রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এবং কানাডার ফার্স্ট নেশন
কাজী সাব্বির আহমেদ

বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমি নিতান্তই ছোট। সেই সময়ে আমাদের দেশে ‘ইগলু’ আইসক্রিম খুব জনপ্রিয় ছিল। আমার প্রজন্মের কেউই হয়ত এই আইসক্রিমের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হননি কারণ তখন ‘ইগলু’ আর ‘বেবী’ আইসক্রিমের বাইরে আর কোন কোম্পানীর আইসক্রিম বাজারে ছিল বলে আমার জানা নেই। আমাদের কাছে তখন ‘ইগলু’ শব্দের অর্থই ছিলো আইসক্রিম। তারপর খুব সম্ভবত ক্লাস ফোরের ভূগোল পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে ‘ইগলু’ হচ্ছে বরফ দিয়ে বানানো এক ধরণের ঘর যা কিনা ‘এস্কিমো’ নামক এক জাতি বসবাসের জন্য তৈরি করে থাকে। উত্তর মেরুর কাছে এই জাতির বাস। তারা সীল মাছ শিকার করে এবং এই মাছের তেল দিয়ে তারা প্রদীপ জ্বালায়। কিন্তু কানাডাতে আসার পর আস্তে ধীরে জানতে পারলাম যে ‘এস্কিমো’ বলে কোন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বা ইনডিজেনাস জাতি নেই, বরং ‘ইনুইট’ এবং ‘ইউপিক’ নামের দুটি জাতিকে এই নামে অবহিত করা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে ‘ইনুইট’ জাতির বাস আলাস্কা এবং কানাডাতে, অপরদিকে ‘ইউপিক’দের বাস সাইবেরিয়াতে। ইনুইট কিংবা ইউপিক ভাষার ‘এস্কিমো’ শব্দের অর্থ নানাভাবে  অনূদিত হয়েছে তার ভেতর একটি হচ্ছে ‘কাঁচা মাংসভূক’। ইনুইটরা মনে করে তাদেরকে এই নামে অবহিত করাটা অবমাননাকর। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ডেভ বেক এবং থমাস স্কট নামের দুইজন পেইন্টার বা রঙ-মিস্ত্রী কানাডার আভ্যন্তরীন একটি ফ্লাইটে ইনুইট জাতির এক সহযাত্রীকে উদ্দেশ্য করে ‘এস্কিমো’ শব্দটি ব্যবহার করাতে একটি অস্বস্তিকর ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। প্রথমে বিমান কোম্পানীটি সেই দুইজন রঙ-মিস্ত্রীকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য তাদের সমস্ত ফ্লাইট থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। পরবর্তীতে তাদের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান তাদেরকে চাকুরীচ্যুত করে। তাদের মধ্যে একজন পরে অবশ্য এই বলে ক্ষমা প্রার্থনা করে যে তারা সেই সময় ‘ইনটক্সিকেটেড’ অর্থাৎ মাতাল ছিল। সেই সাথে আরও যোগ করে যে তারা ‘কালচারালি আনএডুকেটেড’ ছিল বলেই এই শব্দটি উচ্চারণ করেছে। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে তারা যে শুধু এস্কিমো শব্দটি ব্যবহার করেছে তা নয়, সেই ‘ইনুইট’ লোকের গা থেকে নাকি ‘কাঁচা মাংসের গন্ধ’ আসছে বলে তামাশাও করেছে। অর্থাৎ তারা যা করেছে তা জেনে বুঝেই করেছে। হয়ত কিছুটা তরলাবস্থায় ছিল বলেই কথাগুলি বলে ফেলেছে, নতুবা তাদের সেই মনের কথাগুলি মনের ভিতরই থেকে যেত এবং কোন এক সময় এই ঘটনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করত। আসলে ‘এস্কিমো’ সম্পর্কে আমরা বাংলাদেশীরাই বরং ‘কালচারালি অজ্ঞ’ তাই অবলীলায় আমাদের পাঠ্যবইতে এই অবমাননাকর শব্দটি ব্যবহার করে যাই, কিন্তু কানাডিয়ানরা মোটেই অজ্ঞ নন।

