জ্বীন শিকার
ইকরাম কবির
তিন দিন ধরে রহমত মিঞার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। ক্ষিদে আছে। ভালো লাগছে না খেতে। বুঝতে পারছে না– কেন। কারও সাথে কথা বলতেও মনে সইছে না। কাজেও যায়নি এ ক’দিন। সহকারী কালু শেখ এসে খোঁজ নিয়ে গেছে ক’বার। সে প্রতিদিনই আসে। রহমত বলেছে, ‘ভাল্লাগছে না রে, শরীর ভালো নেই, চলে যা, গিয়ে বল আমার অসুক’। কালু বলেছে, ‘বড় সাহেব খোঁজ করছেন রহমতের, যেতে বলেছেন। সমস্যা হয়েছে, সবাই রহমতকেই খুঁজছেন।’
রাণীর মা’র স্বর এতোগুলো বছর বেশ চওড়াই ছিল। এই তিন দিন লতিফা একটু ম্রিয়মান। সেও বুঝতে পারছে না স্বামীর কী হয়েছে। রহমত চিরকাল লতিফার কথার জবাব দিয়ে এসেছে। কয়েকদিন ধরে কথাই বলছে না। লতিফা চিন্তায় পড়েছে। তার চেয়ে বেশি চিন্তায় পড়েছে সে কেন খাওয়াদাওয়া করছে না– তা দেখে। লতিফা নানাপদের খাবার রেঁধেছে। অনেক বাজার করেছে আজ। একসের হরিণের মাংসও এনেছে। রহমতের বিশেষ পছন্দ। সে জানে। রহমত নিজে বাজার-টাজার করে না। এ রাণীর মা’রই কাজ। মনের মতো করে মশলা কিনেছে লতিফা। তাদের বাজারে বিচিত্র স্বাদের মশলা পাওয়া যায়।
রহমত মিঞা পেশায় বনরক্ষী। গেল ত্রিশ বছর বন পাহারা দিয়েছে। এখন সে উচ্চশ্রেণির কর্মী। বনের আশেপাশের গ্রামগুলোতে সবাই তাকে সন্মান করে। যদিও তার পরিবারের সদস্যদের বাজার-সদাই করার অভ্যাস দেখলে কেউ তাদের নিছক বনরক্ষীর পরিবার বলে মনে করবে না, আদতে তার অর্থের অভাব নেই। তবে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় আগেপিছে চিন্তা না করেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করার প্রচেষ্টা রহমতকে এই সামাজিক সন্মান আয় করতে সাহায্য করেছে। তার জীবনযাপণ সাদাসিদে; একজন সাধারণ রক্ষীর মতোই। মায়না-বহির্ভূত কিছু কাঁচা অর্থ সবসময় তার হাতে থাকলেও তা সে খরচ করে খাওয়াদাওয়া ও গরিব মানুষের জন্য। কেউ তার কাছে হাত পেতে সাহায্য পায়নি, এমন কোনোদিন হয়নি।
রহমত মিঞা আরও এক কারণে জনপ্রিয়। কোনো মানুষের ওপর বদজ্বীনের আছর হলে সে জ্বীনমুক্ত করতে পারে। অনেক মানুষকে সে জ্বীনের কবল থেকে বাঁচিয়েছে। অনেকে তাকে জ্বীনের ডাক্তার বলেও ডাকে। যে কাজ মৌলভীরাও পেরে ওঠেন না, রহমত তা নির্বিঘ্নে হাসিল করে। গেল এতগুলো বছরে সে যত জ্বীনগ্রস্ত মানুষকে রাহুমুক্ত করেছে, তারা সবাই কৃতজ্ঞতায় তাকে পীর গণ্য করে।
