ওহ, তাই বল। আমার আবার জন্মদিন। জানিস না — মানুষ বুড়ো হলে তার আর জন্মদিন থাকে না?”
“স্টপ সেয়িং দ্যাট, দাদু। ইউ আর টার্নিং এইট্টি — উই হ্যাভ স্পেশ্যাল প্ল্যানস ফর ইউ। ডোন্ট ইউ ওয়ান্ট টু হিয়ার?” নাতি অধৈর্য্য হয়ে ওঠে।
“স্পেশ্যাল প্ল্যানস? বাব্বা। তা, তোমাদের প্ল্যান তোমাদের কাছেই থাক। আমায় আগে থেকে বলে দিলে সারপ্রাইজ থাকবে না তো।”
“রাইট, সব আমরাই করব, ইউ ডোন্ট নিড টু ওয়ারি। শুধু একটা সাজেশান চাইছি — কী রকম গিফট পেলে তোমার ভাল লাগবে সেটা একটু বল।আই মীন, সামথিং দ্যাট উইল বি রিয়েলি ইউসফুল টু ইউ –“, নাতনী এবার আসল কথায় আসে।
সুধাময় চুপ করে থাকেন একটুক্ষণ। তারপর মুচকি হেসে বলেন, “ঠিক আছে, শুনে নিলাম, এবার একটু ভাবি। আমার তো কোনো জিনিসেরই সেরকম অভাব নেই, তাই একটু চিন্তা করে দেখতে হবে।”
“হাউ লং? উই নিড সাম প্রিপারেশন টাইম। ইটস কামিং আপ সুন্।” নাতির গলায় অস্থিরতা।
“আচ্ছা, আমি যে এই শুক্রবার তোদের পিসীদিদুর বাড়ী যাচ্ছি কদিনের জন্য, শুনেছিস মা-বাবার কাছে? ওখানে যাবার ঠিক আগে বলে দিয়ে যাব। চিন্তা করিস না।” আশ্বাস দেন তিনি।
“ডিড নট নো দ্যাট। কতদিন থাকবে?”
“এই, দিন সাত-আট।”
“দ্যাট মিন্স ইউ আর রিটার্নিং অলমোস্ট রাইট বিফোর ইয়োর বার্থডে। হোয়াই কান্ট্ ইউ কাম ব্যাক আর্লি?” কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গীতে বলে জিৎ।
“বাহ্, ওখানেও যে আমার দুই নাতি-নাতনী আছে। টুপাই-দাদা আর টুসি দিদির কথা ভুলে যাসনি নিশ্চয়ই। ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে না মাঝে মাঝে?”
“ওকে। বাট ডোন্ট ফরগেট টু আনসার আওয়ার কোয়েশ্চেন বিফোর ইউ লীভ।” বলে চলে যায় দুজনে ডাইনিং রুমের দিকে। আবার নীরবতা নেমে আসে সুধাময়কে ঘিরে সেই একচিলতে বারান্দায়।
সেই শুক্রবার দুপুরে যখন ওলা ট্যাক্সিতে করে তাঁর ভাইরাভাই নিতে এল তাঁকে, জিৎ আর জিনিয়া তখনও স্কুলে। ওদের বাবা-মা অফিসে। সব গুছিয়ে নিয়ে সদর দরজার চাবি পাশের ফ্ল্যাটে রাখতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে তাঁর — একটা দরকারী কাজ তো করতে ভুলে গেছেন। আবার ফিরে এসে আগের রাতে লেখা একটা চিঠি ভাঁজ করে নাতনীর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখেন। তারপর নিশ্চিন্তে গাড়ীতে ওঠেন।
———————————————————-
“দিদিভাই, দাদুভাই,
চিঠিটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি তো? আরেকটু হলেই ভুলে যাচ্ছিলাম রেখে যেতে। ভাগ্যিস মনে পড়ল।” দুই ভাইবোন ওদের ঘরের বিছানায় কনুই রেখে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে চিঠিটার ওপর। কৌতূহলে চোখ বড়বড়। বাংলা পড়তে দুজনেই পারে, তবে জিনিয়া বেশী স্বচ্ছন্দ।