কানাডাতে বেশ অনেকগুলো আদিবাসীদের বাস যাদেরকে অতীতে সাধারণভাবে ‘ইন্ডিয়ান’ বলে উল্লেখ করা হত। কারণ কলম্বাস যখন আমেরিকাতে প্রথম জাহজ ভিড়ান, মনে করেছিলেন যে তিনি ‘ইস্ট ইন্ডিস’-এ এসে পৌঁছিয়েছেন। সেখান থেকেই ‘ইন্ডিয়ান’ বলা শুরু হয় এই বিশাল ভূখন্ডের বাসিন্দাদের। লরা ইঙ্গেলস উইল্ডারের লিখিত ‘লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরী’ যার সাথে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত, সেখানে সেটেলারদের জীবন সংগ্রামকে বিশদভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমরা সেই রচনায় দেখেছি সেটেলার আর ‘ইন্ডিয়ান’রা কীভাবে একে অপরের জীবন থেকে দূরে থেকেছে। সেই দূরত্ব কিন্তু আজো ঘোচেনি, বরং বিভিন্ন কারণে আরও বেড়েছে। যারা এদেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইমিগ্রান্ট হয়ে অনেক পরে এসেছে তারা যতটা এদেশের মূলধারার সাথে মিশে যেতে পেরেছে, এত বছরেও ‘ইন্ডিয়ান’রা কিন্তু তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। তার পেছনে কি কারণ সেটা এক জটিল প্রশ্ন, এর উত্তর খুঁজতে হলে আপনাকে কানাডার ইতিহাস খুঁটিয়ে পড়তে হবে। অতি সম্প্রতি ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ক্যামলুপ রেসিডেনশিয়াল স্কুল এলাকায় ইনডিজেনাস শিশুদের ২১৫ টি আনমার্কড কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এর পরপরই সাসকাচুয়ানের মেরিভ্যাল ইন্ডিয়ান রেসিডেনশিয়াল স্কুল এলাকায় পাওয়া যায় ইনডিজেনাস শিশুদের আরও ৭৫১টি আনমার্কড কবর। রেসিডেনশিয়াল স্কুলের কারণে ইনডিজেনাস শিশুদের উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার কিংবা মৃত্যুর ঘটনা কিন্তু নতুন কিছুই নয়। ২০০৮ সালে হারপার সরকার অফিসিয়ালি রেসিডেনশিয়াল স্কুলের ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং সত্য উৎঘাটনের জন্য ‘ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করে। ২০১৫ সালে এই কমিশনের রিপোর্টে জানা যায় যে ৬০০০ ইনডিজেনাস শিশু রেসিডেনশিয়াল স্কুলের কারণে অকালে প্রাণ হারায়। কিন্তু নতুন করে এত অধিক সংখ্যক শিশুর কবরের খোঁজ পাওয়াতে সবাই আবার নড়ে চড়ে বসেন এই কারণে যে শেষ পর্যন্ত এই সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে অনেকেই অভিযোগ তুলছেন এই বলে যে কানাডা গঠিত হয়েছেই ‘জেনোসাইড’-এর উপর ভিত্তি করে। হলোকাস্টের অভিযোগে নাযিদেরকে যেমন ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের সম্মুখীন করা হয়েছে, কানাডা সরকারকেও অনুরূপ বিচারের সম্মুখীন করার জন্য জোর দাবী জানিয়েছেন ফার্স্ট নেশন অ্যাক্টিভিস্ট নাকুসেট।

