অতসী
কাজী মঈনুল হক
মুস্তফা আনোয়ার টেক্সাস স্টেট ইউনিতে পদার্থ বিজ্ঞান পড়ান। এক সময় এই বিষয়টা পড়াতে, পড়তে ও এই নিয়ে গবেষণা করতে ভালবাসতেন। কিন্তু এখন তার সেই ভালবাসায় ভাঁটা পড়ে যাচ্ছে। কেমন যেন আর উৎসাহ বোধ করেন না। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে বিভিন্নমুখী ধারার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কোন্ পথে এগোতে হবে জানতে হলে পরীক্ষণ অপরিহার্য। Large Hadron Collider (LHC) থেকে নতুন পথের দিশা বেরিয়ে আসবে বলে তিনি খুব আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু এ শুধু স্টান্ডার্ড মডেলের সত্যতাকে নিশ্চিত করে যাচ্ছে, কিন্তু এটিকে অতিক্রম করে নতুন পথের ইঙ্গিত দেখাতে পারছে না। পদার্থ বিজ্ঞান কি তবে শৈশব দশায় থেকে কেবল হামাগুড়ি দিয়ে যাবে! আমেরিকা বিশ্বের ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের উন্নয়নে LHC এর চেয়ে বড় কোনও প্রোজেক্ট হাতে নেয়ার ব্যাপারে এদের কোনও আগ্রহ নেই। ঠাণ্ডা-যুদ্ধের সবটাই হয়ত মন্দ ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকলে এতদিনে ধনবাদী বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে তারা LHC এর চেয়ে বড় কিছু করে দেখাত আর আমেরিকা তাদের টেক্কা দেবার জন্য আরেকটু এগিয়ে থাকার চেষ্টা করত। প্রতিযোগিতা না থাকলে সব কিছু কেমন ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। তিনি এক রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে, তিনি চাকরিটা ছেড়ে দেবেন। তাঁর মনে হচ্ছে, তিনি একই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে যাচ্ছেন। এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। তিনি শহর থেকে দূরে একটু নির্জনে একটা ফার্ম করেছেন। নিয়মিত ছুটিছাটা ছাড়াও প্রায়শ ছুটি নিয়ে সেখানে থাকছেন।
আজ তিনি সেখানেই যাচ্ছেন। একবার তিনি ভেবেছিলেন, এখানে তিনি দূরবীন বসাবেন, আকাশ দেখবেন। কিন্তু তিনি চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন আর আপন মনে নিজেকে শাসিয়েছিলেন, ‘মুস্তফা, তুমি সেই একই চক্রে ঢুকে পড়তে চাইছ। বেরিয়ে এসো।‘ এখানে যখন তিনি আসেন তখন পদার্থবিজ্ঞানের সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে আসেন। সঙ্গে আনেন থ্রিলার, উপন্যাস, কবিতার বই। আর আছে গানের সিডি। ইদানীং তিনি জ্যাজ আর রাগ সঙ্গীতের দিকে বেশ ঝুঁকেছেন। স্যাক্সোফোন আর সেতার তার রক্তে যেন নির্ঝরের কল্লোল বয়ে আনে। এখানে তার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো নিজ হাতে গড়ে তোলা একটি বাগান। এখানে আসার কথা ভাবলেই তিনি মনের মধ্যে শিহরণ অনুভব করেন যেন কোনও অভিসারে যাচ্ছেন তিনি। সবজি ও ফলের বাগান ছাড়াও তিনি একটা