“সেদিন তোমরা যখন জিজ্ঞেস করলে আমার জন্মদিনে কী চাই, নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। তোমাদের বড়দাদু, মানে আমার বাবা তো খুব অবস্থাপন্ন ছিলেন না — দাঁড়াও, একটা শক্ত শব্দ লিখে ফেললাম বোধহয় — মানে উনি তো গরীব ছিলেন, তাই আমার বা তোমাদের জ্যেঠুদাদুর বা পিসীদিদুর সেভাবে কখনো জন্মদিন করা হতোনা। শুধু হয়তো তোমাদের বড়ঠাম্মা দুএকটা নতুন রকম রান্না করতেন যা আমরা খেতে ভালবাসি। কিন্তু জানো, তাও আমার প্রতিটা জন্মদিনে সবচেয়ে পছন্দের উপহারটাই পেয়েছি। কী করে? কারণ ঠিক তোমাদের মতোই আমারও তো একজন দাদু ছিলেন। তিনি উঠতে পারতেন না বিছানা থেকে, রাতদিন শুধু শুয়েই থাকতেন। তাঁর বাড়ী ছিল আমাদের কলকাতার ছোট্ট ভাড়াবাড়ীটা থেকে বেশ দূরে একটা গ্রামে। গরুর গাড়ীতে করে যেতে হত। ভাবছ গরুর গাড়ী আবার কী জিনিস? তোমরা তো দেখই নি, বোঝাব কী করে? তোমাদের গুগল আর উইকিপিডিয়া না কী যেন আছে, সেখানে হয়তো পুরোনো ইতিহাস খুঁজলে পাবে। যাইহোক, একটা সময় আমার প্রত্যেক জন্মদিনে তোমাদের বড়দাদু আর বড়ঠাম্মার সঙ্গে যেতাম সেখানে। আর তখনই জুটত সেই সেরা উপহার। কী জানো সেটা?”
চিঠির প্রথম পাতা এখানেই শেষ। পরের পাতায় যাবার আগে দুই ভাইবোন চোখ চাওয়াচাওয়ি করে একবার। দুজনের চোখেই কৌতূহল ঠিকরে বেরোচ্ছে।
“গ্রামের মাঝখানে একটা পুকুরের ধারে সেই মাটির বাড়ীটায় ঢুকেই তোমার জ্যেঠুদাদু পাড়ার ছেলেদের দলের সঙ্গে মাঠে খেলতে চলে যেত, তোমাদের বড়ঠাম্মা গিয়ে ঢুকতো রান্নাঘরে তাঁর শাশুড়ীর কাছে আর বড়দাদু দালানে বসে সকলের সঙ্গে কথাবার্তা বলত। তখন আমি আর তোমার পিসীদিদু সোজা চলে যেতাম আমার দাদুর ঘরটায়। সেখানে ওঁর খাটের পাশে মাটিতে বসে বলতাম, “ও দাদু, গল্প বল।” আর দাদু পাশ ফিরে শুয়ে সেই যে গল্প বলা শুরু করতেন, থামতেই চাইতেন না। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত। শুনতে শুনতে আমরা এটা-ওটা প্রশ্ন করতাম, উনি উত্তর দিতেন। বাড়ীর লোকে এসে তাড়া দিত — বেলা যে পড়ে এল খোকাখুকু, নাইবে খাবে কখন? আমাদের নাওয়াখাওয়া তখন মাথায় উঠেছে, গল্পের নেশায় বুঁদ। সারাদিন গল্পটল্প শুনে যখন সন্ধ্যেবেলা ফেরার সময় হয়ে যেত, তোমাদের বড়ঠাম্মা তাঁর শ্বশুরকে প্রণাম করে বলতেন ‘বাবাঠাকুর ওদের আবদার রাখতে গিয়ে সারাদিন একটুও জিরোতে পারলেন না’, আর সেই শুনে বুড়ো নীরবে ফোকলাদাঁতে হাসতেন। একরাশ মনখারাপ সেই হাসিতে, কারণ আমরা যে চলে যাচ্ছি।