২০০৩ সালে আমরা প্রথম সিঙ্গাপুর থেকে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারেতে ইমিগ্রেশন ভিসায় আসি। সেই সময় আমার কলিগের মেয়ে ভেনেসা আমাদেরকে একদিন তার গাড়ীতে করে পুরা শহর ঘুরিয়ে দেখায়। তার সাথে সেদিন কথা প্রসঙ্গে ‘ইন্ডিয়ান’দের ব্যাপারে জানতে চাইলে সে আমাকে শুধরে দিয়েছিল ‘ফার্স্ট নেশন’ বলে। আমি আগে জানতাম যে তাদেরকে ‘রেড ইন্ডিয়ান’ বলাটা অফেনসিফ, কিন্তু তাদেরকে যে ‘ইন্ডিয়ান’ বলাটাও যে অশোভন সেটা জানতাম না। পরে তাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারি যে বিংশ শতাব্দীর সত্তুরের দশকে বিভিন্ন ইনডিজেনাস কিংবা আদিবাসী গ্রুপ তাদেরকে ‘ইন্ডিয়ান’ বলে অভিহিত করাটাকে অপছন্দ করা শুরু করলে আশির দশক থেকে অফিসিয়ালি তাদেরকে ‘ফার্স্ট নেশন’ বলে উল্লেখ করা শুরু হয়। এই ‘ফার্স্ট নেশন’ ব্যান্ডে প্রায় ছয়শত তিরিশটি ইনডিজেনাস কমিউনিটি অন্তর্ভূক্ত যারা পঞ্চাশটি ভিন্ন ভাষায় কথা বলে থাকে। ফার্স্ট নেশন ব্যতিরেকেও ‘ইনুইট’ ও ‘মেটিস’ নামের আরও দুইটি ইনডিজেনাস গ্রুপ রয়েছে কানাডাতে। আজকে যে ভূখন্ডকে আমরা কানাডা বলে জানি সেখানে ফার্স্ট নেশনদের বাস খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ কিংবা ৫০০ সাল থেকে। অর্থাৎ ফার্স্ট নেশনরাই কানাডার নেটিভ বা ভূমিপুত্র। ‘কনস্টিটিউশন অ্যাক্ট অব ১৯৮২’-এর ‘সেকশন ৩৫’-এর মাধ্যমে কানাডা ফার্স্ট নেশন এবং ইনুইট ও মেটিস নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে কানাডার অ্যাবওরিজিনাল বা আদিবাসী হিসেবে সরকারীভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমেরিকাতে এদেরকেই ‘নেটিভ আমেরিকান’ বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

কানাডাতে ২০০৬ সালে ইমিগ্রেশন নিয়ে আসার পর থেকে ‘রিজার্ভ’ নামটা কানে আসা শুরু করে। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে কিছু এলাকা ফার্স্ট নেশনদের জন্য ‘ক্রাউন’ অর্থাৎ কানাডিয়ান সরকার আলাদা করে রেখেছে যেখানে তারা তাদের নিজস্ব প্রশাসনে বাস করতে পারবে। যদিও তারা সেই জমির মালিক নয়। নানা রকম জটিল আইনের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে বেশ কিছু এলাকাকে ‘রিজার্ভ’ নাম দিয়ে ফার্স্ট নেশনকে কিছুটা স্বায়ত্ব শাসনের স্বাদ দিয়ে অনেকটা দেশের ভিতর আরেকটা দেশের সৃষ্টি করা হয়েছে। কানাডার ফার্স্ট নেশন পপুলেশনের প্রায় অর্ধেকই তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বিভিন্ন রিজার্ভে বসবাস করে। স্বাস্থ্য সম্মত বাসস্থান, পর্যাপ্ত চিকিৎসা, মান সম্মত শিক্ষা কিংবা বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ইত্যাদি নানা  ধরনের সমস্যায় জর্জরিত এই রিজার্ভগুলি। রিজার্ভগুলিতে ‘কোয়ালিটি অব লাইফ’ তৃতীয় বিশ্বের যে কোন দেশের চেয়েও খারাপ। স্বভাবতই আমার কাছে মনে হয়েছিল রিজার্ভে বাস করা ফার্স্ট নেশনরা কানাডার সেকেন্ড ক্লাস নাগরিক। আনএমপ্লয়মেন্ট, ড্রাগ এডিকশন, নারী নিগ্রহ, আত্মহত্যা কিংবা অপঘাতে মৃত্যু এই বিষয়গুলো ফার্স্ট নেশনদের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু তারা যেন অদৃশ্য এক কারণে তাদের এই দুর্বিষহ জীবনেই আটকে আছে। এই জীবন যেন তাদের এক অমোঘ নিয়তি। সেজন্য এই রিজার্ভগুলিকে আমার কাছে অনেকটা ‘ওপেন গেট প্রিজন’ বলে মনে হয়েছে। আমি অনেক ইমিগ্রান্টকে দেখেছি যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ফার্স্ট নেশনদের আজকের এই দূর্দশার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। একই সাথে তারা মনে করে যে কানাডা সরকার তাদের জন্য যথেষ্ট করছে কিন্তু তারা তাদের স্বভাবগত অলসতার কারণে নিজেদের উন্নতি করতে পারছে না। একই ধরনের মনোভাব আমি কিছু বাংলাদেশী কানাডিয়ানকেও পোষণ করতে দেখেছি। আমরা যদি ফার্স্ট নেশনদের জুতায় পা গলিয়ে চিন্তা করি আজকে কেন তাদের এই দূরাবস্থা তাহলে কিন্তু তাদের প্রতি আমাদের এই স্টেরিও টাইপ মনোভাবের কিছুটা পরিবর্তন হবে।

