ধ্বনিমূর্তি কিংবা এলিয়েন  
কাজী মঈনুল হক

                                     

অমরার স্ফীত সমুদ্রের নোনাজলে ভাসমান গর্ভফুল থেকে
রক্তের কাদায় — নোনায় — পিচ্ছিল শ্যাওলায় —    
ডুবন্ত দ্রোণীর আবর্তিত স্রোতের বুদ্বুদ আর গাঁজলার
ভিতর দিয়ে ক্ষুদে পর্যটকের মতই সে আসছে অনন্তের পথ পাড়ি দিয়ে
অন্য এক অচেনা জগত থেকে। শ্রোণীর দোলনায় কাপ্তানের জন্য রক্ষিত আসনে
তুলতুলে-নড়বড়ে খুলি ও গোড়ালি, অন্ধকারের আত্মায় পাঁজড়ের পলকা পাল-মাস্তুল,
ধনুকের মতো শিরদাঁড়া, ভাসমান কাঠ-হাড়গোড়; অনস্তিত্বের হৃদয় থেকে
তরঙ্গের পর তরঙ্গ ডিঙিয়ে তার যান নোঙ্গর ফেলার জন্য ডাঙা খুঁজছে।
সেই মুহূর্তটি স্মৃতিতে জাজ্বল্যমান, কিছুতেই ভুলবার নয়, আমরা তাকে দেখতে পাই
পরাবাস্তবতার আয়নায় অন্য এক নিবিড় ভুবনে।
তখনও সে মাছের ফুলকা, জলের ফুসফুস, পাঁকালঘাসের চুল, সিন্ধুঘোটকের
নরম কঙ্কাল, সে যেন ভবিষ্যতের ভূত; রেশমের কীটের শ্বসন, পারদের নড়াচড়া,
মুষ্টির ঘুমন্ত ছায়া; সম্মোহিত আমরা তাকে দেখি আমাদের পৃথিবীর আধুনিক অতিধ্বনির পর্দায়।
তখনও সে জীবন্ত, কিন্তু প্রাণবন্ত নয়; থাকা ও না- থাকার অদৃশ্য সুতোয় দোলুল্যমান।
তবু জঠর-দেয়ালে তার অস্তিত্বের মৃদু নড়াচড়া, রক্তকম্পনের নাদ
আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে প্রতীক্ষার নিবিড় প্রহরে।
তারপর সেই ক্ষণ আসে, অ-জগতের কুয়াশা ছিঁড়ে সে তখন আমাদের পৃথিবীতে,
তখন সে প্রাণ, ভেজা ভোদঁড়ের মতো, রক্তাপ্লুত মুখ, নিরুদ্ধ ঝালানো চোখ,
শ্লেষ্মাকাদার ভিতরে  কালো রাজহংসের মতো জীবনের জলকেলি,
সিক্ত প্রসব রজ্জুতে ঝুলে থাকা অবাস্তব জগতের দূত।
অপার্থিব মায়ায় আমাদের চোখ দেখে তার ল্যাপটানো চুল, নরম করোটি,
গুটি গুটি হাত-পা, অসহায় আর দয়ার কাঙাল। 
দেখতে সে অনেকটা আমাদের মতো, তবু আমাদের মতো নয়, অথবা সে
ভান করে আমাদের মতো করে নিজেকে ফোটাতে। আমাদের এখনই সতর্ক
হওয়া দরকার, কারণ সে এই পৃথিবীতে একা আসে নাই, তারা আসে আলাদা আলাদা করে
নানা স্থানে আর কুহকী মায়ায় আমাদের ভূতগ্রস্ত করে রাখে। তারা একদিন
আমাদের রীতিনীতি-ভাষা শিখে নেবে, তারপর আমাদের  
সজোরে হঠিয়ে দিয়ে এই পৃথিবীটা নিজেদের অধিকারে নেবে।           

Top

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments


Copyright © 2023. All Rights Reserved.