সব মিলিয়ে রহমত মিঞার দিন কাটে নির্ঝঞ্ঝাটে। রাণীকে বিয়ে দিয়েছে দুই গ্রাম পরে। মেয়ে ভালোই আছে। জামাই মেয়েকে অনেক আদর করে। এলাকার অন্যান্য মেয়েরা তাদের জীবনে স্বামীজনিত অনেক সমস্যায় ভোগে। আলহামদুলিল্লাহ, তার মেয়ের জীবনে তেমন সমস্যা সে লক্ষ করেনি। জামাইয়ের কাঠের ব্যবসা। ব্যবসাটা সাজিয়ে দিয়েছে রহমতই। জামাই বাবাটা হয়তো সে কারণেই রাণীকে আদর-যত্নে রাখে।
রহমত কোনোদিন লতিফাকে নাম ধরে ডাকেনি। সে তার ‘রাণীর মা’। কিছুক্ষণ আগে খাবার সাধতে গেলে রহমত বলেছে, ‘লতা, আমি খেতি চাইনে, ভাল্লাগছে না, তুই খেই নে; আর কিছুটা কালুকে দিয়ে রাণীর বাড়ি পাটিই দে।’
লতা! লতিফা একটু থমকেছে। বিয়ের পরপর একরাতে রহমত তাকে লীলা বলে ডেকেছিল। লতিফা অবাক হয়েছিল। জানতে চাইলে রহমত বলেছিল, ‘লীলা আমার বড় মা’র নাম ছেল; তার কতা ভাবছিলাম, তাই মুখ ফসকে বেরিই গেচে’। তারপরও লতিফার বনরক্ষী স্বামী তাকে অন্য নারী-নামে ডেকেছে, কিন্তু ততদিনে লতিফা জেনে গেছে যে, রহমতের সাথে জ্বীনদের কথা হয়। হয়তো কোনো নারী-জ্বীনের সাথে কথা হচ্ছিল তখন। নারী-জ্বীনের সাথে কথোপকথন নিয়ে একবার লতিফা অনেক ঝগড়া করেছিল। রহমতের দিকে বটি ছুঁড়ে মেরেছিল। রহমত তাকে শান্ত করার সময় বলেছিল, ‘ওরা কেউ নয় রে; বাতাস, বায়ু, মাংস নেই, রক্ত নেই, আমি তো ওদের সাতে কতা বলিনে, সুরা পড়ি।’ লতিফা শান্ত হলো।
তবে লতা নামে এর আগে কখনও ডাকেনি।
‘হাঁ গো; আজ দেখি বড্ড লতা বলে ডাকচেন! জীবনেও তো লতিফা বলে ডাকলেন না! আচ্ছা, লতাই ডাকুন, ভালোই লাগচে। তবে খাওয়া বেড়িচি। খেইয়ি লেন।’
‘লতিফাকে আদর করেও তো লতা ডাকা যায়।’
‘আমি তো কিচু বলচিনে। খেতি আসেন।’
‘ভাল্লাগছে না রে; তুই খেই নে।’
‘আর কতা বলতি চাচ্চিনে; খেই নিয়ে ওকানে যান, কালু আবার এসেচে; আপনাকে ডাকচে।’
রহমত জানে– কে ডেকে পাঠিয়েছেন এবং কেন। তালুকদার সাহেব। এ তল্লাটের অলিখিত সম্রাট। দেশ স্বাধীনের পর মাটি ফুঁড়ে কোথা থেকে যেন বেরিয়ে এলেন। একটার পর একটা ব্যবসা খুলে বসলেন। মানুষ তাকে চিনতে শুরু করল। তিনি অবশ্য আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হননি। ধীরে ধীরে, গুল্মের মতো জন্ম নিয়ে এখন এক সামাজিক মহীরুহুর আসনে। রাজনীতি করেন না, তবে সবাই তাকে চেনে। মেনে চলে। ওসি, ডিসি, চেয়ারম্যান, এমপি– সবাই তাকে পছন্দ করে এবং ক্ষণেক্ষণে তার সাহায্য প্রার্থনা করে। তিনি হাত বাড়িয়েও দেন। রহমতের সাথে তার এক ধরনের নীরব বন্ধুত্ব আছে। কেউ টের পায় না। সমাজ-শৃঙ্গারে তিনি সাগরের ছফেদ ফেনা আর রহমত তীরে আছড়ে পড়া মিহি বালু। তারপরও তাদের সম্পর্ক নিগূঢ়। শেখ সাহেব খুন হওয়ার সময় রহমতের মা জমিলা তালুকদার সাহেবের বাড়িতে ঝি- এর কাজ করতো।