আচ্ছা দিদিভাই, দাদুভাই, অনেককিছু লিখে ফেললাম, তবু শেষ করার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। তোমরা যে সবসময় কত ব্যস্ত সে তো দেখতেই পাই, তোমাদেরও নাওয়াখাওয়ার সময় নেই। তবু এরই মধ্যে কখনো কি ইচ্ছে করে এই বুড়ো দাদুটার পাশে বসে একটা দিন শুধু গল্প শুনে কাটিয়ে দিতে? অনেক দারুণ দারুণ গল্প আছে আমার ঝুলিতে, একদিন শুধু সময় করে শুনে দেখো। নাকি সেই ইচ্ছেটাই আসেনা মনে? প্রতিটা দিন সারা দুপুর সারা বিকেল আমি কী করে কাটাই জানতে ইচ্ছে করে না? বলি শোনো — খানিক খবরের কাগজ পড়ি, খানিক আশপাশের গাছগুলোতে বসা কাক-চড়াই গুনি, আর খানিক তোমাদের ঠাম্মার সঙ্গে কথা বলি, তবে তিনি তো আর উত্তর দেন না — ছবি হয়ে ঝুলে রয়েছেন যে দেওয়ালে। তারপর তোমাদের পথ চেয়ে থাকি কখন ইস্কুল থেকে ফিরবে। কিন্তু তোমরা ফিরেই টিভি, ফোন বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে মশগুল হয়ে পড়, আর আমি একা একাই বসে থাকি।
আমার আশি নম্বর জন্মদিন পালন করার কথা যে তোমরা দুজন ভেবেছ, এতেই আমি ভীষণ, ভীষণ খুশী। কিন্তু সত্যি বলছি, তোমাদের ঐসব পার্টি, নেমন্তন্ন, কেক কাটা, হৈচৈ — ওরকম উৎসবের বয়স এখন আর আমার নেই। তার বদলে যদি পারো আমার পছন্দের উপহারটাই কেবল দিও। কী সেটা, যদি এখনো বুঝতে না পেরে থাক, বলেই দিই খোলাখুলি। ওই দিন তোমরা সবাই আমার সঙ্গে, শুধু আমার সঙ্গে একটু সময় কাটাবে?
তোমরা জানতে চেয়েছিলে, তাই আমার ইচ্ছের কথা জানালাম। পূরণ করতে গিয়ে আবার নিজেদের ক্ষতি বা অসুবিধে কোরো না যেন।
অনেক আশীর্বাদ আর ভালবাসা রইল। ইতি।”
চিঠিটা হাতে নিয়ে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দিদির দুচোখের কোণে জল দেখে ভাইয়ের হাত থেকে আপনিই খসে গেল টিভির রিমোট।
————————————————————–
সেই শনিবারের পরের শনিবার জিৎ-জিনিয়াদের ফ্ল্যাটে তাদের দাদুর আশিতম জন্মদিন পালন হয়েছিল সানন্দে। না. কেউ আমন্ত্রিত ছিলনা, কেক-মোমবাতিও ছিলনা। শুধু অনেক বছর বাদে এক নাতি আর এক নাতনী তাদের দাদুর ইজিচেয়ারের দুদিকে বসে জমিয়ে গল্প শুনল সারাদিন। কতরকমের সব গল্প। অবশ্য তারা ছাড়াও অন্য দুজন ছিল সেই ‘উৎসবে’। তাদের মা আর বাবা — অফিস ছুটি নিয়ে। পুরোনো ছবির অ্যালবাম আর পুরোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানের ভিসিডিতে ডুবে স্মৃতিচারণ করতে করতে বারবার শিশুর মতো উচ্ছল হয়ে উঠছিল তিন প্রজন্মের সেই পাঁচজন মানুষ। আর সকলের অলক্ষ্যে দেয়ালে টাঙানো একটা ছবিও একটু যেন দুলে উঠেছিল। সেই ছবির চোখেও যে সেদিন আনন্দাশ্রু।