উনবিংশ শতাব্দীতে কানাডা তার ইন্ডিয়ান (ফার্স্ট নেশন) পপুলেশনকে কানাডার পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে ‘অ্যাসিমিলেশন’-এর উদ্দেশ্যে ক্যাথলিক চার্চের সহযোগীতায় রেসিডেনশিয়াল স্কুল স্থাপন করে। কানাডা আসলে আমেরিকাতে স্থাপিত বোর্ডিং স্কুলের আইডিয়াকে অনুসরণ করে। আর এই বোর্ডিং স্কুলের আল্টিমেট উদ্দেশ্য সম্পর্কে পেনসেলভেনিয়াতে স্থাপিত কারলিসলে ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল রিচার্ড প্রাট বলেছিলেন, ‘কিল দ্য ইন্ডিয়ান ইন হিম, এন্ড সেইভ দ্য ম্যান’। অর্থাৎ ইন্ডিয়ান পপুলেশনের ভিতর থেকে ইন্ডিয়ান কালচারকে সমূলে উৎপাটিত করাই ছিল এই রেসিডেনশিয়াল স্কুল স্থাপনের উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য পালনের জন্য ক্যাথলিক চার্চ এবং ক্রাউন কতটা নৃশংস ছিল তা আজ ক্রমে ক্রমে উৎঘাটিত হচ্ছে। ইনডিজেনাস গোষ্ঠীকে তখন যেভাবে সমূলে ধ্বংস করা হয়েছিল, আজকে কানাডা সরকারের তাদের প্রতি দেখানো সহানুভূতিশীলতা অনেকটা গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মতন। তারপরও সেই সহানুভূতি যে কতখানি আন্তরিক এবং প্র্যাকটিক্যাল সেটাও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ। জোডি উইলসন-রেবোল্ড যিনি ফার্স্ট নেশন এবং ক্রাউন দুটোরই উচ্চপদে আসীন ছিলেন, তিনি সেই প্রশ্নটিই করেছেন তাঁর ‘ফ্রম হোয়ার আই স্ট্যান্ড – রিবিল্ডিং ইনডিজেনাস নেশন ফর এ স্ট্রংগার কানাডা’ বইতে। আমরা তাকে মিনিস্টার অব জাস্টিস এবং এটর্নী জেনারেল থাকাকালীন ‘এসএনসি লাভালন’ কেস নিয়ে সরকার দ্বারা নাজেহাল হতে দেখেছি। তিনি প্রাইম মিনিস্টারের অফিসের সাথে তার কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করে রাখেন এবং পরবর্তীতে তা প্রকাশ করে প্রমাণ করতে সমর্থ হন যে সরকার তার উপর অন্যায্যভাবে চাপ প্রয়োগ করেছিল ‘এসএনসি লাভালন’ কেসের ব্যাপারে। গোপনে ফোনালাপ রেকর্ড করার কারণ দেখিয়ে ট্রুডো তাকে লিবারেল পার্টির ককাস থেকে বহিস্কার করেন। ফার্স্ট নেশন থেকে উঠে আসা একজন উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাকেও যেখানে পদে পদে যে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় সেখানে অন্যান্যদের যে কী মোকাবেলা করতে হয় তা আমরা খরবের কাগজে চোখ রাখলেই সহজে বুঝতে পারি। ভ্যাঙ্কুভারে ব্যাংক অব মট্রিয়েলের এক শাখায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার সময় হেইল্টসুক নেশনের ম্যাক্সওয়েল জনসন নামের এক ব্যক্তিকে ফ্রড সন্দহে পুলিশ তার ১২ বছর বয়স্কা নাতনিকে সহ হাতকড়া পরায়। পরে ব্যাংক এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষ উভয়েই এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। জয়েস ইচাকুয়ান নামের আতিকামেকউ গোষ্ঠীর এক মহিলা পেটের তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে চিকিৎসার জন্য যখন কুইবেকের এক হাসপাতালে যায় তখন প্রটোকল অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে নার্স সহ অন্যান্য স্টাফরা তাকে উদ্দেশ্য করে নানান কটূক্তি করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে সাত সন্তানের জননী সেই মহিলার মৃত্যু ঘটে। এই দুঃখজনক ঘটনায় এটাই প্রমাণ হয় যে হেলথ কেয়ার সেক্টরে ফার্স্ট নেশনদের প্রতি সিস্টেমিক রেসিজমের অস্তিত্ব রয়েছে। আসলে সরকারের প্রতিটি সেক্টরে ফার্স্ট নেশনদের প্রতি যে সিস্টেমিক রেসিজম বিদ্যমান সেটা একটি বাস্তব সত্য। ২০০৮ সালে কানাডা  সরকার যদিও প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে কিন্তু বাস্তবে যখন রেসিডেনশিয়াল স্কুলের ভিকটিমেরা কোর্টে গিয়েছে তাদেরকে রুখতে সরকার ট্যাক্স পেয়ারদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। অনেকক্ষেত্রে কোর্টও এমন সব রায় দিয়েছে যা ভিকটিমদের পক্ষে যায়নি। যেমন এক কেসে কোর্ট ক্যাথলিক চার্চকে পঁচিশ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করে, তবে একটা ক্লজ জুড়ে দেয় যে চার্চ যদি এই টাকা দিতে ব্যর্থ হয় তবে তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা টাকা যোগাড় করার জন্য তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো। স্বাভাবিকভাবেই চার্চ সেই জরিমানার টাকার পাঁচ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত শোধ করেছিল। লিবারেল পার্টি যখন ক্ষমতায় এসেছিল তখন অবশ্য ইনডিজেনাস গোষ্ঠীরা কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু তাদের আশা ভাঙ্গতে অবশ্য বেশী সময় লাগেনি যখন লিবারেল পার্টি তাদের নির্বাচনী ম্যান্ডেট পূরণে ব্যর্থ হয়। এছাড়াও লিবারেল সরকারের ট্রান্স মাউন্টেন্ট পাইপলাইন কেনার সিদ্ধান্তকে ইনডিজেনাস গোষ্ঠী তাদের প্রতি ট্রূডোর বিশ্বাসঘাতকতা   হিসেবে ধরে নেয়। কারণ ট্রান্স মাউন্টেন্ট পাইপলাইন ইনডিজেনাস ল্যান্ডের ভিতর দিয়ে যাওয়ার ফলে সেটা সেখানকার পরিবেশের জন্য একটা মারাত্মক হুমকি।