গ্রীন-হাউস করেছেন যেখানে তিনি শুধু ঔষধিগাছপালা লাগিয়েছেন। এই গ্রীন-হাউসটি তার আনন্দকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই মধ্যবয়সেও তিনি অবিবাহিত। এই বাগানটি যেন তার নিষিদ্ধ আনন্দ আর গোটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করার এক গোপন বিদ্রোহ। বৈশ্বিক উষ্ণতার অশনি সংকেত থেকে বেরিয়ে আসার তেমন কোনও উপযুক্ত তৎপরতা তিনি দেখতে পান না, সরকারের এই জড়তা তাকে মাঝে মাঝে অসহিষ্ণু করে তোলে। তিনি জানেন, তার এই বাগান বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিকার নয়, তবু এখানে এলে তিনি প্রাত্যাহিক শ্রান্তি-তিক্ততা ঝেড়ে ফেলে সুস্থির বোধ করেন। তাছাড়া তিনি ধ্যানস্ত হতে চান তার কিছু হারিয়ে ফেলা স্মৃতিকে ফিরে পেতে। আমেরিকায় আসার আগে তার কিছু একটা মানসিক সমস্যা হয়েছিল যার জন্য তাকে সাইকায়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। সেই সময়ের দু’তিন বছরের স্মৃতি তার কাছে আবছায়ার মতো, ধাঁধার মতো; তিনি সেই জট খুলতে চান।
দীপক চোপরার বক্তব্য মুস্তফা মনোযোগের সাথে শোনেন। তিনি খুব কমই অসুস্থ হন, পারতপক্ষে ডাক্তারের কাছে যান না। স্বাস্থ্যকর খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম আর ভেষজ চিকিৎসার প্রতি তার আস্থা অবিচল। তিনি যত্ন সহকারে চিকিৎসায় গাঁজার প্রভাব নিয়ে সাম্প্রতিক সব গবেষণাপত্রগুলো গুরুত্বের সাথে পড়েন। এটা স্পষ্ট যে, গাঁজা নিঃসন্দেহে একটি সম্ভবনাময় প্রতিশ্রুতিশীল ভেষজ উদ্ভিদ। ইসরাইলসহ বেশ ক’টি দেশ সেটা বুঝতে পেরেছিল এবং তারা পুরনো নথি ঘেঁটে এর ব্যবহারের ঐতিহ্যগত দিকটি পরীক্ষা করে দেখার পাশাপাশি কর্কট রোগেও এর ইতিবাচক ফলাফল দেখতে পেয়েছে। এই ভেবে তিনি অবাক হন যে, বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কিভাবে হাজার হাজার বছর ধরে পরিচিত এই উদ্ভিদের ঔষধি গুণাবলীকে সমাহিত করা হয়েছিল শুধুমাত্র ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে গাঁজা রাখার কারণে প্রথমবারের অপরাধীরা দুই থেকে ১০ বছরের জেল এবং ২০,০০০ পর্যন্ত ডলারের জরিমানা পাবে। এটিকে উস্কে দিয়েছিল বর্ণবাদী চিন্তাধারা আর এর ফলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে অপরাধী বানানোর পথ সুগম হয়েছিল। এখন আইন পরিবর্তনের সময় এসেছে। কিন্তু টেক্সাসের ধর্মান্ধ একগুঁয়ে শ্বেত জনগোষ্ঠীর কারণে সেটা আদৌ সম্ভব হবে কিনা কে জানে! ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো শুধু ব্যবসা বোঝে; গাঁজায় অসুখ সারলে তাদের কী লাভ! তাই এই গবেষণায় তারাও এগিয়ে আসছে না। তবু এর গবেষণা এগিয়ে চলছে অবৈধ পথে যা আইনের প্রতি অনুগত নাগরিকের কাছে কখনও কাম্য হতে পারে না। কিন্তু আমরা সবাই জানি, Necessity knows no law.