বিশেষ কাজে ডাক পড়েছে। যেতেই হবে। রহমত কখনও তালুকদার সাহেবকে না বলেনি। গড়িমসি করে, কিন্তু তিনি যা বলেন, তা করে দেয়। তালুকদার সাহেবও রহমতকে কখনও না বলেন না।
যে কাজে তার ডাক পড়েছে, তা রহমত অতীতে অনেক করেছে। জ্বীন তাড়াতে হবে। আগে জ্বীন তাড়ানোতে আনন্দ ছিল। এখন আর জ্বীন বলে কিছু নেই। আগে জ্বীনেরা কত ঘটনা ঘটাতো। এখন জ্বীনদের কেউ পোঁছেও না। অনেক তো হলো। আর কত? মন আর টানে না। এ কাজ কোনো কাজই না। জ্বীন বলে কিছু নেই তা কাউকেই বোঝাতে পারে না রহমত। সে বনরক্ষী, বন পাহারা দেয়াই তার কাজ। তা-ই করে যেতে চায়। তবে তালুকদার সাহেব ডাকবেনই। তিনি ডাকলে রহমত কিছুক্ষণ গাঁই-গুঁই করে, তবে ‘না’ বলে না। জ্বীনগ্রস্ত মানুষকে মুক্ত করতে ডাক পড়ে। চারিদিকে জ্বিনগ্রস্ত মানুষ। তালুকদার সাহেবকে সে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে, মানুষ সবাই কোনো না কোনোভাবে জ্বীনগ্রস্ত। রহমতেরও জন্মের ইতিহাস এক জ্বীনের ইতিহাস। তখন তালুকদার সাহেবও জ্বীনগ্রস্ত ছিলেন এবং সেভাবেই রহমতের জন্ম। তিনি বুঝেও বোঝেন না। হয় তো বা বোঝেন; রহমত জানে না।
তালুকদার সাহেবের ডাকে জাদু আছে। ওসি, ডিসি, চেয়ারম্যান, এমপি সবাই জাদুর টানে আসেন।
বনের উত্তর-পশ্চিম দিকে দানবাকৃতির এক জ্বীনের আবির্ভাব হয়েছে, এসেছে। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যে-ই বনে কাজে যাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে। তাড়িয়ে দিচ্ছে। কার নাকি ঘাড়ও মটকে দিয়েছে। কাজের কারণে বনমুখী মানুষের সংখ্যা অনেক। তালুকদার, ওসি, ডিসি, চেয়ারম্যান, এমপি– এদের সবারও বনের কাছে কিছু না কিছু চাওয়ার আছে, পাওয়ার আছে। তবে তারা কেউ সশরীরে সেখানে যান না। তাদের চাওয়া-পাওয়া তাদের অনুপস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হয়।
রহমতই যাবে জ্বীন বধে। সে একটু ভীত হয়ে পড়ে। এ যাবৎ যত জ্বীন তাকে সামলাতে হয়েছে, তারা সবাই ছিল অশরীরী। শোনা যাচ্ছে, এই জ্বীনের নাকি আকার আছে। অনেকে দেখেও এসেছে। যারা দেখেছে, তাদের সাথে কথা বলতে তার ইচ্ছে হয়নি। যখন জ্বীনের আছর হয়, মানুষগুলো কেমন পাগল-পাগল হয়ে যায়। মানুষ কখনও জ্বীন দেখতে পায় না, তবে তার খপ্পরে পড়ে। রহমতদের পুরো এলাকাই কি জ্বীনগ্রস্ত হয়ে গেল?