‘ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ ইনডিজেনাস গোষ্ঠীর প্রতি অতীতে ঘটে যাওয়া অত্যাচার, অবিচার এবং নিপীড়নের পুনারাবৃত্তি যাতে না ঘটে অথবা কানাডিয়ান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে ইনডিজেনাস গোষ্ঠী যাতে সত্যিকার অর্থেই অ্যাসিমিলিটেড হতে পারে তার জন্য বেশ কিছু রিকমেন্ডেশন দিয়েছে। সেই রিকমেন্ডেশনের ভিতর একটি হচ্ছে রেসিডেনশিয়াল স্কুলের কাহিনী কানাডিয়ান স্কুল কারিকুলামে ম্যান্ডেটরি কোর্স হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যে অনেক স্কুলই এই কোর্সের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে রেসিডেনশিয়াল স্কুলের কুকীর্তির বদলে অনেকে আবার তাদের অ্যাসিমিলিশনের ব্যাপারে তাদের অবদানকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করেছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উইলিয়াম এ ফ্রেজার মিডল স্কুলের গ্রেড সিক্সের হোম ওয়ার্কে দেয়া হয়েছিল রেসিডেনশিয়াল স্কুলের পজিটিভ দিকগুলো নিয়ে লিখার জন্য। পরবর্তীতে অ্যাবোটসফোর্ড ডিস্ট্রিক স্কুল বোর্ডের সুপারিনটেনডেন্ট কেভিন গডেন বলেন যে স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল এই হোম ওয়ার্কের ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু হোম ওয়ার্কটা যদি একজন ফার্স্ট নেশন ছাত্রীর মা ক্রিস্টা ম্যাকিননিসের নজরে না আসত তবে হয়ত আমরা জানতেই পারতাম না এই ঘটনার কথা। আবার মিসিসগার একটি রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্যাস্টর মনসিগনর ওয়েন কীনান তার এক সারমনে উল্লেখ করেন যে রেসিডেনশিয়াল স্কুলের ঘটনায় সবাই চার্চকে দোষী হিসেবে দেখে, কিন্তু চার্চ অনেক ভালো কাজও করেছিল সেই সব রেসিডেনশিয়াল স্কুলগুলিতে। তার এই বক্তব্যের জন্য পরে তাকে অবশ্য তার পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়। এখানে উল্লেখ্য যে কানাডার প্রাইম মিনিস্টার ট্রুডো রেসিডেনশিয়াল স্কুলের তদন্তের ব্যাপারে ক্যাথলিক চার্চের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগীতা না পাওয়ায় তার হতাশা এবং ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে পোপ ফ্র্যানসিসকে ভ্যাটিকানের পক্ষ থেকে রেসিডেনশিয়াল স্কুলের ঘটনার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য অনুরোধ করেন। পোপ অবশ্য তাতে রাজী হননি। পোপের কাছ থেকে এই ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বিভিন্ন ইনডিজেনাস গোষ্ঠীর লিডাররা জোর দাবী অব্যাহত রেখেছেন। ভ্যাটিকান সেটাকে কিভাবে জবাব দিবে তা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে। ঘটনাক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে রিকনসিলিয়েশনের ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই সরকার নিজেই আন্তরিক নয়। তবে নতুন করে যখন ক্যামলুপে ইনডিজেনাস শিশুদের কবর পাওয়া গেল, সরকার তখন আবার বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে। ৩০শে সেপ্টেম্বরকে ‘ন্যাশনাল ডে ফর ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন’ হিসেবে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা দেয়া হবে হয়ত খুব শীঘ্রি। এছাড়া ইলুক নেশনের লিডার মেরী সাইমনকে কানাডার গভর্নর জেনারেল নির্বাচিত করাটাও হয়ত ফার্স্ট নেশনদেরকে আশ্বস্ত করার একটি স্ট্র্যাটেজি।