শাকশব্জি-ফলমূলের বীজ-চারা সহজেই সংগ্রহ করা যায়। অনেক ঔষধি গাছও অনলাইনে কেনা যায়। কিছু কিছু গাছ মুস্তফা যোগাড় করেছিলেন বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে। বিভিন্ন জাতের গাঁজার বীজ তিনি পেয়েছিলেন এক কবিবন্ধু মাইকের কাছ থেকে। মাইক লম্বা, কৃশকায়, চুল-দাড়িতে ঢাকা, হাতে ও গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরিহিত অমায়িক একজন শ্বেত মানুষ। মুস্তফা এখানে এলে তারা দুজনে মিলে মাঝে মাঝে পার্টি করে, বারবিকিউ করে। তখন মাইক গীটার বাজিয়ে গান করে। গানগুলো মাইকের নিজের লেখা ও সুর করা। কথাগুলোর মধ্যে কিছুটা বাউল গানের মতো আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ পাওয়া যায়। মুস্তফা তার দেয়া বীজ থেকে চারা বানিয়েই ক্ষান্ত হন নাই, তিনি এগুলোর উপর পরীক্ষামূলকভাবে অনেক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন THC ও CBD মধ্যে একটা আনুপাতিক সামঞ্জস্যতা আর অ্যারোমার মধ্যে স্নিগ্ধ মাদকতা আনতে। তিনি তার এই কাজের ভালোমন্দ বিবেচনায় নিয়েছিলেন আর এর পেছনে অনেক যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। তিনি মনে করেন, প্রাক-আধুনিক যুগে চিকিৎসাশাস্ত্র গড়ে উঠেছিল আইনের চোরা পথ ধরেই। আর ভেবেছিলেন, এটা তার নিজস্ব বাড়ি, এখানে যে কোনও ধরণের উদ্ভিদ জন্মানোর অধিকার তার আছে যদি তা টেক্সাসের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর না হয়। আর তা ছাড়া এটা শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য, তাই নিজেকে অপরাধী মনে করার কোনও কারণ নেই। এই গ্রীন হাউস তার কাছে একটি কল্যাণকর জঙ্গল। তিনি এর সবুজ ছায়ায় মাটিতে বসতেন, তাকিয়ে তাকিয়ে গভীরভাবে দেখতেন পাদপ জীবন আর এদের নীরব ভাষাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন। এ শুধু রঙ আর ছায়ার বিন্যাস নয়; এর গঠন, বর্ধন, রূপ ও গন্ধ তাকে আবিষ্ট করে রাখত। প্রতিটি গাছের আলাদা আলাদা নিজস্ব গন্ধ যা তাকে মাতাল করে ফেলত। উদ্যানবিদ্যা তিনি শেখেননি, তবু তিনি পেশাদার মালীর চেয়ে মন্দ করছেন না। প্রতিটি চারার বাড়ন্ত আর ডাগর শরীরের দিকে তাকিয়ে তিনি গর্ব ও পুলক অনুভব করতেন। তারা যেন সবাই একেকজন সঙ্গীতশিল্পী যারা শ্রবণোত্তর ধ্বনিদিয়ে গেঁথে চলছে অপূর্ব সঙ্গীতমালা। তার হৃদয় যদিও প্রেমপূর্ণ ছিল, কিন্তু তার কোনও প্রেমিকা ছিল না। অল্পদিনের মধ্যেই তার সব সম্পর্ক ফিকে হয়ে আসে। তিনি কারও সাথে দীর্ঘকালীন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন না বা চান না। একটা সন্ধ্যা বা রাতের জন্য যে প্রেমের সম্পর্ক তা-ই তার কাছে উপযুক্ত মনে হয়। তিনি কষ্ট পেতে চান না। সবচেয়ে সুন্দর ফুলও জঞ্জালে পরিণত হয়। বিশেষ কোনও নারীর সাথে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার যে অনীহা এর সাথে কি তার বিস্মৃত ছায়াঢাকা দিনগুলোর কোনও যোগসূত্র আছে!