রহমত এশার নামাজ পড়ে বনে ঢুকবে। তালুকদার সাহেব বলেছিলেন কাউকে সাথে নিতে। অন্তত কালুকে নিয়ে যাক। রাজি হয়নি সে। জ্বিন জয় করতে কারও সাহায্য প্রয়োজন হবে, তা সে মানতেই পারে না। ইজ্জত নষ্ট হবে। লতিফার রান্না করা দুপুরের খাবার সে এশার আগে খেয়ে নিয়ে প্রস্তুত হয়। ক্ষিদে পেয়েছিল। লতিফা কিছু গুড়-মুড়ি আর বিস্কুট একটা থলিতে বেঁধে দেয়। রাতের খাবার খেতে যে খুব ভালো লাগল– তাও বলা যাবে না। নামাজে বসে সুরা-কালাম পড়ায় একটু বেশি সময় নেয় রহমত। ভয়টা মনের মাঝে রয়েই যায়। কালু বায়না ধরে সে সাথে যাবে। বকুনি খেয়ে চুপ হয়ে যায়। এক কাঁধে পাহারা দেয়ার বন্দুক এবং অপর কাঁধে লতিফার দেয়া খাবার ঝুলিয়ে, হাতে ইয়াবড় এক টর্চলাইট নিয়ে রওনা দেয়। বনের শুরুটা তার ঘর থেকে আধা ক্রোশ হবে। বনে ঢুকতে এমন দ্বিধান্বিত সে আগে কখনও হয়নি। রহমতের সাহসের অন্ত নেই। তবে আজকের রাতটি অন্যরকম লাগছে।
সন্তর্পণে কিছুক্ষনের মধ্যেই বনের কিনারে পৌঁছে যায়। দম নেয়ার জন্য কিছুক্ষন দাঁড়ায়। বন্দুকের বাঁটে হাত বুলিয়ে নেয়। আকাশে বড় চাঁদ। কালই পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় উঁচু গাছের ডালগুলো সাপের গায়ের মত চক্-চক্ করছে। প্রকৃতির এমন চেহারা সে হাজারবার দেখেছে। আজ অন্যরকম লাগছে। সে যখন বনে ঢুকছে, মেঘ এসে চাঁদ ঢেকে দেয়। অন্ধকার। রহমত আবার থামে। হঠাৎই এক টুকরো আগুনের মত আলো জ্বলে ওঠে ডানদিকে, কিছুটা দূরে। ঠিক আগুনের রঙ নয়। আলেয়া হবে। চারপাশে কোনো জলাধার নেই। আলেয়া আসবে কোথা থেকে? আলোটা বড় হতে থাকে। একটা অবয়ব প্রচ্ছন্ন হয়। ছোটবেলায় একবার যীশুর ছবি দেখেছিল, তেমন। অবয়বটির চারপাশে জ্যোতি। একজন নারীর রূপ নিচ্ছে বলে মনে হয়। এমন দৃশ্য সে আগে দেখেনি। নারীর মুখমন্ডল দেখা যায় না। আকার বোঝা যায়। সাদা শাড়ি পরে আছে। কেশ বাতাসে উড়ছে। শরীর বাতাসে ভেসে আছে। লীলার মতো লাগে। লীলা আসলে রহমতের বড় মা’র নাম নয়। মিথ্যে বলেছে সে লতিফাকে। লীলা! তাহলে লীলাই কি সেই প্রকান্ড জ্বীন?
লীলার সাথে দেখা হওয়ার কথা মনে পড়ে। রহমত সবে চাকরীতে ঢুকেছে। একাই থাকে। রাতে বন পাহারা দেয়, দিনে ঘুমায় বনের ভেতরে তার ছোট্ট কেবিনে। লোকালয়ে আসে বাজার-সদাই করতে। একদিন বাজার করে কাঠুরে আজমতের বাড়ির পাশ দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় হট্টগোল শুনতে পায়। বাজারের থলি ওদের বাড়ির পেছনে রেখে উঠোনে গিয়ে দেখে এক নারী পাগলের মতো লাফাচ্ছে। তাকে ঘিরে গোল করে অনেক উৎকন্ঠিত ও আনন্দান্বেষী মানুষ। গ্রামের ইমাম সাহেব তার স্বরে আয়াত পড়ছেন। হাতে মোটা লাঠি। আজমতের হাতেও লাঠি। সুযোগ পেলেই মেয়েটিকে সে লাঠি দিয়ে আঘাত করছে। আঘাত সহ্য করেই মেয়েটি রাক্ষসের মতো আক্রমনাত্বক ভঙ্গি করছে। মানুষের কথার ঝনঝনানির পানে কান পেতে রহমত বুঝতে পারে যে, মেয়েটি আজমতের স্ত্রী এবং তাকে জ্বীনে ধরেছে এবং সে কারণেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। মেয়েটির গায়ের শাড়ি ঝরে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। শাড়ির নিচে আর কোনো আস্তরণ নেই। মাঝেমাঝে মেয়েটির স্তন চোখে পড়ছে। সবার চোখ সে দিকেই। রহমতের দৃষ্টিও সেখানেই স্থির হয়। সে মেয়েটির নিতম্বের ঢেউয়ের দিকেও আকর্ষিত হয়। গায়ে ধুলোবালি লেপটে থাকলেও মেয়েটি অতীব আকর্ষণীয়।
