একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে
শুজা রশীদ

এতো অসংখ্য বাংলা গানের মধ্যে কোন একটি গানকে সবচেয়ে প্রিয় বলে সনাক্ত করাটা কঠিন কাজ। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। ছোটবেলায় প্রথম যখন ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’ গানটি শুনি, তখনই এর কথা এবং সুর আমার মনের মধ্যে এমন ভাবে গেঁথে যায় যে নিজের অজান্তেই আজও কখন কখন সম্পূর্ণ অকারণেই গেয়ে উঠি …

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি

মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি

যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা …

কোন এক অজানা কারনে নিজের হেঁড়ে গলা নিজের কানে মধুর মত শোনায়, কিন্তু গৃহিণী কুলকুলিয়ে হেসে ওঠে। “আহারে, কি গলা। এ পাড়ায় আর কুকুর বিড়াল একটাও থাকবে না।”

কন্যার বয়েস ৯ হলে কি হবে, খোঁটা দেয়াটা সে মায়ের কল্যানে ভালোই শিখেছে। হোম ওয়ার্ক থেকে মুখ তুলে গম্ভীর মুখে কাটখোট্টা বাংলায় বলবে, “তুমি গান করো না। আমার লাইফটা হেল হচ্ছে। ভেরী ব্যাড।”

আহারে, বাংলার কি ছিরি! ছোট থাকতে দিব্যি বলতো, যত বড় হচ্ছে ততই বলার আগ্রহ বাড়ছে, কিন্তু দক্ষতা কমছে।

যাই হোক, আমার সঙ্গীত চর্চা ছেড়ে এবার গানের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। …একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি … যুদ্ধের মত অসম্ভব জটিল এবং ভয়ংকর একটি ব্যাপারকে এতো চমৎকার করে ফুটিয়ে তুলতে পারার মত শব্দের গাঁথুনি আর কয়টি গানে আছে? আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য যে সব আবাল বৃদ্ধ বনিতা যুদ্ধের দামামায় উদবুদ্ধ হয়ে নিজের প্রাণ বাজি রেখে শত্রুর মোকাবিলা করতে মহা বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের চালিকা শক্তি নিশ্চয় ছিল নিজ জন্মভুমিতে স্বাধীন, মুক্ত জীবন যাপন করবার অধিকার পাওয়া, সন্তান- সন্ততিদের আত্মসম্মানের সাথে এবং নিজ সাহিত্য সংস্কৃতিকে জড়িয়ে ধরে বড় হয়ে উঠবার অধিকার দেবার। সেই সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীন জীবনের চেয়ে বড় উপহার আমাদের কাছে আর কি হতে পারে? যে মালাকার সযত্নে একের পর এক শব্দ চয়ন করে মানব হৃদয়ের সেই চিরস্থায়ী আবেগকে সযত্নে ধারন করেছেন তার গীতিতে, তার জন্য সব সময়েই শ্রদ্ধা অনুভব করেছি, ভালোবাসা প্রকাশ করেছি মনের গভীরে, কিন্তু কোন এক অজানা কারনে কখন তাকে জানবার চেষ্টা করিনি।

কয়েক দিন আগে বাংলাদেশী ইংরেজী পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টারের ইন্টারনেট সংস্করণ পড়তে গিয়ে একটা মৃত্যু সংবাদে চোখ আটকে গেল। খুবই নিরীহ দর্শন একজন মানুষ, বিখ্যাত কেউ নন, তবুও পড়লাম এবং তখনই আবিষ্কার করলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় গানের রচয়িতাকে – গোবিন্দ হালদার। অনেক গান লিখেছেন তিনি, জানলাম। আরো যে দুটি গানের কথা উল্ল্যেখ করা হয়েছে দুটিই অসম্ভব জনপ্রিয় গান – এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা এবং পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে।

তিনি ভারতের অধিবাসী ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান ছিল গানের কথায়। সম্ভবত সেই জন্যেই তার দেশাত্ববোধক গানে ক্রোধের চেয়ে বেশী বৈশীষ্টতা পেয়েছে সাধারণ জাগতীয় চেতনা, যে চেতনা শুধু একটি দেশের মানুষ এবং তাদের দুর্দশায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং স্বাধারণ শব্দের সমাবাশে স্বার্থক ভাবে প্রকাশ করেছে সকল মানুষের আবেগ এবং উচ্ছ্বাসকে।   

জানলাম, বাংলা বেতারে তার গান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকে বাজানো হলেও ভিন্ন দেশের নাগরিক ছিলেন বলে তার নাম কিছুদিন গোপন করে রাখা হয়েছিল। পরবর্তিতে, স্বাধীনতার পর, সেউ সমস্যা কাটলেও তিনি খুব একটা আর্থিকভাবে লাভবান হননি।

গোবিন্দ হালদার চলে গেছেন, জাগতিক প্রয়োজন তার মিটে গেছে। কিন্তু তার অর্থ বহুল, হৃদয় মাতানো গানের কথা দিয়ে তিনি ভরিয়ে রাখবেন অসংখ্য বাংলাদেশীর মন, দীর্ঘদিন।

গোবিন্দ হালদারের কথা লিখতে লিখতে মনে হল আরেকজন অসম্ভব গুনবান গীতিকারের কথা, গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তিনিও গোবিন্দ হালদারের সাথে স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য বেশ কিছু দেশাত্ববোধক গান লিখেছিলেন। তার কয়েকটি বিখ্যাত গানঃ এক নদী রক্ত পেরিয়ে, একবার যেতে দে না, এক তারা তুই দেশের কথা ইত্যাদি। বাংলা ছায়াছবির জন্য প্রচুর গান লিখেছেন তিনি, কিছু কিছু গান অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং এখনও জনপ্রিয়। তার লেখা গান গেয়ে অনেক শিল্পী বিখ্যাত হয়ে গেছেন। আমার মত অধিকাংশ মানুষই হয়তো জানেন না সেই সব মন জুড়ানো সঙ্গীতের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশী। পর্দার আড়ালে বসে এই প্রতিভাবান মানুষগুলি আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির জন্য যে অবদান রেখে গেছেন এবং এখনও অবিরাম রেখে চলেছেন তাদের সবার জন্য আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

গোবিন্দ দাদা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। আমরা তার যথাযথ মূল্য না দিয়ে থাকতে পারি কিন্তু তার স্রৃষ্টির অবমাননা কখনো হবে না। এই পৃথিবীর সকল সুন্দর এবং প্রেমময় বস্তু এবং অনুভূতির জন্য আমরা চিরকাল যুঝে যাব।  আমার প্রিয় গানটির সম্পূর্ণ কথাগুলি এখানে তুলে দিলাম।

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।
যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যার নদীর জল ফুলে-ফলে মোর স্বপ্ন আকা
যে দেশের নিল অম্বরে মন মেলেছে পাখা
সারাটা জীবন যে মাটির গানে বক্ষ ভরি।
মোরা নতুন একটা কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি
মোরা নতুন একরতি গানের জন্য যুদ্ধ করি
মোরা একখানা ভালো ছবির জন্য যুদ্ধ করি
মোরা সারা বিশ্বের শান্তি বাচাতে আজকে লড়ি।
যে নারীর মধু প্রেমেতে আমার রক্ত দলে
যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে
যে গৃহ কপোত সুখ-স্বর্গের  দুয়ার খোলে
সেই শান্তির শিবির বাঁচাতে শপথ করি।


Top

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments


Copyright © 2023. All Rights Reserved.