কানাডিয়ান রক গায়ক গর্ড ডাওনি রেসিডেনশিয়াল স্কুলের শিশুদের করুণ মৃত্যুতে আন্তরিকভাবেই ব্যথিত হয়েছিলেন। চেনি ওয়েনজ্যাক নামের এক ইনডিজেনাস বালক সিসিলিয়া জেফরি ইন্ডিয়ান রেসিডেনশিয়াল স্কুল থেকে পালায় বাড়ীতে ফেরার জন্য। সে জানত না যে তার বাড়ী চারশত মাইল দূরে অবস্থিত, সে জানত না কোন পথে তাকে বাড়ী ফিরতে হবে। ফলে পথে তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনা গর্ড ডাওনিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি তার মৃত্যুর আগে ‘দ্য সিক্রেট পাথ’ নামক একটি অ্যালবাম কাম গ্রাফিক নভেল তৈরি করেন চেনি ওয়েনজ্যাকের স্মরণে। তার প্রতিদানে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ফার্স্ট নেশনদের ন্যাশনাল এসেম্বলিতে চীফ পেরি বেলগার্ডি তাকে ফার্স্ট নেশনের পক্ষ থেকে ঈগলের পালক উপহার দেন, তাকে তাদের ট্র্যাডিশলান নকশাখচিত কম্বল দিয়ে মুড়ে দেন এবং সেই সাথে তাকে তারা একটি সম্মানজনক ল্যাকোটা নাম দেন, ‘উইকাপি ওমানি’ যার অর্থ হচ্ছে ‘যে আকাশের তারাদের মাঝে হেঁটে বেড়ায়’।

রক গায়ক গর্ড ডাওনিকে ফার্স্ট নেশনের পক্ষ থেকে সম্মানজনক ল্যাকোটা নাম দেয়া হয় যার অর্থ হচ্ছে ‘যে আকাশের তারাদের মাঝে হেঁটে বেড়ায়’

Top

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments


Copyright © 2023. All Rights Reserved.