কী যেন ঘটে যায় রহমতের মনের মাঝে। শরীরের রক্ত সঞ্চালনে পরিবর্তণ টের পায়। ভালো করে খেয়াল করে দেখে মেয়েটি আসলে জ্বীনগ্রস্তের অভিনয় করছে। সে এগিয়ে গিয়ে ইমাম সাহেবের সামনে দাঁড়ায়। তিনি থমকে থেমে যান। আজমতের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করে, ‘ভাই, ইবাবে হবি না; আমি একটু চিষ্টা করি?’ সবাই রেগে যায়। তা দেখে রহমত অনর্গল সুরা পড়া শুরু করে। তখন আর কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। সবার রাগ গলে যায়। মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকায় রহমত। একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে তাকে বসতে বলে। মেয়েটিও সবাইকে অবাক করে দিয়ে তা-ই করে। তখনও উচ্চস্বরে স্বামীকে গালি দিতে থাকে।
রহমত আরেকটি চেয়ার নিয়ে তার পাশে বসে। সুরা পড়ছে। ফাঁকে-ফাঁকে কথা বলছে। বারবার ফুঁ দিচ্ছে মেয়েটিকে। একেকবার ফুঁ দেয় আর মেয়েটির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে জানতে চায় তার কী হয়েছে। মেয়েটি ঘঁ-ঘঁ শব্দ করে চিৎকার করে। সুরা পড়া চলতে থাকে। মেয়েটি তাকে ইশারায় কাছে ডাকে। রহমত কান পাতে তার মুখের কাছে। মেয়েটিও ফিসফিসিয়ে কী যেন বলে। রহমতও ফিসফিসিয়ে উত্তর দেয়। তারপর সবার উদ্দেশে বলে, ‘উনুনে জল বসান; ফুতন্ত জল লাগবি; জ্বীন কথা শুনতি চায় না। একটা বাঁশের মাচা বানান। একে আমি উল্টো করে ঝুলিই তার নাকের ভিতর গরম জল ঢালবো। তবে সি ব্যাতা পাবি না। সুরা আর ফুতন্ত জলে জ্বীনমুক্তি ঘটবি।’
রহমতের এ কথা শোনার পরই মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে। রহমত সুরা-কালাম পড়তেই রয়। প্রায় দশ মিনিট পর মেয়েটি চোখ খুলে তাকায়। শান্ত চেহারা। উঠেই স্বামীকে খোঁজ করে। আজমত পাশেই ছিল। উঠে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
রহমতের নাম ছড়িয়ে পড়ে। সে হয়ে যায় জ্বীনের ডাক্তার।
আজমতের বাড়ি বনের মুখেই। সারাদিন বনেই কাটে তার সময়। ফিরতে বেশ রাত হয়। লীলা সারাদিন একা থাকে। তার জীবনের অভাব রহমত মেটাতে শুরু করে। কেউ জানতে পারে না। এমন সুখের হাওয়া বয় অনেকদিন ধরে।
একরাতে কাঠুরে বাড়ি ফিরে তার স্ত্রীর মরা দেহ বাড়ির উঠোনের গাছে ঝুলতে দেখে। কেউ জানলো না লীলা কেন দড়ি নিলো। পুলিশ কিছু খুঁজেই পেলো না। শুধু রহমত জানলো তার আত্মাহুতির কারণ।