মুস্তফা ধৈর্যের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকৃত সফল চারাগুলোকে স্থাপন করেছিলেন তার গ্রীন হাউসের একেবারে কেন্দ্রে। আর এদেরকে ঘিরে ছিল নানা ধরণের ভেষজ উদ্ভিদ। তিনি তার উদ্ভাবিত এই গাঁজা গাছের নাম দিয়েছিলেন অতসী। অনেকে Crotalaria retusa বা ডেভিল বীনকে অতসী বলেন। কিন্তু তিনি অতসী বলতে বুঝিয়েছিলেন নীলপুষ্পী বা সুনীলাকে যার বীজ রান্নায় ব্যবহার করা হয়, এর থেকে তেল হয় আর আঁশ থেকে কাপড়। এছাড়া এর অনেক ভেষজ ব্যবহার আছে। তিনি জানেন, তার অতসীর বীজও পুষ্টিকর যা সালাদে ব্যবহার করা যায়। এর বীজ থেকে উৎপন্ন তেলে অনেক ভেষজ গুণ থাকে। চাইলে এর আঁশকে কাপড় বানানোর কাজে ব্যবহার করা যাবে। মোজেসের সব অলৌকিকতার উৎস ছিল burning bush বা জ্বলন্ত গুল্ম। এই জ্বলন্ত গুল্মের মধ্যে তিনি ঈশ্বরের ছায়া দেখেছিলেন। মোজেসের সমস্ত সৃষ্টিশীল কাজের, ফারাওএর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কিংবা নতুন করে পবিত্র নগরী স্থাপনের অনুপ্রেরণা ছিল এই জ্বলন্ত গুল্ম। তার অতসীর মধ্যে কি তিনি ঈশ্বরের ছায়া খুঁজে পাবেন! পর্যাপ্ত জৈব সার থেকে পুষ্টি পেয়ে, আলো ও অক্সিজেন নিয়ে তার অতসী পরিপূর্ণ হয়েছে। রোপণকাল থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত তিনি তার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছেন, ফিসফিস করে গান শুনিয়েছেন, কখনওবা ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর করেছেন। এর ফুলে ছিল কী দারুণ বন্য উত্তেজক ঘ্রাণ!
অতসীকে মুস্তফার শরীরের অংশ করে নেবার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। অতসীর স্পর্শে তিনি মুছে ফেলতে চান তার সমস্ত উদ্বেগ, তিক্ততা, জাগতিক ক্লান্তি। তিনি নিদ্রার প্রশান্ত জগতে ঘুরে বেড়াতে চান। সন্ধ্যায় তিনি অতসীকে টেনে নিলেন গভীর প্রশ্বাসে তার হৃৎপিণ্ডের ভিতরে। তার রক্তে, সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে স্বর্গীয় মঙ্গলালোক। এর বিস্ময়কর সুগন্ধ তার মস্তিষ্কের উদ্যানে নির্মাণ করছে স্বপ্নের মায়াজাল। তিনি অমল শান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। সে রাতে তিনি একা বিছানায় ঘুমোতে যাননি। অতসী তার মধ্যে ঢুকে পড়ে তার শরীরের অংশ হয়ে গিয়েছিল। প্রশান্তিতে আবিষ্ট হয়ে তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর অন্য সবার মতো স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু তার স্বপ্ন সাধারণ কোনও স্বপ্ন ছিল না। তার অতসী সময় নিচ্ছিল তার শরীরের অভ্যন্তরে জেগে উঠতে, তার সাথে মিলিত হবার বাসনায়। তিনি অনুভব করছিলেন, কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া অলৌকিক মেঘ তার শরীর ও মস্তিষ্কের আকাশকে একটু একটু করে অধিকার করে ফেলছিল। তিনি অনুভব করছিলেন, নিবিড় উষ্ণতা আর মেয়েলি হাতের কোমল স্পর্শ। তার শরীর মধ্যাকর্ষণ মুক্ত হয়ে ভাসছিল ভারহীন মেঘের মতো। ভাসতে ভাসতে তিনি একটি বৃক্ষময় উদ্যানে ঢুকে পড়েন। এই বিশাল উদ্যানে তিনি