লীলার অবয়বটা আর দেখা যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় রহমত এই জ্বীনের প্রজাতি বুঝতে পারছে না। ক্বারীন-ওলহান না বোধহয়। ইবলিসই হবে। একবারে ইফরিত। আস্ত শয়তান। বনের ঢোকার আগেই ইফরিত জ্বীন রহমতকে ভয় দেখাতে চাইছে। সে ভয় পেতে চায় না। এটা তার বন। ত্রিশ বছর ধরে সে এখানকার উজির। বনের প্রতি ইঞ্চি সে চেনে। তাকে টলানো এতো সহজ নয়। অনেক ঠেকে সে শিখেছে কেমন করে টিকে থাকতে হয়। সুরা পড়ার শব্দ বাড়িয়ে দেয়। এতদিন এই সুরাগুলো মন থেকে পড়েছে কি না, সে জানে না, তবে আজ মনের সব শক্তি দিয়ে পড়ছে।
প্রায় এক মাইল ভেতরে চলে আসে। বন আগে অনেক ঘন ছিল। এখন হালকা হয়েছে অনেক। গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকতে পারে এখন। সাবধানে পথ চলে সে। গাছে ডগার দিকেই তার নজর। কে জানে জ্বীন কোন দিকে আছে! শয়তানটা ডগাতেই থাকতে পারে। যত তাড়াতাড়ি এই ইবিলিসটার সাথে দেখা হয় ততই ভালো। গেল তিন দিন ধরে তার অতীত জীবনের সবকিছু ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে। আজকের এই যুদ্ধ তার করতে ইচ্ছে করছে না। উপায় নেই। এই জ্বীনকে তার জয় করতেই হবে। নাহলে ইজ্জত থাকবে না। ডুবডুবি এলাকাটা দেখা যাচ্ছে দূরে। এগিয়ে যায়। ডুবডুবি এলাকাটা এখন ফাঁকা হয়ে গেছে। গাছ নেই। হাতের টর্চলাইটটা জ্বালায় ভালো করে দেখার জন্য। কই জায়গাটা তো ফাঁকা মনে হচ্ছে না! কেমন যেন ভরা-ভরা লাগছে। আরও কাছে যায়। নাহ, ফাঁকা নয়। সেদিনও তো ফাঁকা দেখল। পুরো জায়গাটা জুড়েই গাছ দেখে। লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে নয়। সব গাছগুলো কাত হয়ে এক দিকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি হেলে দাঁড়িয়ে আছে। কী করে সম্ভব? গেল বছরই তো তালুকদার একশো গাছ কাটিয়ে নিয়ে গেল! এখন গাছ এলো কোথা থেকে? ঘামতে থাকে সে। নাহ; খবিশ জ্বীনটা তার মনে ভ্রম তৈরি করছে, তাকে জ্বালাচ্ছে। মাঝরাত পেরিয়ে যায়। ক্ষিদে পায়। থলি থেকে গুড়-মুড়ি বের করে খায়। জলের বোতলও দিয়েছে লতিফা। ঘুম পায় রহমতের। কিন্তু ঘুমোনো যাবে না। রাত ছাড়া ইফরিতটাকে পাওয়া যাবে না। রাতেই ধরতে হবে। ওকে ধরার সব উপায়ই তার জানা আছে। সে ভয় পাচ্ছে না। মনে মনে, সে জ্বীনকে বলতে থাকে তাকে দেখা দিতে, সামনাসামনি দাঁড়াতে।
সারারাত এদিক-ওদিক ঘুরেও কিছু দেখতে পায় না। ক্লান্ত বোধ করে। ফজরের সময় আসে। এখানে আজান দেয়ার কেউ নেই। নিজেই আজান দিয়ে নামাজ পড়ে। আবারও গুড় দিয়ে মুড়ি খায়। একটা বড় গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে মনে হয় বল্লমটা আনলে ভালো হতো। বনের এপাশটায় প্রহরীদের জন্য কেবিন নেই। দস্যুদের উৎপাত অনেক। বনদস্যুর চেয়ে জলদস্যু বেশি ভয়ংকর। বয়সকালে এমন অনেক দস্যু সে একাই সামলেছে। এখন আর সেই সময় নেই। বহু যুবক-রক্ষীরা এসেছে; তারাই এখন পাহারা দেয়।