একা। তবু তিনি নিঃসঙ্গতা অনুভব করছিলেন না। তার সমস্ত ক্লান্তি আর উদ্বেগগুলো বাষ্পীভূত হয়ে মিশে যাচ্ছিল সবুজ পাতার ক্লোরোফিলে আর তার স্নায়ু সম্মোহিত হয়ে পড়েছিল মিষ্টি সুরভিতে। এ সময় কেউ যেন তাকে সুরেলা মেয়েলি কণ্ঠে ডাক দিল, “মুস্তফা…”। কিন্তু তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না। হঠাৎ তার চারপাশের ফুলগুলো ধোঁয়ার মতো উবে যেতে যেতে মানবীয় আকার নিচ্ছিল আর তারা সমবেতভাবে যন্ত্রসঙ্গীত বাজাতে শুরু করে। তখন একই সাথে ছয়টি ঋতু তার চোখের সামনে প্রতিভাত হচ্ছিল। তিনি একটি নির্ঝরের তীর ধরে স্রোতের উল্টোদিকে হাঁটতে থাকেন যেদিক থেকে কেউ তার নাম ধরে ডাক দিয়েছিল। নির্ঝরের উৎসস্থল ছিল উদ্যানের কেন্দ্রে যেখান থেকে চারটি স্রোতধারা চারদিকে প্রবাহিত। সেখানে তিনি তার অতসী গাছকে বেশ বড় আকারে দেখতে পেলেন। আর এই গাছের ভিতর থেকে সেই কন্ঠস্বর বলল, ‘মুস্তফা, তুমি তোমার জ্ঞানকে উৎসর্গ কর সৌন্দর্যের উপসনায় আর আমাকে জাগিয়ে তোল।‘ তিনি কী করবেন বুঝতে না পেরে আলতো করে গাছটিকে স্পর্শ করতেই গাছটি একটি রমণীতে রূপান্তরিত হল যার চুল ছিল নীল, চোখের মণি সবুজ আর ছিল শুভ্র আবরণহীন দেহ। কাছে এসে সে তাকে জড়িয়ে ধরতেই তার নিজেকে সম্পূর্ণ নগ্ন মনে হল। যদিও তারা কথা বলছিল না, কিন্তু পরস্পরের ভাবনা বুঝতে পারছিল। তিনি গভীর আশ্লেষে তাকে আলিঙ্গন করতেই তার মনে হল, তাদের শরীর গলে গিয়ে একটি দেহে পরিণত হচ্ছে। তিনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি তোমাকে কী নামে ডাকব?’ ‘আমি তোমার অতসী’, সে মৃদু কন্ঠে উত্তর দিল।
গভীর সম্মোহনের মধ্যে কতদিন এই ফার্মহাউসে কাটিয়েছিলেন সে হিসেব মুস্তফার ছিল না। তার ঘোর কাটল তাদের সহকারী অধ্যাপিকা শ্যারনের ফোন পেয়ে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার আজকে এয়ারপোর্টে যাবার কথা ছিল মেয়েটাকে আনতে। আপনি কি গিয়েছিলেন?’ একটু একটু করে তার ঘোর কেটে যাচ্ছে। বৃক্ষদের পৃথিবী ছেড়ে তাকে মানুষের পৃথিবীতে ফিরে আসতে হচ্ছে। আবার সেই একঘেয়ে চিন্তা, কাজ, বস্তুগত চক্রের পেষণ। তার অকস্মাৎ মনে পড়ে গেল, বাংলাদেশের একটা মেয়েকে তিনি তার ল্যাবে কাজ করার অনুমোদন দিয়েছিলেন। সে তার প্রেরিত লেখার প্রথমাংশে বলতে চেয়েছিল, মহাকর্ষীয় তরংগ (gravitational wave)এর বেগ আলোর বেগের সমান হবে নাকি কম হবে, অর্থাৎ গ্রাভিটন ভরশূন্য হবে নাকি ভরযুক্ত হবে আর ভর থাকলে সেটা কত হওয়া যুক্তিযুক্ত। তার গবেষণা প্রস্তাবের এই অংশে বিশেষ নতুনত্ব নেই। কিন্তু দ্বিতীয় অংশটি গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে সে দেখাতে চেয়েছে LIGO কিংবা Virgo interferometer এর ডাটা থেকে কিভাবে গ্রাভিটনের ভর নির্ধারণ করা যাবে। এই অংশটুকু দিয়ে তখনই একটা পেপার খুব ভালো জার্নালে প্রকাশ করা যেত। মেয়েটার নাম সেই মুহুর্তে তিনি মনে করতে পারলেন না। তার কি আজ আসার কথা ছিল? আজ কী বার?
— দেখুন, শ্যারন, আমি খুবই দুঃখিত এবং লজ্জিত। আপনার কাছে কি মেয়েটার ফোন নম্বর আছে?