বাতাসে শন্-শন্ শব্দ ওঠে। রহমত সচকিত হয়ে চারিদিকে চায়। গাছপালা নড়ছে না; শুধু শব্দ। রক্ষা কর কর্তা। মুহূর্তেই শব্দটি বদলে যায়। এবার ধাতব শব্দ। কাঠের সাথে লোহা ঘষলে যেমন, ঠিক তেমনই। মনে হচ্ছে কেউ করাত দিয়ে কাঠ কাটতে চাচ্ছে, কিন্তু কাটছে না। কুড়ি বছর আগের এক শব্দের কথা মনে পড়ে। মধুবন খালের পাড়ে নিজেকে আবিষ্কার। কী! এখানে এলো কেমন করে? সে তো এখানে আসতে চায়নি। তার পুরোনো কেবিন! জ্বীনটা তো এদিকে নেই! সে দক্ষিণে চলে এসেছে। খালের কিনারে কেবিনে এখন কোনো রক্ষী বাস করে না। খালটাও এখন নর্দমা হয়ে গেছে। কেবিনের ছাদের এক কোণা দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে কেন? কেউ রাঁধছে! এখানে কেউ বাস করলে রহমতের জানার কথা। সে এই বনের নেতা। কাঠের ঘর। এগিয়ে উঁকি দেয়। কেউ নেই ভেতরে। তাহলে ধোঁয়া? শিউরে ওঠে রহমত; গায়ে কাঁটা দেয়। জ্বীনকে জোরে গালি দেয়। ‘শুওরের বাচ্চা, মশকরা করচিস আমার সাতে? আয় না; আয় সামনে আয় দিকি।’
ভেতরে বোঁটকা গন্ধ। মাংস পচেছে মনে হয়। হালকা ধুপের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। সাথে আগর! ধুপ-আগর মিলে ধোঁয়া তৈরি করছে! পচা মাংস, ধুপ এবং আগরের গন্ধ রহমতের মস্তিস্ক গুলিয়ে দেয়। পা কাঁপে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। থরথরিয়ে শুয়ে পড়ে। নিজেকে আর বনের নেতা ভাবতে পারে না। শালার জ্বীনটাই বোধহয় এ বনের নেতা। শয়তান যুবকগুলো ওকে লেলিয়ে দিয়েছে নাকি? ওরাই এখন রাজা? ওরাই দাপাবে? রহমতকে সরে যেতে হবে? সেই বার্তাই এই জ্বীন নিয়ে এসেছে? রজব আলীকে রহমতই তো এই কেবিনের মেঝেতে পুঁতে রেখেছিল। রজব গায়ত্রী নিয়ে লোকালয় থেকে পালিয়ে এসে তার কাছেই আশ্রয় নিয়েছিল। তারা এই কেবিনেই রাত কাটিয়েছে। রহমত ছিল বাইরে, খালের পাড়ে। সকালে রজব গিয়েছিল খাবারের সন্ধানে। গায়ত্রীকে একা পেয়ে রহমত বাঁচতে দেয়নি। মধুবন খালে ভাসিয়ে দিয়েছিল। রজব ফিরলে কাইজা হয়। বল্লমটা ছিল। মেরে দেয়। রহমত রজবকে কেবিনের মেঝেতে পুঁতে দেয়।
শরীরে আর জোর নেই। শুয়েই রয়। জোর থাকলেও আর উঠতে ইচ্ছে করে না। ফজরের পর আকাশে আলো বর্ষাতে শুরু করে। রহমতের ঘুম আসে। লতিফার কথা মনে হয়। তার দেয়া গুড়, মুড়ি। লতিফার দেয়া থলিতে হাত রেখে তার ছোঁয়া নেয়। তখন আকাশে আলোকপাত হচ্ছে। গম্-গম্ শব্দ। হুম্-হুম্। জ্বীনটা বোধহয় কাছেই। আলোকিত আকাশে জ্বীন? বোঝে না রহমত। মাথা তোলে সে। পরিষ্কার দেখা যায়। প্রকাণ্ড এক কায়া। ত্রিশ ফুট উচু হবে। পেছন ফিরে আছে। লম্বা এক গাছে পিঠ ঠেকিয়ে। এ কোন গাছ? এ অঞ্চলে এত লম্বা গাছ সে কখনো দেখেনি। জ্বীনটাকে দেখা যাচ্ছে। মধুবন খালের ওপারে। শক্তি সঞ্চয় করে দাঁড়ায় সে। জ্বীনের পিঠ দেখতে পাচ্ছে সে। পিঠ ছেদ হৃৎপিণ্ড দেখা যায়। বল্লমটা থাকলে ভালো হতো। শাঁই করে বসিয়ে দেয়া যেতো।
খাল পার হতে বেশি সময় নেয় না রহমত। জ্বীনের দিকে বন্দুক তাক করে। জ্বীন তাকে দেখেও দেখে না। নির্বিকার। চেহারা দেখা যায়। জ্বীনের চেহারার দিকে তাকিয়ে রহমতের মনে হয় সে এক আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। রহমত নিজেকে দেখে। জ্বীনের চেহারা অবিকল তারই চেহারা।
A very different type of story from Ekram Kabir. Engaging.