— মেয়েটা এখন আপনার রুমে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
— আমার পৌঁছতে ঘন্টা দুয়েক লাগবে। আমি আবারও দুঃখিত।
মুস্তফা তার রুমে ঢুকে মেয়েটিকে দেখে খুবই বিস্মিত হলেন। এ যেন তার স্বপ্নে দেখা সেই অতসী, যদিও তার চুল নীল নয়, চোখের রঙও সবুজ নয়। বলাই বাহুল্য, সে নগ্নিকাও নয়। আর ঠিক তখনই তার মেয়েটার নাম মনে পড়ে গেল। অতসী। অতসী চৌধুরী। মেয়েটি তাকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই তিনি হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। মেয়েটির বসার ভঙ্গিতে কিংবা থুতনির টোলে কছু একটা ছিল যা তাকে অন্যমনস্ক করে দেয়। তিনি একটা আলো-আঁধারি জগতের মধ্যে ঢুকে পড়েন। এটা কি প্যারালাল ইউনিভার্স নাকি গত জন্মের পৃথিবী! নাকি তিনি এখনও গাঁজার কুহক ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তিনি ঘাসের উপর বসে থাকা একটি মেয়েকে দেখতে পেলেন, যার অবয়ব অস্পষ্ট; কিন্তু কন্ঠস্বর স্পষ্ট। এই ছায়াশরীরী মানবীটার সাথে এরকম কথাবার্তা হয়ঃ
— তুমি কি পরজন্মে বিশ্বাস কর?
— না, তবে জন্মান্তরে বিশ্বাস করি। মানুষের এক জীবনেই অনেক জন্মান্তর হয়।
— পরজন্ম থাকলে সেই জন্মে তুমি কী হতে চাইতে?
— বৃক্ষ
— আমি তাহলে পাখি হতাম
— কেন?
— তোমার ডালে গিয়ে বসতাম।
মুস্তফার ঘোর কেটে যায়। এবার তিনি সরাসরি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তোমার গবেষণা কাজের জন্য কেন আমাকে সুপারভাইজার হিশেবে নির্বাচন করেছ?’
— আমি আপনার বেশ ক’টি পেপার পড়েছি। অবশ্য সেটি কোনও কারণ নয়, আমি অন্য প্রফেসরদের লেখাও পড়েছি। কারণটা হলো, আমার মা আপনাকে চিনতেন।
— তোমার মা?
— আমার মা একটা কলেজে উদ্ভিদ বিজ্ঞান পড়ান। নাম অর্পিতা চৌধুরী।
তিনি নামটাকে মনে করতে চাইলেন। তার জীবনের দু’তিন বছরের স্মৃতি একটি নিষিদ্ধ অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। তিনি নিজের অজান্তে সেই বিস্মৃত ঘরে প্রবেশ করার জন্য একটা চাবি খুঁজছেন অনেক অনেক কাল ধরে। আবার তিনি সমাধিস্ত হন। আবার সেই ছায়াশরীরী তার সাথে বলতে শুরু করে।
— মরে গেলে আমরা কোথায় যাই?
— মৃত্তিকা হয়ে যাই।
— এ জন্য তোমার মন খারাপ হয় না।
— হয়।
— তুমি কি তোমার প্রজন্ম রেখে যেতে চাও না?
— প্রজন্ম রেখে যাওয়ার চেয়ে বড় কথা হল, আমি তাকে ছুঁয়ে দেখতে চাই। আদর করতে চাই। মূর্তি গড়তে চাই।
— ছেলে না মেয়ে চাও তুমি?
— ছেলে চাই কিনা জানি না, তবে যে একটি মেয়ে চাই এতে কোনও সন্দেহ নেই। নাম রাখব অতসী।
— অতসী কেন?
— সে আমার মতো কালো হবে তাই।
—অপরাজিতা নয় কেন?
— বড্ড লম্বা শব্দ।
এ সব তার কী হচ্ছে! মুস্তফা ভাবেন। তার কি আবার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে! এই মেয়েটি কি তার মানসিক সমস্যার কারণ নাকি তার বিস্মৃত নিষিদ্ধ জগতে প্রবেশের হারিয়ে ফেলা যাদুর কাঠি!
খুব ভালো লাগলো।।
ভিন্ন ধরনের একটি গল্প। ভালো লেগেছে।